প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯:১৩
নিকুঞ্জ নিকেতন

‘ঠিক বলেছেন দাদা। খুব যত্নে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ছাঁচে গড়ে তুলি যেন মূল্যবান একটা রত্ন আর যখনই রত্নটা তৈরি হয়ে যায় তখন কেমন যেন একটু করে অচেনা হতে থাকে তারপর হারিয়ে যেতে যেতে তার মধ্যে আর আপনটা থাকে না। রত্নটা নিজের হয়েও যেন অধিকারে নেই এমন মনে হয়।’
‘মা-বাবা সন্তান গড়ার কারিগর আর সেই কারিগর যখন সন্তানকে তৈরি করে ফেলে তখন অনিচ্ছায় হলেও কোনো একদিন ছেড়ে দিতে হয়। এত যত্ন করে গড়া মানুষটাকে কীভাবে হারিয়ে যেতে দেই। মনটা যে মানে না।’
‘দাদার নামটা কী যেন বললেন?’
‘নরেন্দ্র নারায়ণ।’
‘হ্যাঁ নরেন্দ্র দাÑআপনার কথাগুলো মনে গেঁথে যায় দাদা। নিজের মতো কাউকে পাইনি বলেই কেমন যেন দম বন্ধ অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। ঈশ্বর হয়তো আপনাকে পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে করুণা করেছেন।’
‘কী যে বলেন না দাদা। আমাদের নিয়তি যুক্ত করেছেন বিধাতা। এই যে পৃথিবী দেখছেন এটা ঐ সৃষ্টিকর্তার নটমঞ্চ যার প্রত্যেকটা চরিত্রে আমরা একেকজন রয়েছি। তিনি রূপকার, তিনিই পরিচালক।’
‘বাহ্ বেশ বলেছেন মনটা ভরে গেল। নাতি-নাতনিকে নিতে যেতে হবে আমি এখন উঠব। আগামীকাল দেখা হবে আপনার সাথে?’
‘যদি বেঁচে থাকি তাহলে এই বাদাম গাছতলায় এসে বসব।’
‘যদি বেঁচে থাকি কেন? এটা তো হতাশার বাণী।’
‘বয়সটা এমনই, বেঁচে থাকার কোনো গ্যরান্টি নেই। যদি এসে দেখবেন আমি নেই তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন। হয়তো হাঁটতে বের হয়েছি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসব আর যদি না আসি তাহলে যা বুঝার বুঝতে পারেন।’
‘আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালোই হলো আমি একা আর থাকছি না বোধ হয়। আজ অনুমতি দিন আগামীকাল দেখা হচ্ছে তাহলে।’
সময়গুলো কাটানোর মানুষ পেয়ে গেলাম যাকে বিশ্বাস করা যায়। তার বিষয়ে জানতে চাইলে হয়তো আমাদের মনের বিষয় ও ব্যথাগুলো কাছাকাছি হবে। পরবর্তী দিন বরাবরের মতো পার্কে আসি, বেঞ্চিতে বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি তারপর রাউন্ডে চলে যাই আবার এসে বসি কিন্তু তার কোনো দেখা নেই। মনটা খারাপ হয়ে উঠল। অবশ্য মন খারাপ করে কী হবে এরই নাম জীবন এখানে কারো অপেক্ষা করে লাভ নেই। মনটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম। প্রায় কয়েকদিন হয়ে গেল এর মাঝে দু দিন বৃষ্টি থাকায় আমারও আসা হয়নি পার্কে। তারপর একদিন রাউন্ড শেষ করে বেঞ্চিতে বসে আছি ক্লান্ত হয়ে তখন পাশে এসে একজন বসল তাকাতেই দেখি সেই ভদ্রলোক। হারিয়ে গিয়েও যেন আবার ফিরে পাওয়া।
‘কী ব্যাপার দাদা এতদিন কোথায় ছিলেন?’
‘বউ-ছেলের সাথে আমাকে যেতে হয়েছিল বউয়ের বাপের বাড়ি তাই আসতে পারিনি। গতকাল এসে নামলাম। আমার খুব ইচ্ছে ছিল এসে এখানে আপনার সাথে জমিয়ে আড্ডা দেই।’
‘আপনার নাতির স্কুল কটায় শুরু হয়?’
‘ওরা ভাই-বোন দুজন। নাতি পঞ্চম শ্রেণিতে আর নাতিন দ্বিতীয়। ওদের স্কুল মর্নিং শিফটে সাতটায় পিটি শুরু তাই তার আগেই চলে আসতে হয়।’
‘আপনার তাহলে বড় দায়িত্ব।’
‘হা হা হা...তা বটে।’
‘আচ্ছা বাকি সময়টা তো আমার সাথে এই পার্কে হেঁটে কাটাতে পারেন। আমি নিজেও একটা পার্টনার পেয়ে গেলাম!’
‘মন্দ বলেননি। আগামীকাল থেকেই শুরু করছি তাহলে।’
‘বেশÑচলুন এই খুশিতে ডাব খাই। কচি ডাব ডায়াবেটিক রোগির জন্য নাকি অনেকটা উপকারী।’
‘আমার আপত্তি নেইÑচলুন।’
‘ডাব খেতে খেতে গল্প জুড়ে দেই কী বলেন?’
‘হা হা হা...’
আমরা দুজনেই ডাব খাওয়া নিয়ে বেশ আনন্দ প্রকাশ করছি। আনন্দ শুধু ডাব খাওয়া না নিঃসঙ্গতা ঘুচানোও। এবারের দেখায় দুজনে কেমন যেন বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছি। প্রতিদিন একসাথে হাঁটছি, ডাব খাচ্ছি, হাসি-আনন্দ আর আন্তরিকতায় যেন আমরা খুব কাছের হয়ে উঠলাম। আগের সেই অনিমেষটা এখন আর নেই। নিঃসঙ্গ, জড়াজীর্ণ একটা মানুষ যার অসহায়ত্ব সেদিন ভেসে উঠেছিল চেহারায়। প্রতিদিনই আসা হয়, কথা হয়, বলা হয় কত কিছু কিন্তু জানা হয় না নিজেদের। তারপর একদিন নিজেই প্রকাশ করে ফেললাম জানার আগ্রহ নিয়ে।
‘কী জানতে চাচ্ছেন দাদা। অবসরের আগের জীবন ও পরের জীবনের গ্যাপ অনেক। একটার সাথে অন্যটা মিলবে না।’
‘ঠিক বলেছেন। মিলিয়ে নেওয়া অনেকটা কষ্টের আর হয়েও ওঠে না। তবু জানার অনেক কিছুই থেকে যায়।’
‘আমি ছিলাম শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। দুই ছেলে দুই মেয়ের মাঝেই কেটেছে স্বামী-স্ত্রীর সুখের সংসার। চাকরি থাকাকালীন মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। বড় মেয়ের স্বামী একটা কলেজের শিক্ষক আর ছোট জনের ইঞ্জিনিয়ার। ছেলেদের কথা না বললেই নয় বড় ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও তার স্ত্রী এডভোকেট আর অন্যজন ডাক্তার এবং তার স্ত্রীও ডাক্তার। ছেলে-মেয়েরা যার যেমন ব্যস্ততায় কাটায় সারাক্ষণ আর আমরা স্বামী-স্ত্রী ছিলাম আমাদের মতোই। বাসা এমন একটা জায়গা যেখানে সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে জীবনের গাড়িটা এসে স্থির হয়। চাকরি শেষে যেদিন অবসরের সময়টা চলে এল তখন একটা ধাক্কা খেলাম। গতিশীল জীবন থেকে যেন এক মুহূর্তে স্থির হয়ে যাওয়া তবুও মিলিয়ে নিতে হবে তাই চলমান ছিল জীবনটা। কিছুদিন পর সন্তানদের দৈনন্দিন ব্যস্ততার সাথে যেন তাল মিলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। তাদের জীবনের গতি আর একটা অবসর মানুষের গতি এক হবে না, এটা স্বাভাবিক। তারা নিজ নিজ কর্মস্থল বেঁছে নিল আর সেখানেই নীড় গড়েছিল। কোনো উৎসব বা আয়োজনে পুরো পরিবার একসাথ হতাম ভালো লাগত তারপর যখন তাদের চলে যাওয়ার সময় হয় মন না চাইলেও বিদায়টা দিতে হতো। দু চারদিন যদিও খারাপ লাগত তারপর স্বাভাবিক হয়ে যেতাম কারণ সে সময় গিন্নি থাকত আমার সাথে তাই কোনো বিষয়ই অস্বাভাবিক লাগেনি কখনো। একদিন হঠাৎ দেখি আমার জীবনসঙ্গী হাতটা ছেড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। রাতে একসাথে ঘুমিয়েছিলাম সকালে আমি তো জেগেছি তার আর জাগা হয়নি (কান্নায় ভেঙে পড়ল)।’
‘(পিঠে হাতটা বুলিয়ে) অনিমেষ দা... আজ থাক না হয়।’
‘(একটু স্বাভাবিক হয়ে) একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষের জীবন সূত্র যখন গেঁথে দেওয়া হয় তখন ধীরে ধীরে না চাইতেও যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠে একে অপরে আর এটা যখন দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসে অনেক দূরে তখন হঠাৎ তার অভাব যেন অস্থির করে তোলে। মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে ছেলে-মেয়েদের ফিরে আসতে কিছুটা সময় লেগে যায়। সৎকার ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষে তারা যে যার কর্মস্থলে চলে যাবে অথচ আমি যাব কোথায়? দাদা সেদিন খুব অসহায় বোধ করলাম। চার সন্তান, এতগুলো জায়গা অথচ আমার যাওয়ার জায়গাটা যেন নেই। প্রত্যেকের জীবন হয়ে উঠেছিল একান্ত ব্যক্তিগত। সন্তানগুলো যেন আমার আপন হয়েও আপন নয়। কোথায় ছিল ভুলগুলো মিলিয়ে নিতে পারছিলাম না। আমি তাদের ব্যক্তিগত জীবনটায় কোনো ব্যক্তি নই শুধু একটা পণ্য যাকে রাখার জন্য জায়গা প্রয়োজন। ওদের আলাপচারিতা আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনলাম তারপর ভাবছিলামÑনা, এখানে এভাবেই কাটাব বাকি জীবন। তারা নিতে চাইল সাথে করে আমি বুঝতে দেইনি যে তাদের আলোচনাগুলো আমার জানা আছে। শুধু বললাম যখন একা থাকতে সমস্যা হবে তখন চলে আসব। ওরা ফিরে গেল যার যার গন্তব্যে এখন আমি শুধুই একা। স্ত্রী শোক কাটিয়ে যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলাম তখন কেমন যেন অসহায়ত্ব ঘিরে ধরল। আমার পৃথিবীর মানুষগুলো এক এক করে উধাও হতে লাগল, যারা একান্ত আপন তারা অচেনা হতে লাগল। আমার গন্ডিটা ধীরে ধীরে হয়ে যাচ্ছে জনশূন্য। দিনের পর দিন কেমন যেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছি কিছু মনে থাকছে না। বাসা থেকে বের হচ্ছি অথচ কিছুক্ষণ পর ভুলে যাই কেন বের হলাম বা কোথায় যাব। দোকান থেকে কিছু নিলে টাকা দিয়ে পণ্য না নিয়েই চলে আসি। একদিন আমার নিজের নামটা প্রকাশ করতে পারিনি এক অপরিচিত লোকের কাছে। বুঝতে পারছি কিছু একটা ঘটে চলেছে আমার সাথে কিন্তু উপায় খুঁজে পাই না। সমস্যাগুলো দিনের পর দিন বাড়তে লাগল তখন পাড়ার এক দোকানি আমার কাছ থেকে পরিবারের অন্যদের নম্বর নিয়ে তাদের নক দিল কিন্তু সে আমাকে জানতে দেয়নি। কিছুদিন পর হঠাৎ ছেলে-মেয়েরা উপস্থিত দেখে আমি কিছুতেই মিলিয়ে নিতে পারছিলাম না। আমার এ অবস্থা দেখে অবশেষে কোনো কথা না শুনেই ওরা এখানে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এ শহরে আমার আসা বেশিদিন হয়নি এইতো মাস চারেক হবে। আমার সাথে কাজের মানুষ একটা সবসময় থাকত গত কয়েক দিন যাবৎ আর তাকে আনছি না। আমি প্রায়ই এখানে আসতাম আর এভাবে একদিন আপনি এলেন তারপর আজকের এই আমরা।’
‘আমি বেশ কয়েকটা দিন আপনাকে লক্ষ্য করেছিলাম, কেমন যেন জড়সড় হয়ে একটা মানুষ বসে আছে। বেশ আগ্রহ ছিল আপনাকে জানার।’
‘কেন?’
‘হয়তো আপনার মতো আমার জীবনটাও কোথাও মিলে যেতে পারে।’
‘আমরা অনেক বিচিত্র নরেন্দ্র দা। সফলতার পিছে ছুটি তারপর পেয়ে গেলে সেটা সামলাতে পারি না আবার কামনা করি আগেরটা তখন আর হয়ে ওঠে না। সারাদিন খুবই একা কাটে আমার। ছেলে আর ছেলের বউ যার যার কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় পর তারপর তাদের ক্লান্তি আর পরিশ্রমে নেতিয়ে পড়ে। আমাদের সকলের দেখা হয় রাতে খাবার টেবিলে। যান্ত্রিক জীবনটায় তাদের তখনো সময় নেই কারণ খুব ভোরে উঠে ছেলে-মেয়েদের স্কুলের জন্য তৈরি করে দিয়ে নিজে অফিসের জন্য বের হবে আর আমার তো সেরকম কিছু নেই। বাচ্চাদের স্কুলে আনার বিষয়টা নিজের জন্যই সুযোগ করেছি। আমার মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় এনে প্রথমে তারা রাজি হয়নি তারপর বাসার কাজের লোককে সাথে দিয়ে আমাকে এ সুযোগ দেওয়া হয়। দাদা আমাকে উঠতে হবে বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। আপনার সম্পর্কে কিন্তু তেমন একটা জানা হয়নি। আগামী দিন আপনারটা শুনব, অপেক্ষায় থাকলাম।’
‘অবশ্যি...’
তার সাথে কোন জায়গায় আমার মিলবে সেটা জানা যদিও তবু তাকে ঘিরে আমার জানার আগ্রহটা ছিল প্রবল। যাক অবশেষে জানা হলো কিন্তু এতটুকুতেই আমি যেন সন্তুষ্ট নই আরও অনেক কিছু আছে যা এখনো অজানা রয়ে গেছে। আমার শুধু তাকে জানার আগ্রহই ছিল না ইচ্ছে ছিল নিজের ভিতরের জমে থাকা বিষয়গুলোকে বলার যেটা এখনো অপূর্ণ থেকে গেল।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]