প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯:১১
অপ্রকাশ্য ভালোবাসা

বকুলতলায় ফুল কুড়ানোর স্বভাবটা আর তোর পরিবর্তন হলো না এখনো। সেই ছেলে বেলার মতোই আজো তোর স্বভাবÑচরিত্রটা একই রয়ে গেলো। বলি রোজ রোজ এত ফুল কুড়িয়ে কার জন্য মালা গাঁথিস সখি?
প্রান্তিকা বান্ধবী রেবেকার তাঁকিয়ে বললোÑ
শুধু কি মালা গাঁথার জন্যই আমার এই ফুল কুড়ানো সখি। আমি কেনো রোজ রোজ বকুল কুড়ায়, সে কথা আমি আর ঐ মহাজন ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউই জানেনা সখি। তাহলে আমাকেও বল না তোর এই ফুল কুড়ানোর রহস্যের কথা।
বান্ধবী রেবেকার কথায় মুছকি হাসে প্রান্তিকা। তার মধু মিশানো মিষ্টি সুরে উত্তর দেয়Ñহ্যাঁ বলবো। সময় হলে একদিন সবই তোকে খুলে বলবো। তবে আমার কুড়িয়ে জমানো প্রতিটি বকুলের সাথে একটি করে স্মৃতি জমা রয়েছে।
প্রান্তিকার কথায় অবাক হয় বান্ধবী রেবেকা। নিরব হয়ে ভাবতে থাকে বকুল, কুড়ানো প্রতিটি ফুলের সাথে একটি করে স্মৃতি জড়ানো। এটা আবার কেমন অদ্ভুত কথা। আমার বান্ধবীর কিছু হলো না তো...? নাকি জিন পরীর আঁচর পড়েছে। বান্ধবী প্রান্তিকাকে নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে যায় রেবেকা।
রেবেকার বিস্মিত হওয়া দেখে খিল খিলিয়ে হেসে উঠলো প্রান্তিকা। হাসতে হাসতে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলোÑআমি জানি সখি তুই আমার কথা শুনে অবাক হয়েছিস। ভাবছিস আমি এসব কি বলছি তোকে। তাহলে চল আমার সাথে। ফুল কুড়িয়ে আমি আমার স্বপ্নে সাজানো পৃথিবীটা তোকে দেখাবো। প্রান্তিকার এসব কথায় আরো ভয়ে কেঁপে উঠে রেবেকা। মনে মনে বড় খতমের দোয়া পড়ে বুকের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিলো। তার ভয়টা যাতে কেটে যায়। অনেকটা ভিতু কণ্ঠে প্রান্তিকার উদ্দেশ্য বললোÑতোর স্বপ্নের পৃথিবীটা আরেক দিন দেখবো। আমি এখন যাইরে সখি, মা ডাকছে।
বান্ধবীর কাছ থেকে মিথ্যে অযুহাতে কোন রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে বিদায় নিলো রেবেকা। আর প্রান্তিকা সেই বকুলতলায় বসে তার স্বপ্নের প্রহর গুণে যাচ্ছে।
প্রান্তিকা এবং রেবেকা ছোট বেলা থেকেই একসাথে চলাফেরা করে বড় হয়েছে। এখন তাদের বয়স কুড়ি পেরিয়ে। দুজনই প্রাপ্ত বয়সী যুবতী।
বাড়ির উত্তর কোনে বিশাল একটি বকুল গাছ। এ গাছেই অনেক বকুল ফুল ফুটে, বকুল ঝরে। প্রান্তিকার সেই ছোট বেলা থেকেই বকুল কুড়ানোর ভীষণ শখ। সেগুলো দিয়ে সে সুঁই সুতায় মালা গেঁথে গলায় পড়ে। বকুল কুড়ানোর মাঝে প্রান্তিকার স্বপ্ন মিশে রয়েছে। তাই বকুল ফুটলেই বকুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে প্রান্তিকা। সেই মালা শুকিয়ে গেলে ডায়রির পাতার ভাঁজে স্মৃতি করে রেখে দেয়।
যার জন্য রোজ রোজ বকুল কুঁড়িয়ে মালা গেঁথে রাখে, একদিন হয়তো তার মনের অপ্রকাশ্য ভালোবাসার কথাগুলো তার কাছে প্রকাশ হলে ডায়রির প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে এক এক করে তার ভালোবাসার গভীরতা জানান দিবে তাকে।
সেই ছেলে বেলা থেকেই প্রান্তিকা একটু ভারি স্বভাবের মানুষ। শত কষ্ট হলেও কখনো নিজের কষ্টটা কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। অন্যের ভালোর জন্য নিজের কষ্টটা খুব সহজেই হজম করে নিতে পারে।
স্কুলে নবম শ্রেণির এক গ্রীষ্মের দুপুরে প্রান্তিকার জীবন খানিক বদলে গিয়েছিল। তখন ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়েছিলো একটি ছেলে, অরিত্র। লাজুক, চুপচাপ স্বভাবের, গায়ের রঙে ঝকঝকে কিছু না থাকলেও তার চোখ দুটো ছিলো গভীর আর স্বপ্নময়।
প্রথমদিনেই অরিত্র ক্লাসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলেছিলোÑআমি অরিত্র হাওলদার। বাবা রেলওয়েতে চাকরি করেন। এখানে বদলি হয়ে এসেছি।
প্রান্তিকা জানে না কেনো, সেই মুহূর্তেই তার বুকের গভীরে এক অদ্ভুত ঢেউ উঠেছিল। অরিত্রের চোখে ছিলো এক ধরনের নিরব আত্মবিশ্বাস। তারা ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, তবে কেউ কখনো কারো খুব ঘনিষ্ঠ হয়নি। প্রান্তিকার ভেতরে জমে থাকে অরিত্রকে ঘিরে না বলা হাজারো কথা, অনুভবের জট।
অরিত্র প্রায়ই মাঠে খেলতো, হাসতো, গল্প করতো। কিন্তু প্রান্তিকা দূর থেকে দেখে যেতো। শুধু একবার, বৃষ্টিভেজা এক বিকেলে স্কুলের বারান্দায় অরিত্র ছাতা না পেয়ে ভিজে যাচ্ছিলো, তখন প্রান্তিকা চুপচাপ নিজের ছাতাটা তার হাতে দিয়ে সরে গিয়েছিলো।
সেই দিনের স্মৃতিটা আজও ডায়েরির পাতায় লেখা আছেÑআজ আমি তাকে ছুঁয়ে দিলাম। যদিও সে জানলো না, এই ছোঁয়ার অপেক্ষায় কত বছর ধরে বসে আছি।
এভাবেই প্রায় সময় অরিত্রকে ভেবে ডায়রিতে ভালো লাগার কথা গুলো লিখে রাখেন।
প্রান্তিকার ডায়েরি যেন একান্ত তার প্রেমপত্রের থলে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় বকুল ফুলের শুকনো পাপড়ি সেঁটে আছে, আর তার নিচে লেখা অনুভবের শব্দ।
আজও সে চোখে পড়েনি মালাটা। কালকে আবার একটা রেখে যাবো। হয়তো কখনো একটিবারের জন্য হলেও সে বুঝবে এই মালাগুলো শুধু তার জন্যই।
প্রতিদিন সকালে প্রান্তিকা বকুল ফুল কুড়িয়ে গলায় মালা পরে স্কুলে যেতো। কেউ জানতো না, সেই মালাটা সে পরে রাখে যতক্ষণ না অরিত্রকে একটিবার না দেখে। পরে বাড়ি ফিরে ডায়েরিতে রেখে দিতো সেই মালা, একটি মালা, একটি দিন, একটি দেখা।
ক্লাস টেনের শেষদিকে স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠান হয়। অরিত্র এক গানে গিটার বাজিয়ে অংশ নেয়। সেইদিনই প্রথম প্রান্তিকা নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করেছিলো। গানের মাঝে যখন অরিত্র কারো চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলো, প্রান্তিকা মনে মনে প্রার্থনা করেছিলো, হয়তো ওর হাসিটা আমার জন্যই। হয়তো আজ ও বুঝবে, আমি তাকে ভালোবাসি।
কিন্তু কিছুই হয়নি। সেদিন অরিত্র চলে যায় অন্য শহরের কলেজে ভর্তি হতে। আর প্রান্তিকা পড়ে থাকে স্মৃতির দোলনায়।
পাঁচ বছর কেটে গেছে। প্রান্তিকা এখন একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করে। মুখে হাসি, চোখে নিরবতা। কিন্তু সেই পুরোনো অভ্যাস, বকুল কুড়ানো, মালা গাঁথা, ডায়েরিতে রেখে দেওয়া, সবই চলতে থাকে।
একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরিচিত মুখ দেখে শ্বাস আটকে আসে তার।
প্রান্তিকা? তুই!
প্রান্তিকা থমকে দাঁড়ায়।
অরিত্র...?
হ্যাঁ। আমি এখানে বদলি হয়ে এসেছি। শুনলাম তুই এই কলেজেই পড়াস।
সেদিন দুজন হাঁটতে হাঁটতে একটা বকুল গাছটার নিচে আসে। চারপাশে নিস্তব্ধতা। গাছের নিচে বসে অরিত্র হঠাৎ বলে বসলো
প্রান্তিকা, তুই জানিস? স্কুলে থাকতেই আমি বুঝতাম তুই আমার জন্য কিছু করিস। কিন্তু বলতে পারিনি কিছু। কারণ আমি নিজেও ভয় পেতাম এজন্য যে,
এই ভালোবাসা যদি একপাক্ষিক হয়!
প্রান্তিকার গলায় যেন কথা আটকে যায়। চোখে পানি জমে আসে।
তখন হঠাৎ সে ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে অরিত্রের হাতে দিয়ে বললো-
এইটা তোর জন্য রেখেছি এতদিন। এখন সময় হয়েছে তোকে দেওয়ার।
অরিত্র ডায়েরির পাতাগুলো উল্টায়। প্রতিটি পাতায় একেকটা শুকনো বকুল ফুল, একেকটা তার নামে লেখা অনুভব। সে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর নিচু গলায় বলে, প্রান্তিকা, আজ আমি জানলাম, ভালোবাসা সবসময় বলে দিতে হয় না। কেউ কেউ শুধু অনুভব করেও জীবনের সব অর্থ খুঁজে পায়।
প্রান্তিকা মুখ তুলে তাকায়। এই প্রথমবার, তার অপ্রকাশ্য ভালোবাসা শব্দের রূপ নেয়।
চারপাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বকুলের মৃদু সুবাস। গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো যেন দু’জনের হৃদয়ের মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করে।
একটি সাদা নরম কুড়িয়ে পাওয়া বকুল প্রান্তিকা এগিয়ে দেয় অরিত্রর হাতে।
সে বলে না কিছু, তবুও অরিত্র বুঝে নেয়, এই বকুলই তার উত্তর।
অরিত্র হাত বাড়িয়ে ধরে প্রান্তিকার আঙুল।
প্রান্তিকা চোখ বন্ধ করে, দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহরগুলোর সবটুকু নিঃশ্বাসে মিশিয়ে দেয়, এবার আর কোনো ডায়েরির পৃষ্ঠা নয়, তার ভালোবাসা এখন সশব্দ, দৃশ্যমান, বকুলের মতোই সত্য।
ঝরে পড়া হাজারো বকুলের পাঁপড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে দু’টি আত্মা, একটি প্রেম, দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পরে, অবশেষে পূর্ণতা পায়...।