শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫, ১১:১০

স্নেহের প্রতিদান

আকিব শিকদার
স্নেহের প্রতিদান

জানি, আমার এ ট্রাজেডি কেউ পড়বে না তেমন যত্নে বুকের পাশে রেখে, চোখের কাছে তুলে, হৃদয়ের দরজা খুলে। তবে জানার মাঝেও কিছু অজানা থেকে যায়। সেই অজানার অনিশ্চিত আশায় কলম ধরলাম। আমার এ লেখা কারও মনে যদি এইটুকু দাগ কাটে, তাকে বলবো, তুমি ভাই আমার জীবনকাহিনিটাকে পটভূমি করে একটা গল্প লিখো। তোমার সে শিল্পকর্ম নিশ্চিত বাজার কাটবে। তোমার খ্যাতি কামানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে না।

বিয়ে করেছি আট বছর কেটে যায়, তবু সন্তানের মুখ দেখতে পাচ্ছি না। ডাক্তার-কবিরাজের কাছে গিয়েছি অনেক, কোন ফায়দা হয় না। তারপর গেলাম পীর-বাবার দরবারে সিন্নি নিয়ে। বাবা মাথায় হাত ঠেকিয়ে বললেনÑ‘যা তোর মনবাসনা অতি দ্রুত পূর্ণ হবে’।

সিন্নির বিনিময়েই হোক, আর ডাক্তার-কবিরাজের কেরামতিতেই হোক, বছর না ঘুরতেই পুত্র সন্তানের জনক হলাম। গরিবের সংসারে নতুন মুখ, অভাবের মাঝে অভাব, তবে মনে একটা অজানা আনন্দের শিহরণ। শিক্ষা-দীক্ষার এই যুগে ছেলেকে মূর্খ বানিয়ে রাখলে চলবে না, তাই তাকে ভর্তি করিয়ে দিলাম স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে। খলিল নিয়মিত স্কুলে যায়। লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে তার মাকে বললো, “আম্মা, আমি ফাস্ট হইছি। প্রাইমারি ইস্কুলের লেখাপড়া শেষ, এহন হাই-ইস্কুলে ভর্তি হইতে হইবো। স্যার বলছে বাজান যাতে স্যারের লগে দেখা করে।”

ইংরেজি বুঝি না, তাই ফাস্ট কাকে বলে বুঝতে পারিনি। তবে ছেলের মুখ দেখে বুঝলাম ফাস্ট মানে আনন্দের বিষয়। হেলেনা এসে জানালো- “হুনছেন, ছেরায় কী কয়! ইস্কুলের মাস্টার নাহি আফনেরে দেহা করতে কইছে।”

পরদিন সকাল বেলায় নতুন লুঙ্গিটা পরে, গামছাটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে গেঞ্জির ছিদ্রগুলোকে গামছার আড়ালে ঢেকে গেলাম স্যারের সামনে, “আমরে ডাকছিলাইন নাহি স্যার?”

স্যার স্কুলের মাঠে চেয়ার পেতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন, শীত-সকালের রোদ। “হ্যা নুরু মিয়া। তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। তোমার ছেলে খলিল ভীষণ মেধাবী, হাইস্কুলে ভর্তি করে দাও তাকে। দেখবে ছেলে তোমার একদিন নিশ্চিত বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।”

“স্যার আমি সামান্য গরিব কৃষক। অন্যের জমি চাষ কইরা খাই। আমি কেমনে ছেলেরে পড়া-লেখা শিখাইবো? পড়া-লেখার খরচ চালানো কি আমার দ্বারা সম্ভব!”

“খরচ নিয়ে ভেব না মিয়া” সার আমাকে আশ্বাস দিলেন। স্যারের প্রেরণায় খলিল ভর্তি হল ষষ্ঠ শ্রেণিতে। লেখাপড়ার খরচ যোগাতে কষ্ট হতো ঠিকই, কিন্তু সেই কষ্টের মাঝেও একটা আনন্দের আশা ছিল, ছেলে একদিন সংসারের হাল ধরবে। হাল ধরলো ঠিকই, তবে এমন ভাবে হাল ধরাটা আমি কেন, পৃথিবীর কোন বাবা মা-ই চায় না। একটার পর একটা পাশ দিয়ে ছেলে আমার মফস্যলের লেখাপড়া শেষ করলো। স্পষ্ট মনে আছে, আমার কাছে এসে বলেছিল “বাজান, আমি লেখাপড়া করতে শহরে যাইতে চাই।”

আমিও রাজি হলাম “আচ্ছা যা, মন দিয়ে লেখাপড়া করিস।”

ছেলে তো শহরে গেল না, আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার মায়ের সে কি কান্না! “লেখাপড়া চাই না, আফনে আমার ছেড়ারে বাড়িতে ফিরায়ে আনুইন।”

খলিল শহর থেকে মাসে অন্তত দু-তিনবার বাড়িতে আসত। তার মায়ের আনন্দ সে সময়ে দেখে কে! এই পিঠা, ওই পিঠা, আরও কত কী ব্যবস্থা করতো। দিন যত যেতে থাকলো, খলিলের গ্রামে ফেরার ঝুঁক ততই কমতে লাগল। এক পর্যায়ে তিন-চার মাস পর পর একবার তার মুখ দেখতে পেতাম। একদিন শুনলাম সে তার বাসস্থান পরিবর্তন করেছে। স্থানীয় এক উচ্চবৃত্তের মেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়, সেখানেই তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম । যাক, এইবার সংসারের খরচ কিছুটা কমেছে।

একদিন দেখতে গিয়েছিলাম তাকে। আমার অনাকাক্সিক্ষত উপস্থিতিতে সে এতটাই হতভম্ব হয়ে পড়েছিল যে, মানুষ ভূত দেখলেও এমনটা হয় না। ভাব দেখে বুঝলাম আমার ছেলে তার বাবাকে বাবা ডাকতে কেমন জানি ইতস্থ বোধ করছে।

আমার পরিচয়ের কাছে ছেলেকে ছোট হতে হয়, এই ভেবে সেখান থেকে বিদায় নিলাম অতি দ্রুত। বাড়ি ফিরতেই দেখি হেলেনা কেমন উদ্গ্রীব হয়ে আছে। আমি বাড়ি ফিরবো, ছেলে ফিরোক আর না ফিরোক। আমার কাছে তো অন্তত নাড়িছেঁড়া ধনটার অনেক সংবাদ শুনতে পাবে, “আফনের না আরও এক দিন বাদে ফিরবার কথা! একদিন আগেই ফিইরা আইছেন! আমার খলিল কেমন আছে? তার কোন সমস্যা হয় নাই তো? আফনেরে কেমন যত্ন করছে ছেড়ায়? ছেড়ায় কি আমার কথা ভুইলা গেছে নাকি? বাড়িতে আইতে চায় না কেন?” আরো কত রকম প্রশ্ন।

“আরে, আগে বাড়িতে ফিরতে দাও, তারপরে তো তোমার প্রশ্নের উত্তর দিমু” ঘরের বউয়ের কাছে সংসারের কিছু কিছু বিষয় গোপন রাখতে হয়। হেলেনার সব প্রশ্নের উত্তর সঠিক দেওয়া হয়নি, দেওয়াটা ঠিকও হতো না।

খলিল আমাদের পাশের বাড়ির রতন কাকার কাছে একদিন ফোন করে জানাল, সে বিয়ে করেছে। ওই যে বড়লোকের মেয়ে, যাকে পড়াতো, তাকেই বিয়ে করেছে। প্রেম করে বিয়ে, তাই কাউকে না জানিয়ে কিছুটা গোপনেই হয়ে গেছে মন্ত্রপাঠের কাজটা। খবরটা শুনে খলিলের মা তো প্রায় কেঁদেই ফেলল “বিয়া করবি ভালো কথা, তাই বইলা কাউরে না জানাইয়া এমন চোরের মতন! আরে, তোর মা-বাপ তো এহনও মরে নাই!”

বিয়ের পর অনেকদিন কেটে গেল, বৌমাকে নিয়ে ছেলে একদিনের জন্যও গ্রামের বাড়িতে এল না। একবার প্রস্তাব করেছিলাম, “বউ-মারে লইয়া একবার গ্রামডা দেখাইয়া লইয়া যা বাপ, তোর মায়ে তার ছেড়ার বউয়ের মুখটা একবার দেখতে চায়।”

ছেলে জবাব দিল, “বাবা, তোমাদের বৌমা শহরের মানুষ। গ্রামের নোংরা পরিবেশ তার মোটেও পছন্দ নয়। তাছাড়া গ্রামের কাদা মাটিতে এসে সে করবেটা কি?”

হেলেনা ভাবল ছেলে মায়ের উপর রাগ করতে পারে, তাই বলে মা তো আর ছেলের উপর রাগ করতে পারে না। আমাকে বলল “কই গো হুনছেন! চলেন একবার শহরে যাই। আমার খলিলডারে দেখতে কেমন জানি মন কান্দে।”

মায়ের মন কাঁদে, কিন্তু ছেলের মন তো মোটেও কাঁদে না। একদিন হেলেনাকে নিয়ে উপস্থিত হলাম ছেলের শ্বশুরালয়ে। খলিল তো আমাদের উপস্থিতিতে বিমূর্ষÑ“কি আপদ, এমন দিনে তোমরা আবার শহরে এলে কেন! তোমরা গ্রামের মানুষ, কেন যে শহরে আসো!” কথাগুলো তেমন ধাড়ালো ছিল বলে মনেহয় না, তবুও হেলেনার অন্তরে ছুড়ির মত বিধেছিল।

দেয়ালে একটা তৈলচিত্র টানানো, একজন কৃষক এক আঁটি ধান মাথায় নিয়ে মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছে, আর একজন কৃষাণী ধান গাছ থেকে ধান উৎপাটন করছে। শহুরে ভাষায় একে পেন্টিং বলে। হেলেনার ইচ্ছে হলো ছবিটা একবার ছুঁয়ে দেখতে। “দেহুইন! একটা গিরস্ত বেডা কেমন কইরা মাঠেত্তে ধান লইয়া বাড়ি যাইতাছে।” বলতে বলতে ছবিটার গায়ে হাত দিল মাত্র, অমনি খলিলের বউ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো “কি করছেন! পেইন্টিংটা যে নোংরা হয়ে যাবে! জানেন ছবিটা কত টাকা দিয়ে কেনা?”

হেলেনা চমকে উঠল চিৎকার শুনে। তারপর নরম গলায় বলল “বুঝবার পারি নাই মা, আর ছুইমু না।” বৌমা যত বেগে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিল, তার চেয়ে দ্বিগুন বেগে উপরে উঠে গেল।

“চলইুন আমরা গ্রামে ফিইরা যাই, এইহানে আর এক সেকেন্ডও না।” ছেলের কাছে বিদায় নিয়ে বুড়াবুড়ি বাড়ি ফিরে এলাম। যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে ঠিক ততটুকু ঘৃণাও করা যায়। হেলেনার বুকে ছেলের প্রতি যতটুকু ভালোবাসা ছিল, ঠিক ততটুকু ঘৃনারও জন্ম নিল। এটা ঠিক ঘৃণা নয়, অনুরাগ। খলিলের জন্য হেলেনার যে আগ্রহ ছিল, এই ঘটনার পরে আর কোনদিন সেই আগ্রহের ছাপ আমি দেখতে পাইনি। বছরখানেক পর একদিন খলিল এসেছিল বাড়িতে। ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছে সে, মানে আমি দাদা হয়েছি। হেলেনাও দাদি হয়েছে; কিন্তু তাতে তার উৎকণ্ঠা নেই। পুত্রের আগমনে বাড়িতে যে পিঠা তৈরি হতো, এইবার তার এক তিলও হয়নি।

হেমন্তের ধান মাড়াই শেষে হেলেনাকে বললাম - “হাতের কাজ সাইরা চলো এইবারে নাতিডারে একবার দেইখা আসি।”

সে আমার প্রস্তাবে অসম্মতি জানালো। আমি একা যেতে চাইলাম, তাতেও অনুমতি দিতে রাজি নয়। অচেনাজন বেদনা দিলে সহ্য করা যায়, কিন্তু আপনজনের দেওয়া বেদনা সহ্য করা কঠিন।

ছেলের উপর রাগ করে আর কতক্ষণ টিকা যায়! শেষে আমার যাওয়ার অনুমতি হলো, কিন্তু সে সহযাত্রী হতে নারাজ। কলার পিঠা খলিলের খুব পছন্দের জিনিস ছিল। মনেপড়ে খলিল তখন ছোট, হেলেনা এক হাঁড়ি কলা পিঠা বানিয়েছিল বাপের বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে। খলিল চুরি করে অর্ধেক হাড়ি পিঠা খেয়ে নিল। তার মায়ের সে কি রাগ! শাস্তিস্বরূপ কয়েকটা কানমলা আর দুই বেলা খাবার বন্ধ ছিল খলিলের।

নাতিকে দেখতে যাচ্ছি। হেলেনাই এক হাঁড়ি কলা পিঠা আরও কি কি পিঠাসহ এক জোড়া নারকেল পুটলি বেঁধে দিল আমার সাথে। আমাকে দেখে বৌমা তাদের বাসার চাকরকে ইসারা দিলো “ওই যে এসেছে! ঝুলি বেধে কি এনেছে দেখ তো? ঝুলিটা রান্না ঘরে নিয়ে যা।”

খলিল জিজ্ঞাস করল “বাবা, তুমি কি আজই চলে যাবে? নাকি আজ রাতটা থেকে যেতে চাও?”

প্রশ্ন শুনে আমি নিরব রইলাম। খলিলের কুলে ছিল তার ছেলেটা। শিশুদের স্বভাব একজনের কুল থেকে অন্যজনের কুলে যাওয়া। নাতিটা আমাকে দেখে আমার কুলে আসতে হাত বাড়িয়েছিল। বৌমা ছেলেটাকে আমার কুলে আসতে দিলো না। খলিলকে জিজ্ঞাস করলাম - “বাবা, ছেলের নামটা জানি কি রাখছো?” কী এক আধুনিক নাম শুনালো, যা একদম মনে থাকতে চায় না, এমনকি এখনও মনে আসছে না। নামটা নাকি বৌমার নামের সাথে মিলিয়ে রাখা।

পরদিন ফিরবার পালা। বৌমার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দারোয়ান কে উদ্দেশ্য করে বৌমা বলল “দরজাটা ভাল করে এটে দিও। অনাকাক্সিক্ষত উৎপাত যেন আর কিছুতেই চৌকাঠ ডিঙাতে না পারে।”

আমার ছেলেও ছিল সেখানে। আমার সাথে এলো রাস্তা পর্যন্ত। “বাবা, তোমরা গ্রামের মানুষ। লেখাপড়া শেখনি এক অক্ষরও। এত ঘনঘন শহরে আসার প্রয়োজনটা কী? তাছাড়া ক্ষেতে ফসল তো মোটামুটি এখনও ভালোই হয়।” বলতে বলতে একটা পাঁচশো’ টাকার নোট আমার হাতে গুঁজে দিতে চাইল।

বুকের ভিতর কষ্টটাকে লুকিয়ে রেখে মুখে একটা হাসি এনে বললাম “থাকুক, এইডার আমার দরকার নাই।” তারপর চোখ মুছতে মুছতে চলে এলাম একটা লোকাল বাসে চড়ে।

যে ছেলে আমাকে “বাজান বাজান” বলে ডাকতো, সে এখন এই আমাকেই “বাবা বাবা” বলে ডাকে। শিক্ষার ফলে তার কী পরিবর্তন! নিজে খেটে খুটে যাকে আমি পড়ালেখা শিখিয়েছি, শহরে পাঠিয়েছি, সে-ই আমাকে বলে “তোমরা তো গ্রামের মানুষ, লেখাপড়া শেখনি একদম।” চাষার ছেলে হয়ে গেছে কোটিপতির মেয়ের জামাই, এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।

এইযে পাঠক; তোমাকেই বলছি, তুমি ভাই আমার জীবন কাহিনিটাকে পটভূমি করে একটা গল্প লিখো। তোমার সে শিল্পকর্ম নিশ্চিত বাজার কাটবে। তোমার খ্যাতি কামানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে না।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়