রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৩৮

পোলট্রি শিল্পে বার্ড ফ্লু সংক্রমণ বেড়ে চলেছে : জনস্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ

ড. কবিরুল বাশার
পোলট্রি শিল্পে বার্ড ফ্লু সংক্রমণ বেড়ে চলেছে : জনস্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ

বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ, যা প্রধানত পাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এটি পোলট্রি শিল্পের জন্যে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে এবং কখনো কখনো মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীতে সংক্রমিত হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু সংক্রমণ বেড়ে চলেছে, যা পোলট্রি খামারিদের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্যেও উদ্বেগজনক।

২০২৫ সালের মার্চ মাসে যশোর জেলার একটি মুরগির খামারে বার্ড ফ্লু শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্ত খামারে প্রায় ৩ হাজার ৯৭৮টি মুরগির মধ্যে ১ হাজার ৯০০টি মারা গেছে এবং বাকি মুরগিগুলো সতর্কতামূলকভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। ২০১৮ সালের পর এটিই প্রথম বাংলাদেশে বড়ো আকারে বার্ড ফ্লু সংক্রমণের ঘটনা।

এই সংক্রমণের ফলে পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) সরকারের সহায়তা চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছে এবং খামারিদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বার্ড ফ্লু কী? বার্ড ফ্লু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা এ’ ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট। এটি প্রধানত বন্য এবং গৃহপালিত পাখিদের মধ্যে ছড়ায়। এই ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইন (উপপ্রকার বা ধরণ) রয়েছে, তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক স্ট্রেইন হলো ঐ৫ঘ১ এবং ঐ৭ঘ৯, যা মানুষের জন্যে মারাত্মক হতে পারে।

বার্ড ফ্লুর সংক্রমণের ধরণ বন্য জলচর পাখি (যেমন হাঁস, রাজহাঁস) প্রাকৃতিকভাবে এই ভাইরাসের প্রধান বাহক এবং এদের মাধ্যমে অন্যান্য গৃহপালিত পাখির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। আক্রান্ত পাখির সংস্পর্শে এলে, দূষিত পরিবেশে থাকলে বা সংক্রমিত পাখির মাংস বা ডিম খেলে এই ভাইরাস দ্বারা মানুষও সংক্রমিত হতে পারে। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ সাধারণত বিরল, তবে কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস মিউটেশন হলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়তে পারে।

বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু বিস্তারের কারণ

১. অপরিকল্পিত পোলট্রি খামার বৃদ্ধি

বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে পোলট্রি শিল্প দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে ওঠা পোলট্রি খামারগুলোর অধিকাংশেরই পর্যাপ্ত জীবাণুমুক্তকরণ ব্যবস্থা নেই।

অনেক খামারেই বিশুদ্ধ পানি, নিরাপদ খাদ্য এবং পর্যাপ্ত জায়গার অভাব রয়েছে। খামারে অসচেতনভাবে খোলামেলা পরিবেশে হাঁস-মুরগি পালন করা হয়, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। বার্ড ফ্লু ভাইরাস মুরগির মলমূত্র, বাতাস ও সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। তাই অপরিকল্পিত খামারের কারণে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

২. খামার ও বাজারে পরিচ্ছন্নতার অভাব বাংলাদেশের পোলট্রি বাজারে জীবন্ত পাখি বিক্রির প্রচলন রয়েছে, যা সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ। বাজারে পাখির মলমূত্র, পালক ও বর্জ্য জমে থাকে, যা ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির জন্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্তকরণ না করায় ভাইরাস দীর্ঘ সময় টিকে থাকে এবং মানুষের সংস্পর্শে আসে। বাজারে মৃত পাখি যথাযথভাবে অপসারণ করা হয় না, ফলে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

৩. বন্য পাখির মাধ্যমে সংক্রমণ বিশেষ করে পরিযায়ী পাখির মাধ্যমে বার্ড ফ্লু’র ভাইরাস প্রাকৃতিক জলাভূমি থেকে খামারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশে শীতকালে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে, যা বার্ড ফ্লু’র ভাইরাস বহন করতে পারে। খোলা জায়গায় হাঁস-মুরগি পালন করলে পরিযায়ী পাখিদের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা থাকে। সংক্রমিত বন্য পাখির মলমূত্র, লালা, পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে খামারের মুরগিদের সংক্রমিত করতে পারে।

৪. অসচেতনতা ও নজরদারির অভাব বার্ড ফ্লু প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব ও পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবও ভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম কারণ। অনেক খামারি বার্ড ফ্লু’র লক্ষ্মণ চিহ্নিত করতে পারেন না, ফলে সংক্রমিত মুরগিগুলো বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। কিছু খামারি বা ব্যবসায়ী ক্ষতির আশঙ্কায় সংক্রমিত পোলট্রির খবর গোপন রাখেন। সরকারিভাবে বার্ড ফ্লু নজরদারির জন্যে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

বার্ড ফ্লু’র লক্ষণ ও ঝুঁকি,

পাখির মধ্যে বার্ড ফ্লুর লক্ষণ

* আকস্মিক মৃত্যু

* খাওয়ার প্রতি অনীহা

* মাথা ও ঘাড় ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট

* ডিম উৎপাদন কমে যাওয়া

মানুষের মধ্যে বার্ড ফ্লুর লক্ষণ

* উচ্চ মাত্রার জ্বর

* শ্বাসকষ্ট ও কাশি

* পেশি ও গাঁটে ব্যথা

* বমি বা ডায়রিয়া

* মারাত্মক ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু

বার্ড ফ্লু নিয়ন্ত্রণে করণীয়

বার্ড ফ্লু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার, পোলট্রি শিল্প, খামার মালিক এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

১. পোলট্রি খাতের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

খামারে বায়োসিকিউরিটি (ইরড়ংবপঁৎরঃু) নিশ্চিত করা। খামারে প্রবেশের আগে জীবাণুমুক্ত পোশাক ও মাস্ক পরা। মুরগির খাবার ও পানি নিরাপদ রাখা। খামারের চারপাশ পরিষ্কার রাখা।

বন্য পাখি প্রতিরোধ করা। খামার এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে বন্য পাখি ঢুকতে না পারে। খোলা জায়গায় পোলট্রি পালন না করা।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকা প্রয়োগ। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পোলট্রি খামারগুলোয় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালানো উচিত। বার্ড ফ্লু’র প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

সংক্রমিত পাখি দ্রুত ধ্বংস করা। যেসব খামারে সংক্রমণ ধরা পড়ে, সেসব স্থানে আক্রান্ত মুরগি ও ডিম নিরাপদ পদ্ধতিতে ধ্বংস করতে হবে।

২. বাজার ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন

জীবন্ত মুরগির বাজার ব্যবস্থাপনা বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বাজারের মেঝে প্রতিদিন জীবাণুমুক্ত করতে হবে। সংক্রমিত এলাকায় জীবন্ত মুরগি বিক্রি নিষিদ্ধ করা উচিত। পোলট্রি পণ্যের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ভালোভাবে সিদ্ধ বা রান্না করা মুরগির মাংস ও ডিম খাওয়া নিরাপদ। তাই কোনোভাবেই হাফ বয়েল ডিম বা অল্প রান্না করা মুরগির মাংস খাওয়া যাবে না। কাঁচা মাংস বা ডিম ধোয়ার পর হাত ভালোভাবে ধুতে হবে।

৩. সরকারের ভূমিকা ও নীতিগত ব্যবস্থা

বার্ড ফ্লু সংক্রমণ নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করা প্রয়োজন। বার্ড ফ্লু সংক্রমণের হার পর্যবেক্ষণ করতে জাতীয় পর্যায়ে নজরদারি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশে সংক্রমিত নতুন ভাইরাস স্ট্রেইনের ওপর গবেষণা চালিয়ে উন্নত প্রতিষেধক টিকা তৈরি করা প্রয়োজন।

যে কোনো খাবারে সংক্রমণ ধরা পড়লে দ্রুত তা নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে, যাতে ওই খামার থেকে অন্য কোনো নতুন খামার আক্রান্ত হতে না পারে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে খামারিদের জন্যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ)-র সঙ্গে সমন্বয় করে বার্ড ফ্লু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বার্ড ফ্লু বাংলাদেশের জন্যে একটি বড়ো স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পোলট্রি খাতে বায়োসিকিউরিটি, সচেতনতা বৃদ্ধি, টিকা প্রয়োগ, বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং সরকারি নজরদারি বৃদ্ধি করলে বার্ড ফ্লু’র প্রভাব কমানো সম্ভব।

জনসচেতনতা ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে বাংলাদেশ বার্ড ফ্লুর ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে পারে, যা স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়