প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫, ১৫:১২
বৃষ্টি ভেজা সেই দিন

আজ সারাদিন অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ইচ্ছা করছে না ইশরাতের। অলস দুপুরে মা খিচুড়ি আর ডিম ভাজা নিয়ে ব্যস্ত। মায়ের ব্যস্ততা শেষে মায়ের সঙ্গে পেটপুরে খেয়ে একটি গল্পের বই নিয়ে বসে গেল ইশরাত। জানালার ধারে সাজানো টেবিল। অনেক প্রিয় এই জায়গাটা তার। এখান থেকে বাগানের দৃশ্যটা চোখে পড়ে। অসম্ভব সুন্দর সময় কাটে এখানে। অবিরাম বৃষ্টির জলে গাছগুলো কেমন সতেজ, সবুজ হয়ে উঠেছে। জলের ধারা নিচু স্থানগুলো পূরণ করছে। পুকুরে জলবিন্দু কী সুন্দর বৃত্তের আকার ধারণ করছে। এমন মনোরম চারপাশ দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল মন। আচমকা ভাবনায় ছেদ পড়ল। মনে পড়ল আজই বান্ধবী স্বপ্নার বিয়ের দিন। সন্ধ্যায় কমিউনিটি সেন্টারে তাদের সব বন্ধুর উপস্থিত থাকতেই হবে। ভোর থেকে বৃষ্টি অঝোরে ঝরছে। দুপুরে একটু থেমে থেমে আসছে। বিকেলে বৃষ্টি থামলেও আকাশের মুখ ভার হয়ে আছে। এমন আবহাওয়া উপেক্ষা করে ইশরাত হালকা সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ল ছাতা নিয়ে।
কমিউনিটি সেন্টারে এসে বন্ধুদের আর কাউকে দেখতে পেল না সে। ভীষণ অবাক হয়ে গেল। একটু দূরেই ছিল স্বপ্না ও তার আত্মীয়স্বজনের কয়েকজন। স্বপ্নাকে বিষণ্ন লাগছে। মুখ ভার। জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পেল না। এমন হওয়ার তো কথা ছিল না। বন্ধুদের সবার কাছ থেকে স্বপ্না প্রতিশ্রুতি নিয়েছে বিয়ের আসরে সবাই থাকবে। ইশরাত ছাড়া কেউ আসেনি। একজন পেলেও নিঃসঙ্গতা কিছুটা লাঘব হতো। এতগুলো অপরিচিত মুখের ভিড়ে নিজের কাছে নিজেকেই কেমন তুচ্ছ ঠেকছে। একজন সবজান্তার মতো খাতা-পেন নিয়ে গভীর মনোযোগে অঙ্ক কষার মতো অনেকক্ষণ তাকে নিরীক্ষণ করছে। মানুষটা কি তাকে কিছু বলতে চাইছে?
আপনার ছাতাটা দিয়ে আমাকে একটু গাড়ি ধরিয়ে দেবেন? আমাকে এক্ষুনি হাসপাতালে পেঁৗছাতে হবে। খবর এসেছে ইমার্জেন্সিতে রোগী ভর্তি হয়েছে।
ও তার মানে আপনি ডাক্তার!
হ্যঁা।
ডাক্তার ইশরাতের সঙ্গেই হঁাটছে তার ছাতায়। দু’জনেই ভিজছে জলের ছিঁটেতে। ডাক্তারকে পেঁৗছে দিল। ছাতাটাও সঙ্গে দিয়ে দিল। ছাতাটা ডাক্তারকে দিয়ে ইশরাত ভিজে ভিজে বাড়ি এলো।
জ্বর-সর্দিতে ১০ দিন ভুগল। শ্বাসকষ্টের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো তাকে। যুবক ডাক্তার হাসিমুখে সব ধরনের সেবা দিতে লাগল। এক ফঁাকে এসে বলল, ভাগ্যিস সেদিন আপনার কাছ থেকে ছাতাটা পেয়েছিলাম। কিন্তু কোনোদিন আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে ভাবিনি। এই শহর খুবই ছোট, অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবে আপনার ছাতাটা যত্ন করে রেখেছি।
হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় যুবক ডাক্তার এগিয়ে এসে ছাতা হাতে ধরিয়ে দিল। তার পর স্মিথ হেসে বলল, আমি রোমান।
ইশরাত ছাতাটি নিয়ে বাড়ির পথে এগোলো। ছাতাটির সঙ্গে ডাক্তারের একটি চিরকুটÑধন্যবাদ! সেদিনের বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা সারাজীবন মনে থাকবে। আমরা দু’জন কি একই ছাদের নিচে থেকে এই স্মৃতি ধরে রাখতে পারি না?
ইশরাত মনে মনে হেসে উঠল। কী অদ্ভুত অনুভূতি তার ভেতরেও আবেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ছবি-২০
হাসপাতালের দুপুর
শাহ্ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
মধ্যরাত। ফোনের বিদঘুটে রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। আধখোলা চোখে ফোনের দিকে তাকাতেই হার্টবিট বেড়ে গেল। স্ক্রিনে মায়ের নাম ভাসছে। রাত ১০টার পরপর মা কখনো ফোন দেন না। একবার দিয়েছিলেন মধ্যরাতে। প্রিয়জন বিয়োগের দুঃসংবাদ দেওয়ার জন্যই দিয়েছিলেন সেদিন অসময়ে ফোন। আরও কয়েকবার ভিন্ন মানুষের কাছ থেকে মধ্যরাতে ফোন পেয়েছিলাম। সব কটি ছিল দুঃসংবাদের; যা আমার কাছে একেকটা দুঃস্বপ্নের মতো।
এসব ভাবতে ভাবতে রিসিভ করার আগেই কলটা কেটে গেল। কালবিলম্ব না হতেই আবারও কল আসল। রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে শুনলাম মৃদু আর্তনাদ। বেশ কয়েক দিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট ভাই রোহানের অবস্থার অবনতি হয়েছে। শিগগিরই অপারেশন না করলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আজ রাতে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। দ্রুত হাসপাতালে ডাকল মা। আমি গেলে কিছুটা মানসিক শক্তি বাড়বে।
একদিকে সেমিস্টার ফাইনালের সময় ঘনিয়ে এসেছে, ওদিকে ছোট ভাইয়ের এই অবস্থা; কীভাবে কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাকি রাত আর ঘুম হলো না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম। সকালে উঠে কোনো কিছু না ভেবেই রওনা দিলাম হাসপাতালের উদ্দেশে। অনেক দূরের পথ। গন্তব্য রাজশাহী থেকে ঢাকার একটি বড় হাসপাতালে। দুপুরের পরে হাসপাতালে পেঁৗছালাম। সোজা গেলাম কেবিনে। ছোট ভাই বন্ধ চোখে বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। পাশে অশ্রুসিক্ত নয়নে মা বসা। বারান্দায় বাবা বিষণ্ন মনে দঁাড়ানো। আমাকে দেখে মায়ের মুখে স্ফীত হাসি। বাবার চেহারায় তেমন পরিবর্তন লক্ষ করলাম না। ২০ দিন ধরে হাসপাতালে থাকায় সবার শরীরেই একটা বিষণ্নতা ও ভঙ্গুরতার ছাপ স্পষ্ট। ছোট ভাইয়ের হাত ধরে কিছুটা সময় বসে থেকে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। আপন ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের অসুস্থতায় বিভিন্ন সময় হাসপাতালে যাওয়া হয়।
হাসপাতালে আসলে রোগীদের কষ্টের চিত্র দেখে মন খারাপ হলেও নিজে সুস্থ থাকায় স্রষ্টার প্রতি নতশির হই বারবার। কিছুক্ষণ আগে পাশের কেবিনে আমার বয়সী একজন না ফেরার দেশে চলে গেছে। স্বজনদের আর্তনাদে আকাশ ভারী। ছেলেটার মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ইচ্ছা করছে কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দিই। পরক্ষণে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। আমার কাছে সান্ত্বনার অপর নাম কঁাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া। তবু মানুষ দুঃসময়ে সান্ত্বনা দেয়। ভুক্তভোগীরাও সান্ত্বনা পেতে চায়। আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় হলেও মানুষ সান্ত্বনা পুঁজি করেই ভালো থাকার চেষ্টা করে। বঁাচতে চায়।
কেবিন থেকে বের হয়ে হাসপাতালের মাঠে গেলাম। সেখানেও প্রিয়জন হারানো একদল স্বজনের দেখা পেলাম। অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ তোলা হয়েছে। মধ্যবয়সী এক লোক ফোন করে কাকে যেন কী বলছে আর চিৎকার করে কান্না করছে। মনে হয় মৃতের স্বজন। লোকটার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। পৃথিবীর অসুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি হলো পুরুষ মানুষের চিৎকার করে কান্না। পুরুষ মানুষ সহজে কঁাদে না। যখন কঁাদে তখন এই কান্নার পেছনে থাকে কোনো হৃদয়বিদারক দৃশ্যপট।
এবারও আমার চোখে জল চলে এসেছে। ঝাপসা দেখছি সবকিছু। এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। এখানে আর এক মুহূর্তও দঁাড়াতে ইচ্ছা করল না। চলে গেলাম হাসপাতালের লবিতে। বসে মোবাইল স্ক্রল করছি, এমন সময় হাসিমুখে এক যুবক একটা মিষ্টি এগিয়ে দিলেন। মিষ্টি বিতরণের কারণ জানতে চাইলে বলল কিছুক্ষণ আগে তিনি পুত্রসন্তানের পিতা হয়েছেন। আমি মিষ্টি খাই না। কিন্তু আজকে কেন জানি খুব আনন্দ করে মিষ্টি খেলাম। লোকটার সঙ্গী হয়ে লবিতে বসা সবার মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করলাম। লোকটার খুশি দেখে আমারও খুশি লাগছে। কখন যে খুশিতে চোখে জল চলে আসছে বুঝতে পারিনি। লোকটা আমার দিকে তাকাতেই বিব্রত হয়ে সেখান থেকে কেটে পড়লাম।
হঁাটতে হঁাটতে চলে আসি কাউন্টারের কাছে। নিচতলায় রিসিপশনের পাশেই কাউন্টার। কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন। দুয়েকজনের সঙ্গে আগবাড়িয়ে কথা বললাম। জানলাম, লাইনে দঁাড়ানো প্রায় সবাই রিলিজ হওয়া রোগীদের স্বজন। হাসপাতালের টাকা মিটিয়ে চলে যাবে বাড়িতে। সবার মুখেই হাসির ছাপ। কী অদ্ভুত এক জায়গা হাসপাতাল! একদিকে হাসি, একদিকে কান্না। একদিনে উল্লাসধ্বনি, আরেক দিনে বিষাদের হৃদয়বিদারক আয়োজন সমতালে চলছে।