প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:০৫
স্বপ্ন বিক্রির বিজ্ঞপ্তি
![স্বপ্ন বিক্রির বিজ্ঞপ্তি](/assets/news_photos/2025/02/08/image-58745-1738991194bdjournal.jpg)
‘আপনারা এখানে একটু অপেক্ষা করেন। স্যার আসুক। বিষয়টা ফাইনাল করে যান। প্রতিদিন কষ্ট করে না এসে একটা দিন কষ্ট করেন।’ মিষ্টভাষী লোকটার কথায় ভাবনায় পড়ল তিনজনের দলটা। দলের সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষ দলটাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘প্রস্তাবটা মন্দ না। কী করবা? চলো বসি।’
চকচকে অফিস। ঝকঝকে মেঝে। টাইলস লাগানো মেঝেতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। কোথাও এতটুকু ময়লা নেই। সবকিছু বেশ পরিপাটি। খুব গোছানো অফিস। সারি সারি টবে নানা জাতের গাছ। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কাচঘেরা উঁচু দালানটায় দঁাড়ালে নিচের সবকিছু খেলনা মনে হয়।
‘নিন, চা খান। স্যার রওনা দিয়েছেন। চলে আসবেন।’ পরিপাটি পোশাক পরা সদ্য কৈশোর পেরোনো পিয়নটাকে তিন জোড়া চোখ দেখল ভাবলেশহীনভাবে। সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পিয়নটি আবারও বলতে শুরু করল, ‘চিন্তা করবেন না। দাম ভালোই পাবেন। কোনো ফঁাকি নাই। এখন নিশ্চিন্ত মনে চা খান।’
‘হামিদ ভাই, কী বুঝলেন?’ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্ন করল একজন।
‘এদের ব্যবহার তো ভালোই, সামসু। মনে হয় না টাকা নিয়া কোনো গন্ডগোল করব।’
‘নিজের কলিজাটা ছিঁড়া দিতাছি। বুকের ভেতর কেমন যে করে, হেইডা হেরা কি বুঝব?’ মধ্যবয়সী হারুনের কথায় হামিদ আর সামসুর বুকের ভেতর তুষের আগুন জ্বলে উঠল।
সত্যি তো! তিল তিল করে জমানো স্বপ্ন বিক্রি করতে এসেছে। ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে।
নিজের জমি হবে! এই আশায় কত সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল। হামিদ, সামসু, হারুন একই অফিসে চাকরি করে। সম্পর্কটা সহকর্মীর হলেও একে অপরের সহমর্মী বটে। হামিদ, সামসু আর হারুনের চেয়ে বয়সে বড় ও অভিজ্ঞতায় পূর্ণ একজন মানুষ। সামসু আর হারুন তাকে বেশ সম্মান করে। সামসু শান্ত মানুষ। হারুন ঠিক তার উল্টো। রাগ উঠতে সময় লাগে না। আবার রাগ কমতেও সময় নেয় না। ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ।
‘ভাই, কত স্বপ্ন আছিল। বউটার সোনাদানা বেচলাম। টিনের ছোট ঘর কইরা থাকুম। আশপাশে আপনারা থাকবেন। বিপদে-আপদে দৌড়াইয়া যামু। আপনারাও আইবেন। সব শেষ।’ বুকের ভেতরের কষ্টে হারুনের গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। হামিদ আর সামসুর হৃদয়ও ব্যথায় ভরে গেল।
মাথা গেঁাজার জায়গার খেঁাজে তিনজন মিলে প্রতি ছুটির দিন এখানে-সেখানে ছুটেছে। কত দুপুর শুধু শিঙাড়া খেয়েই কাটিয়েছে! রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে খুঁজেছে সাধ্যের মধ্যে কেনার মতো জমি। একবার একটা জমি খুব পছন্দ হলো। কিন্তু জমির মালিক চড়া দাম চাইল। অনেক চেষ্টা করেছিল। জমির মালিক টাকার অঙ্ক খুব একটা কমায়নি। তাই জমিটা তাদের আর কেনা হলো না।
এত বড় পৃথিবীতে সেদিন নিজেদের খুব নগণ্য মনে হয়েছিল। মনে হলো যাযাবরদের মতো এখানে-সেখানে ঘুরতে ঘুরতে জীবনের ইতি টানার নিয়তি মানতে হবে। অনেক ঘুরে ঘুরে অবশেষে একটা জমি পছন্দ হলো। এবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। দরদামে সন্তুষ্টি মেলায় এক শুভ দিনে ২০ কাঠা জমির বায়না দিল তিনজনে।
হামিদ নিল ১০ কাঠা। সামসু আর হারুন নিল ৫ কাঠা করে। ১০ কাঠা জমি যেদিন রেজিস্ট্রি হলো, হামিদের নিজেকে রাজা রাজা লাগল। বুকের ভেতর স্বপ্নরা বাসা বঁাধতে শুরু করল। একটা পুকুর, একটা খামার, দুটি গরু আর পাকা একটা বাড়ি। চাকরি শেষ; নতুন জীবন শুরু। পুকুরে মাছের চাষ হবে; খামারভরা হঁাস–মুরগি; দুবেলা গরুর দুধ। পরিপূর্ণ গৃহস্থবাড়ি। ফেলে আসা শৈশব আবার ফিরবে। ভালো খাবে; খাওয়াবে। ভালো থাকবে। জমিটা কেনার পর চাকরি থেকে অবসরের কথা ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে যায়। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবে, আর মাত্র কটা দিন। নিজের ঘর হবে। মধুময় জীবন হবে। নানা স্বপ্নরা ভিড় করে। বিবর্ণ জীবনটা রঙিন হতে শুরু করল। বেঁচে থাকাটা আরও অর্থপূর্ণ হলো।
নদীভাঙনে সামসু নিঃস্ব হয়েছে অনেক আগেই। ঈদ কিংবা লম্বা ছুটিতে সবাই বাড়ি যেতে ব্যস্ত। সামসুর বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠত। ঠিকানাবিহীন সামসু কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে এই শহরে এল ৩০ বছর আগে। নানা কাজ করে অবশেষে এই চাকরি জুটল। খেয়েপরে বঁাচার ব্যবস্থা হলো। জমিটা যেদিন রেজিস্ট্রি হলো, সেদিন বাসায় মিষ্টি নিয়ে সামসু বউকে বলে, ‘আমার জমিটাতে একটা ঘর বানাব। এবার নদী আমার ঘর ভাঙতে পারবে না।’ নিজের একটা ঘরের আশায় খরচ কমিয়ে জমানোতে মনোযোগী হলো।
আর হারুন। তার খুশির সীমা নেই। অফিসের সবাইকে বলে বেড়াল, ‘জমি কিনছি! জমি কিনছি! ঘর উঠামু। মিলাদ দিমু। বন্ধের দিন মিলাদ পড়ামু। আপনারা সবাই যাইবেন।’
প্রায়ই প্রতি সপ্তাহে তিনজনই আসে জমি দেখতে। জমি তো নয়, যেন তাদের অস্থিমজ্জা দিয়ে তৈরি যক্ষের ধন। ঝিনুকের বুকে লুকিয়ে থাকা মুক্তা। কোনো কারণে আসতে না পারলে বুকটা কেমন যেন খচখচ করে। ভালো ঘুম হয় না। জমিতে দঁাড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাস না নিলে অক্সিজেনের ঘাটতি পড়ে। জমির ওপর বয়ে যাওয়া বাতাসকেও মনে হয় ‘আমার! শুধুই আমার!’
কথায় বলে, সুখ বেশি দিন কপালে সয় না। একদিন হঠাৎ করে জানল কোনো এক ধনবান আশপাশের সব জমি কিনে নিচ্ছে। হামিদ, সামসু আর হারুনও বিক্রির প্রস্তাব পেল। সঙ্গে সঙ্গেই তারা ‘না’ করে দিল। দুই সপ্তাহ পর আবারও জমি বিক্রির প্রস্তাব এল। তিনজনই বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আমরা জমি বেচব না। এখানে ঘরবাড়ি করব। থাকব।’
‘এত শব্দের মধ্যে থাকতে পারবেন?’ স্মার্ট যুবকের প্রশ্নে তিনজনই অবাক।
মানুষকে বুঝিয়ে জমি বিক্রিতে রাজি করানোর ভার নিয়েছে এক স্মার্ট যুবক। কৌশলী যুবকের কৌশলের অভাব নেই। তিনজনের হতবাক চেহারা তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করেছে।
‘দেখুন, আমরা এখানে একটা ফ্যাক্টরি করব। অনেক লোক কাজ করবে। দিন-রাত মেশিন চলবে। ফ্যাক্টরির বজর্য পড়বে আশপাশের জমিতে। ফ্যাক্টরির ধার ঘেঁষে আপনাদের বাড়ি হবে। চারদিকে নোংরা বজর্য আর এত শব্দের মধ্যে থাকবেন কীভাবে?’ স্মার্ট যুবকের স্মার্ট যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তিনজনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
আশপাশে খেঁাজ নিয়ে জানল যে বাপ-দাদার ভিটেমাটি বিক্রি করে দিচ্ছে স্থানীয় লোকজন। কেউ কেউ বলল, ‘সময় থাকতে কাম করতে হইব। শেষে আমছালা দুইটাই যাইব।’
‘মানে?’ হামিদের প্রশ্ন।
‘ধনী মানুষ। ফ্যাক্টরি করব। জমি না বেচলে জোর কইরা নিব।’
বুকভরা শঙ্কা নিয়ে ঘরে এল। তিল তিল করে গড়া স্বপ্নে আঘাত পেয়ে তিনটা মানুষের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। তবু একটু আশার ঝলক স্বপ্নটাকে বঁাচানোর চেষ্টা করছে। চারদিকে আবর্জনার স্তূপ থাকুক; ঘট ঘট শব্দের মাদল বাজুক দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা; তবু ‘আমার জমি; আমার ঘর’। ‘আমার’ শব্দটার শক্তি অনেক বেশি। এই শব্দ মানুষকে মুহূর্তেই শক্তিশালী করে, স্বার্থপর করে। ‘আমার’ শব্দটার জন্য মানুষ পারে না, এমন কাজ পৃথিবীতে আজও তৈরি হয়নি।
তিন দিন পর। অফিসে এক স্মার্ট তরুণকে দেখে চমকে গেল হামিদ, সামসু আর হারুন।
‘একটু বিরক্ত করতে এলাম।’ হাসিমুখে স্মার্ট তরুণের বিনয়। ‘স্থানীয় লোকেরাই তাদের জমি বিক্রি করে দিল। আপনারা জেদ করছেন কেন? আমি কথা দিচ্ছি, স্যারকে বলে আপনাদের কাঠাপ্রতি আরও বেশি দেব।’
‘টাকার দরকার নাই। আমরা থাকুম কই? আমাগো থাকার জায়গা দেন। ঘর দেন। জমি দিয়া দিমু।’ হারুনের ঝঁাজাল কথায় স্মার্ট তরুণ স্মার্ট হাসি উপহার দিল।
‘রাগ না করে ঠান্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখুন। ফ্যাক্টরির কাজ শুরু হলে মত বদলালে লাভ হবে না। আপনারা বিক্রি করতে চাইলেও আমরা জমি নিতে পারব না। অন্য কেউ এই জমি কিনতে চাইবে না। আমাদের স্যার খুব ভালো মানুষ। তিনি চান না কারও ক্ষতি হোক। আপনারা নিজের ভালো না বুঝলে আমাদের করার কিছু নাই।’ খুব মিষ্টি করে কষ্টের ছুরি বুকে বিঁধিয়ে তরুণটি চলে গেল।
হামিদের সারা রাত ঘুম হলো না। গ্রামের জমি বিক্রি করে, জমানো সঞ্চয় ভেঙে জমিটা কিনেছিল। স্পষ্ট বুঝেছে জমিটা বেহাত হবেই। সব হারিয়ে শূন্য হাতে বিধাতাকে দোষারোপ করাই কি নিয়তি হবে?
দুপুরে সহকর্মী দুজনকে ডেকে নিজের আশঙ্কার কথা জানাতেই সামসু মত দিল, ‘ভাই, আমারও একই ভয় লাগে। যাগো বাপ-দাদার ভিটামাটি, তারাই বেইচা দিল? আমরা টিকুম কেমনে?’
‘চলেন, জমিটা বেইচাই দিই। ঝামেলা শেষ।’ রাগে কঁাপছে হারুন।
‘আবার আমরা জমি খুঁজব। এত বড় দুনিয়ার কোথাও না কোথাও একটা ঠিকানা হবে।’ হামিদের সান্ত্বনা হারুনের চোখে পানি এনে দিল।
‘স্যার আপনাদের ডাকছেন।’ চমকে হামিদ পিয়নটার দিকে তাকাল।
ভুলেই গেছে আলিশান দালানের শীতল বাতাসে বসে অপেক্ষা করছে স্বপ্ন বিক্রির জন্য।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভালো দাম পেল। যে দামে কিনেছিল, তার চেয়ে দ্বিগুণ দামে জমিটা বিক্রি হলো। এই দ্বিগুণ লাভ তিনটা মানুষের হৃদয়কে খুশি করতে পারেনি। জমি বিক্রির পর হারুন চিৎকার করে শিশুর মতো কঁাদল। হামিদ, সামসুর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে প্রতি রাতে। যে চোখ স্বপ্ন দেখায় বিভোর ছিল, আজ সেই চোখ স্বপ্ন ভাঙার কষ্টে ভিজে যায়।
কষ্টের সময়টা অনেক লম্বা। সময়ের ঘড়ি এখানে এসে থেমে যায়। প্রায়ই জমিটাকে স্বপ্নে দেখে তিনজন। জমির ওপর বয়ে যাওয়া বাতাস বুকে ছুঁয়ে যায়। জমির ছোট ছোট ঘাস পায়ে আলতো করে স্পর্শ করে।
হারুনকে জমিটা চুম্বকের মতো টানে। মায়ার টানে এক ছুটির দিনে হারুন ছুটল একটিবার দেখার আশায়। বিক্রি করা জমি চোখ দিয়ে দেখতেও মানা, এমন কোনো নিষেধ করে, এমন কোথাও নেই।
‘একি!’ অবাক হারুন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। চারদিকে বালু আর বালু। বিশাল এলাকাজুড়ে বালুর রাজত্ব। সামনে বিশাল সাইনবোর্ড। আর তাতে বড় বড় করে লেখা, ‘প্লট বিক্রি হবে’।