রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৭

জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান

আকিব শিকদার
জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান

লেখালেখির সাথে মুহাম্মদ শামীম রেজার সম্পর্ক প্রায় দুই যুগের। ছড়া দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও মূলত গল্পই তার আরাধ্য। গল্পের গঠনশৈলী, উপস্থাপন ভঙ্গি, সমকালীন ভাষা ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে নিরীক্ষণ করছেন বহুদিন ধরে। প্রায় বিশ বছরের ফসল তার ‘জেগে থাকো পূর্ণিমা’ বইটি পড়লে এ বিষয়ে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর গল্পগুলো বাস্তব থেকে নেয়া। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বা আশপাশের মানুষদের জীবন চিত্র তিনি চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কলমের আঁচড়ে। পাঠক ধরে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তাঁর গল্পে, আছে টানটান উত্তেজনা। আছে রহস্য, যুক্তি দিয়ে রহস্য উদ্ঘাটন। গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে চমৎকার সব উপমা আর চিত্রকল্পের ব্যবহার। কখনো কখনো গল্পের ছলে কিছু শিক্ষণীয় উপদেশ দিয়ে গেছেন লেখক, পাঠকের কাছে যেগুলো খুবই গুরুত্ব পাবে বলে আশারাখি।

জেগে থাকো পূর্ণিমা বইয়ের প্রথম গল্প বাঁশি। গল্পের কাহিনি অনেকটা এরকম। ফয়সালের বাঁশির সুর শুনে পাগল হয়ে মধ্যরাতে চেয়ারম্যানের মেয়ে পড়শী নদী পার হয়ে চলে আসে। ফয়সাল তাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। পরী মনে করে। পড়শী ফয়সালকে বাঁশি বাজাতে বলে। পড়শীর বাবা আতর আলী গ্রামের মানুষদের সমস্যার সমাধান করে, বিচার-সালিসের সঠিক বিচার করে। তিনি গ্রামবাসী ছেলে মেয়েদের গোপন প্রেমের ব্যাপারে সুষ্ঠু সমাধান করেন। কিন্তু নিজের মেয়ের প্রেমের খবর জানতে পেরে মেয়ের প্রেমিক ফয়সালকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। ফয়সালকে শক্ত করে বেঁধে মদের বোতলে গরম পানি ভরে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে চেয়ারম্যানের চাকরেরা। ফয়সালের মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা, তার চিৎকার বাহিরের কেউ শুনতে পায় না। তিনজন চাকর মারতে মারতে ক্লান্ত হলে চেয়ারম্যানের বউ মারতে এসে মাথায় বোতল দিয়ে আঘাত করে। অমানবিক নির্যাতনে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া ফয়সালকে চেয়ারম্যানের চামচা আনুমিয়া গরু চোর বলে চালানোর কৌশল করে। ফয়সালের কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে মনিবের বিপদ বোঝাতে চাইলে চেয়ারম্যান কুকুরটিকে গুলি করে মেরে ফেলে। পরদিন গ্রামের লোকেরা ফয়সালকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। গ্রামের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান এর নিষ্ঠুরতার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে গল্পটিতে।

নির্বাচন কমিশনে চাকরি হওয়ার পর আহাদের বাবা চেয়েছিল ছেলের পোস্টিং হোক নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে। কিন্তু তার শ্বশুর ইউনুস চাইলো তাদের এলাকা অর্থাৎ গাজীপুরে চাকরি করুক মেয়ের জামাই। তাই ইউনুছ সাহেব আহাদের পোস্টিং কিশোরগঞ্জ থেকে পাল্টে গাজীপুরে করার ব্যবস্থা করেন। এতে আহাদের বাবার মন খারাপ। তিনি ভাবছেন তার ছেলেটা আগে তার প্রতি কতো টান অনুভব করতো। বিয়ের পর যেন বদলে গেছে। শ্বশুরের ইচ্ছাতেই আহাদ গাজীপুর অফিসে যোগদান করে। কদিন পর তার একটা ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা হয়। বাচ্চার প্রতি তাঁর মায়া লাগে। সারাক্ষণ মেয়ের কথা ভাববে, এমনকি অফিসে গিয়েও। তখন তার মনে পড়ে তার বাবাও হয়তো তার কথা এমন করেই ভাবে। তখন সে গাজীপুর থেকে বদলি হয়ে তার নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জে চলে যেতে চায়। তার স্ত্রী রাজি হয় না। কিন্তু মা-বাবার টানে বউকে রেখে এসে কিশোরগঞ্জ বদলি হয়ে যায়। শুরুতে রাগ করে থাকলেও শেষে স্বামীর সাথে যেতে রাজি হয় বীথি। বলছিলাম ‘টান’ গল্পটির কাহিনি। গল্পটিতে গঠনগত দিক থেকে কিছু অংশ আহাদের বাবার উক্তিতে, কিছু অংশ শ্বশুরের উক্তিতে এবং শেষ অংশ আহাদের উক্তিতে সাজানো।

উপস্থাপন ভঙ্গির ফলে শামীম রেজার গল্প বলায় একটি নিজস্বতা আছে। গল্পের একটি কাহিনিকে তিনি গল্পে থাকা তিনটি বা চারটি চরিত্রের সগোক্তিক বর্ণনার মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। এতে একই কাহিনি একেকজনের দৃষ্টিতে একেক রকম হয়ে ধরা পড়ে। এই পদ্ধতি একান্তই তার নিজস্ব সৃষ্টি। এই পদ্ধতির সুবিধা হল গল্পটি অনেক রহস্যময় ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, আর অসুবিধা হলো গল্পটি হয়ে যায় মেদবহুল এবং কখনো কখনো দুর্বোধ্য।

মোহিনী রায় নামে একজন এনজিওকর্মীর প্রেমে পড়েছে দুজন ছেলে। তারা মোহিনীকে পাওয়ার জন্য নানা রকম পরিকল্পনা করছে। কিন্তু মোহিনী কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না। কারণ সে তার প্রাক্তন প্রেমিকের স্মৃতি বুকে নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায়। তেমনি একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত গল্প ‘মোহ’। গল্পকার গল্পের প্রধান তিনটি চরিত্রের সগোক্তিক বর্ণনার মাধ্যমে নির্মাণ করেছেন গল্পটি।

‘বেগমজান অথবা সরল আখ্যান’ গল্পটিতে উঠে এসেছে গ্রামীণ জীবনের অন্যরকম এক চিত্র। বেগমজানে বিয়ে হয় হেলাল মিয়ার সাথে। হেলালের একটি বড় ছেলে আছে। ছেলের নাম আমজাদ। আমজাদকে দেখাশোনা করার জন্যই মূলত হেলাল মিয়া দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আমজাদ বড় হয়। শহরে চাকরি করে। একদিন বাড়ি ফেরার বেলায় ট্রাক ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত্যু হয় আমজাদের। মায়ের জন্য কেনা শাড়ি, বোনের ফ্রক,ভাইয়ের জিন্স প্যান্ট রাস্তায় গড়াগড়ি খায়। এ গল্প পড়ে পাঠকের বুকফেটে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে, আসবেই।

গল্পকারকে বলব গল্প উপস্থাপনের আরেকটু সচেতন হতে। গল্পে ব্যবহৃত উক্তিগুলো কখনো কখনো কোনটি কার উক্তি, সেটা বোঝা যায় না। একই লাইনে দুজন বা তিন জনের উক্তি একসাথে লিখে দেওয়াতে এই সমস্যাটি পেয়েছি বেশ কয়েকবার। এমন একটি বা দুটি সমস্যার ফলে পুরো গল্পটিকেই অদ্ভুত মনে হয়েছে কখনো। আর বানান শুদ্ধির ব্যাপারে অবশ্যই তীক্ষè নজর দিতে হবে।

নাহিদ একজন তরুণ কবি, ছড়াকার, গল্পকার ও সদাহাস্য মানুষ। খুব মিশুক। নাহিদের ব্যক্তিত্ব দেখে তাকে ভাল লাগে প্রীতির। সেই নাহিদ একদিন প্রীতিকে জানালো কেয়া নামের এক সুদর্শনাকে ভালোবাসে সে। কেয়া আবার প্রীতিরই ছোট বোনের মত। এক বিয়েতে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। বরের পাশে শরবতে চিনির বদলে লবণ দেওয়া নিয়ে মজা চলছিল। এদিকে কাকতালীয়ভাবে কেয়াও ভালবাসে ফেলে নাহিদকে। একটা সাংকেতিক চিরকুটের মাধ্যমে তাদের পরস্পরের প্রেম নিবেদন হয়। গল্পের নাম ‘লাজুক’। উপস্থাপনের দুর্বোধ্যতার জন্য গল্পটি মূলভাব উদ্ঘাটন কিছুটা কঠিন হয়ে গেছে।

‘নীলিমায় বিষণ্নতা’ একটা নিরেট প্রেমের গল্প। ভাতিজা বিপ্লবের কাছে নীলিমার রূপের প্রশংসা শুনে পাগল হয়ে গল্পকথক। নীলিমা হিন্দু, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এলাকার প্রতাপশালী উঠতি বয়সি তরুণেরা নানারকম হুমকি-ধামকি দিয়ে থাকে। নানান কৌশলে নীলিমার সান্নিধ্য পেতে চায়। তারপর কি হলো? জানতে হলে পড়তে হবে জেগে থাকো পূর্ণিমা বইটি।

‘কারিগর’ গল্পটি একজন শিক্ষকের জীবনকে কেন্দ্র করে। আব্দুল্লাহ নামের সেই শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান ও মেধাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য নানা রকম চেষ্টা করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে বন্ধুর মতো মিলেমিশে তাদের সুখ দুঃখের অংশীদার হোন তিনি। ছাত্রদের আর্থিক দুর্বলতায় নিজে টাকা দিয়ে ফরম ফিলাপ করান, বাড়িতে গিয়ে খবর নেন। সারাজীবন শিক্ষকতা করে অবসরে যাবার পরও আব্দুল্লাহ স্যার ঘুমের ঘোরে ছাত্রীদের কোলাহল থামানোর মতো ‘থামো থামো’ বলে চিৎকার করে জেগে ওঠেন। কিন্তু তার ছেলেটি মানুষ হয়নি। বাতির নিচে অন্ধকার। মায়ের আস্কারা পেয়ে তার ছেলেটি অমানুষ হয়ে গেছে। মানুষ গড়ার কারিগর নিজের সন্তানকে মানুষ করতে ব্যর্থ। অসম্ভব সুন্দর সুন্দর চিত্রকল্প এবং উপমায় সাজানো গল্পটি।

ডাক্তার বাচ্চুর যৌথ পরিবার। দেখে হিংসে হয়। ভাই বোনদের নিয়ে ভালোই কাটছিল দিন। হঠাৎ ছোট ভাই জামিলের কটু কথার যের ধরে সংসারের ভাঙন ধরে। এক পর্যায়ে মাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায় তারা। তখন জামিল এসে ভাইয়ের পায়ে ধরে মাফ চেয়ে এক হতে চাইলেও আর কাজ হয় না। এমনই এক যৌথ পরিবারের গল্প নিয়ে ‘পরিবার’ গল্পটি।

বইটির শিরোনাম গল্প ‘জেগে থাকো পূর্ণিমা’। এ গল্পের নায়ক সৌরভ, নায়িকা কেয়া। হাওর এলাকায় মধ্য রাতে চাঁদের আলো গায়ে মাখতে মাখতে সৌরভ কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়। কেয়াই কৌশলে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ছিল। পরবর্তীতে সৌরভের প্রতি তার মায়া হয়। এদিকে সৌরভ স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডন চলে যাবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। যাবার আগে চাঁদনী রাতে কেয়ার সাথে দেখা করতে যায়। জানতে চায় তাকে ভালোবাসে কি না। কেয়ার কাছ থেকে হ্যাঁ-সূচক জবাব পেয়ে আবেগাপ্লুত সৌরভ। অনেক বাঁকবদল এবং উপমা আছে গল্পটিতে। উপভোগ করতে হলে পড়তে হবে বইটি।

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়। ঐতিহাসিক কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও সিনেমা। তেমনি একটি ঐতিহাসিক গল্প ‘বঙ্গবন্ধু ও ভালবাসার গল্প’। যেখানে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু ভালোবেসে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হামিদকে একটি বাড়ি উপহার দিতে চাইলেন। বিহারী ভদ্রলোকের ফেলে যাওয়া বাড়ি। হামিদ বাড়িটির স্বত্ব গ্রহণের পূর্বে তার মায়ের পরামর্শ নিতে চাইলো। মা জানালেন এমন বাড়িতে তিনি থাকতে পারবেন না। থাকতে গেলে বিহারী লোকটার যত্নে গড়া বাড়িতে না থাকতে পারার কষ্ট তাকেও আক্রান্ত করবে। মায়ের এই যুক্তি শুনে হামিদ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বাড়িটি না নেয়ার আবেদন করেন। বঙ্গবন্ধু তার এই আচরণ দেখে অনেক খুশি হলেন ও দোয়া করলেন। বললেন, ধন্য মায়ের ধন্য সন্তান।

মোহাম্মদ শামীম রেজার গল্পগুলো অনেক মায়াময়। বিবেককে তারণা দেয়, শুদ্ধ হতে শিক্ষা দেয়। জেগে থাকো পূর্ণিমা বইটিতে মোট গল্প আছে ১৩টি। রুদ্রছায়া প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ১৮০ টাকা। প্রিয় পাঠক, বই হোক অবসরের সবচেয়ে কাছের অনুসঙ্গ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়