প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪৯
নদীর বুকে নৌকা
সময়টা ২০০৮ সালের ডিসেম্বর শেষের দিকে। পারিবারিক কাজে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মা আর মামার সাথে চাঁদপুরে আসলাম। মামা বললো এখানে বড় নদী আছে, চলেন ঘুরে আসি। ছোট্ট আমি, নদী বলতে চিনতাম বাড়ির কোল ঘেঁষে অর্ধমৃত ডাকাতিয়াকে। হটাৎ বড়স্টেশন নামে পরিচিত পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মিলনস্থলে পৌঁছালাম আমরা। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি, নদী এতো বড় হয়! একবার দৌড়ে নদীর পানি কাছে চলে যাই, আবার নদী রক্ষা বাঁধের উপর লাফিয়ে বেড়াই। বড়স্টেশনে থাকা ফুচকা আর ঝালমুড়ি খাই। এ যেন ইদ ইদ একটা অনুভূতি। পুরো সময়টা যেন নদীর দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। মায়ের হাত ধরে এপাশ-ওপাশ করতে ছিলাম। নদীর বুকে প্রথম বড় লঞ্চ দেখা, জেলেদের মাছধরা, স্প্রীড বোট, জাহাজÑএ যেন স্বপ্নময় প্রতিটি মুহূর্ত। এমনি করে দিনের অধিকাংশ সময় সেখাই কাটিয়ে দেয়া। যদিও তখন বয়স কম ছিলো। আবেগ-অনুভূতি বুঝতে পারিনি। তবে এখনে যে মায়া আছে, আনন্দ আছে, তৃপ্তি আছে তা বুঝতে বাকি ছিলো না। তার সাথে যুক্ত হলো নৌকা ভ্রমণ, নৌকা ভ্রমণ বলে যে পৃথিবীতে কিছু আছে, সেটাও এইদিনই জানতে পারলাম। কারণ ডাকাতিয়া নদীতে নদী পারাপার ছাড়া কখনো নৌকাতে মানুষ সখের বসে টাকা দিয়ে ঘুরতে দেখিনি। ঘন্টাখানেকের জন্য নৌকা নিয়ে নদী ভ্রমণে বের হয়ে পড়লাম। শীতকাল হওয়ায় নদীতে পানি ছিলো খুবই কম।
বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যদের কখনো এভাবে ডিঙ্গি নৌকায় মাছ ধরতে দেখিনি। সবসময়ই তাদের বাড়ি বাড়ি হাড়িপাতিল, মেলামাইনের জিনিস, দাঁতের পোকা খিলাই ও অন্যান্য কাজে দেখেছি। কিন্তু এই প্রথম দেখলাম তারা মাছ ধরছে। তাও খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো। বিশাল নদীতে ছোট্ট একটা বড়শি ফেলে বসে আছে।
দেখতে দেখতে চোখ পড়লো ডাকাতিয়া নদীর অপর পাড়ে জরাজীর্ণ একটা এলাকার দিকে। অনেক মানুষের কর্মযজ্ঞ দেখে কৌতুহলবসত মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা নদীর এ পাড়ে কি হয়, মানুষগুলো বস্তা মাথায় কি বয়ে বেড়াচ্ছে?’ মামা বললো, ‘এপাড়ে যা দেখছো সব কল-কারখানা, এখানে ধান, হলুদ, মরিচ, আটা, চাল, ডাল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নদীপথে আনা-নেওয়া করে’। সত্যি বলতে বইতে পড়া কলকারখানা শব্দটার সাথে সেইদিন বাস্তবে পরিচিত হলাম।
নৌকাটা আরেকটু সামনে গেলেই দেখলাম বড় বড় লঞ্চগুলো ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে, একটার পর একটা লঞ্চ। এ যেন একেকটা তিনতলা বাড়ি। কতো সুন্দর সুন্দর নাম লঞ্চগুলোরÑময়ূর, ঈগল, মিতালী আরো কতো কী! আমি মুগ্ধ হয়ে লঞ্চগুলো দেখছিলাম। মনে মনে অনেক ইচ্ছে হচ্ছিলো লঞ্চে উঠার। কারণ তখনও আমার জীবনে লঞ্চে উঠার অভিজ্ঞতা হয়নি।
আরেকটু সামনে গিয়েই দখলাম বেদেরা নদীর উপর নৌকাতে ঘর বানিয়ে পরিবার নিয়ে থাকছে। এ যেন বিশ্বাস হবার মতো নয়। আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি নৌকাতে মানুষ পরিবার নিয়ে থাকতে পারে। আরেকটু সামনে যেতেই চোখ পড়লো একঝাঁক কবুতরের দলের দিকে। এগুলোর বসবাস চাঁদপুর পুরাণবাজার সংযোগ সেতুর নিচের দিকে। শতশত কবুতরের আবাসস্থল। কেউ কেউ উড়ে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ উড়ে এসে সেতুর নিচে বসে পড়ছে।
ঘোরার পরে নৌকা ঘোরানোর পালা। নৌকা ঘুরিয়ে আবার সেই তিন নদীর মিলনস্থলের দিকে নিয়ে আসছিল। তখনই বুঝতে বাকি নেই ভ্রমণ সমাপ্তির দিকে।
এমনি করে তিন নদীর মিলনস্থল ঘোরার মতো অত্যন্ত সুন্দর সময় অতিবাহিত হয়। চাঁদপুরে যারা নিয়মিত বসবাস করেন, তারা কখনো গল্পের মতো করে জায়গাটাকে অনুভব করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের বৃহৎ দুইটি নদীর মিলনস্থলে তাদের বসবাস, এটাও অনকসময় স্বভাবিকভাবেই দেখে চাঁদপুরবাসী, কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই স্বাভাবিক?