প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১০
সাংবিধানিক সংস্কার বা পুনঃলিখন : রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তি জরুরি
‘কনস্টিটিউশন’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘কনস্টিটিও’ থেকে উৎপত্তি হয়ে ফরাসি ভাষা থেকে এসেছে, যা প্রবিধান এবং আদেশের জন্য ব্যবহৃত হয়। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে কনস্টিটিউশন সম্পর্কে বলা আছে, ‘কনস্টিটিউশন হল মৌলিক নীতি বা প্রতিষ্ঠিত নজিরগুলির একটি সমষ্টি যা একটি রাষ্ট্র, সংস্থা বা অন্য ধরনের সত্তার আইনি ভিত্তি গঠন করে এবং সাধারণভাবে নির্ধারণ করে কিভাবে সেই সত্তাকে শাসিত করা হবে।’ ইংরেজি ‘কনস্টিটিউশন’ শব্দটিকে বাংলায় আমরা ‘সংবিধান’ বলি। গ্রীক দার্শনিক এরিষ্টটল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্তবহু চিন্তাবিদ এবং রাষ্ট্রবিদগণ বিভিন্নভাবে সংবিধানের সংজ্ঞা দিয়েছেন। এরিস্টটল বলেছেন, ‘সংবিধান এমন একটি জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র নিজের জন্যে বেছে নিয়েছে।’
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকে জনগণের মুক্তির দলিল
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে নির্বাচন হয়েছিলো সেই নির্বাচনে মেম্বার অফ লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি (এমএলএ) ছিল। সেই প্রাদেশিক সরকার ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল একটা সরকার গঠন করে, যা আমরা মুজিবনগর সরকার (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নামেও পরিচিত) হিসেবে জানি। তারাই ম্যান্ডেট নিয়ে একটি গণপরিষদ গঠন করে। গণপরিষদের কাজ ছিল দুটি : (১) জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সময় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও এর ভিত্তিতে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা এবং (২) বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের দলিল হিসেবে সংবিধান প্রণয়ন করা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১০ এপ্রিল ১৯৭২ স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়।
প্রজা থেকে রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে ওঠার লড়াই
আমাদের সংবিধানে ‘রিপাবলিক’ শব্দকে বাংলায় ‘প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সংবিধানের প্রথম ভাগ প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে বলা আছে, “১ বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” নামে পরিচিত হইবে।” যদিও এই ‘প্রজা’ শব্দটি নিয়ে দেশের জনগণের আপত্তি আছে। যদি এই ‘প্রজা’ শব্দ আমরা মেনে নেই, তাহলে আমরা তো রাষ্ট্রের নাগরিক নই, প্রজা মাত্র! সত্যিকারার্থে বিগত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ এই রাষ্ট্রে প্রজা হয়েই ছিলেন। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো ও জনতার গত পনের বছরের সংগ্রাম ছিল রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। এবারের জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্পিরিটও ছিল ‘প্রজা থেকে রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে ওঠার লড়াই।’
সাংবিধানিক সংস্কার বা পুনঃলিখন
গত পাঁচই অগাস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিগত সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বিপ্লবোত্তর নয়া বাংলাদেশে বিদ্যমান সংবিধান সংস্কার না পুনঃলিখন করা জরুরি, তা নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক শুরু হয়েছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘ঞযব ঊহফঁৎধহপব ড়ভ ঘধঃরড়হধষ ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হং’ নামক গবেষণা গ্রন্থে বলা হয়েছে একটি লিখিত সংবিধানের গড় আয়ুষ্কাল ১৯ বছর। তবে বেশিরভাগ সংবিধান ১০ বছরের বেশি টেকে না, এর মধ্যেই অনেক পরিবর্তন, পরিমার্জন হয়।
১৯৭২ সালে প্রণীত হবার পর গত ৫২ বছরে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৭ বার, এরমধ্যে আওয়ামী লীগ একাই করেছে ৭টি সংশোধনী। আবার শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছর সাত মাস তিন দিনের শাসনামলে তিনি একাই করেছেন চারটি সংশোধনীÑ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই প্রথম সংশোধনী, ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনী, ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর তৃতীয় সংশোধনী এবং ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনী। এছাড়া, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ৪৭টি সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। এরকম আরো অনেক সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদের সংবিধান তার মূল চরিত্র হারিয়েছে।
এতটুকু পড়লে মনে হবে, সাংবিধান পুনঃলিখন করাই জারুরি। কিন্তু যে সাংবিধানের আলোকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েছে সেই সংবিধানের ৭ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা সেটি করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তার এই কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবেন। আর এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে (মৃত্যুদণ্ড) দণ্ডিত হবেন। কাজেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাংবিধানিক পথে সাংবিধান পুনঃলিখনে বাধাগ্রস্থ হবেন, তা বলাই বাহুল্য।
সেকারণে আমাদের মতে হতে পারে সাংবিধানিক সংস্কার জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানকে এমন কিছু ক্ষমতা দিয়েছে যার মাধ্যমে ওই পদে বসে যে কেউ স্বৈরাচারি হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। আমাদের অরিজিনাল কনস্টিটিউশনে ছিল সেপারেশন অব পাওয়ার। কিন্তু, রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতাই নেই। আবার প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা। এর একটা ভারসাম্য দরকার। আবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যার মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিং বন্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চরিত্রই পাল্টে দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। তবে এটার বিরুদ্ধে রিট হয়েছে। কাজেই রিটে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে তো আর সংশোধনের দরকার নেই।
কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের পথটিও সহজ নয়। বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের প্রধানত চারটি দিক রয়েছে। এর প্রথম তিনটি সংবিধানের সাধারণ কোনো বিষয় সংশোধনীর জন্য অনুসরণ করতে হয়। আর প্রস্তাবনার মতো মৌলিক বিষয় সংশোধনীর জন্য এর সঙ্গে গণভোটের শর্ত পূরণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোন নির্বাচিত সরকার নয়। গত ২৫ আগস্ট ২০২৪, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা।’ তো, এই সরকারে যারা আছেন তারা তো ছাত্রদের নিয়োগ করা— এখানে পেশাজীবী, কৃষক, শ্রমিকসহ, রাজনৈতিক দল এবং নানা মতের লোকসহ সমাজের সকলস্তরের প্রতিনিধি তো নেই।
সংবিধানের সুরক্ষা দেবে কে?
সাংবিধানিক সুরক্ষা কথাটা আমরা প্রায়ই বলি। যার মাধ্যমে আমরা মনে করতে পারিÑএই সংবিধান বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ও এর জনগণকে সুরক্ষা দেবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধানকে সুরক্ষা দেবে কে? সংবিধানকে সুরক্ষার দায়িত্ব নাগরককেই নিতে হবে। কাজেই সংবিধান নতুন করে লেখা হবে না সংশোধন করা হবে তা নিয়ে আগেই বিতর্ক করা ঠিক হবে না। আমাদের আগে ঠিক করতে হবে আমাদের সংবিধানে কী কী পরিবর্তন বা সংস্কার প্রয়োজন। এমন কোন ট্রেন্ড সেট করা আমাদের জন্য উচিৎ হবে না যাতে ভবিষ্যতে কোন সরকার গঠিত হবার পর সরকারের প্রধান কাজ হয় সংবিধান সংস্কার বা পুনঃলিখন করা।
জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যান্য গণজাগরণ বা গণ-অভ্যুত্থান থেকে আলাদা। সেই বিবেচনায় সাংবিধানিক সংস্কার প্রয়োজন। যেমন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তিনটি আদর্শ যথা ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক সুবিচার’ সংবিধানের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। অথচ এই ত্রয়ী আদর্শই প্রজাতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি। আবার পৃথিবীজুড়ে গণতান্ত্রিক সংবিধানে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ— এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। যার ফলে ভারসাম্যের সংস্কৃতি আসে। আমাদের সংবিধানে এগুলোর অভাগ আছে। তবে, সংবিধানে ইতিমধ্যে যেগুলো স্বীকৃত বা মীমাংসিত বিষয়, এগুলো মনে হয় সংস্কার করার প্রয়োজন হবে না। যেমন ‘রিপাবলিক’; তবে বাংলা করার ক্ষেত্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সমাধান কোন পথে?
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অংশীজনদের মতামত নেওয়া শুরু করছে কমিশন। প্রত্যাশা করা যাচ্ছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারবে। যেহেতু প্রত্যেক সাধারণ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেন, সেহেতু আগামি সাধারণ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সাংবিধানিক সংস্কার বা পুনঃলিখন বিষয়টি নিয়ে আসবেন। কোন রাজনৈতিক দল কতটুকু সংস্কার বা পুনঃলিখন করবেন, তা সেই রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় নীতি, আদর্শ ও জন-আকাক্সক্ষা অনুসারে ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করবেন। জনগণ যখন রাজনৈতিক দলের ইশতেহার দেখবেন, তখন জনগণই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তারা কীরকম সংস্কার বা পুনঃলিখন চান।
পাশাপাশি জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন অংশীজনেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্রমাগত চাপ দেয়ারও প্রয়োজন আছে যাতে তারা নির্বাচনী ইশতেহারে সংবিধান সংস্কার বা পুনঃলিখন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন। কোন রাজনৈতিক দল এমন কোন সংস্কার বা পুনঃলিখন করতে পারবেন না যা তারা নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশ করেননি। এরপর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হবে যদি তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে তাহলে তারা সংবিধান সংস্কার বা পুনঃলিখন করতে পারবে— যেমনটা তারা নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে তাদের প্রথম সংশোধনী এনে ৭ (ক) এবং ৭ (খ) অনুচ্ছেদ দুটি বাতিল করতে হবে। এরপর অন্যান্য অনুচ্ছেদ সংশোধন বা পুনঃলিখন করতে হবে। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে বিরোধীদের সম্মতি নিয়ে এই প্রক্রিয়াটি শুরু করা যেতে পারে। এতে সংবিধান সংস্কার বা পুনঃলিখন নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে হওয়ার সুযোগ থাকবে। এবং একই সাথে সংস্কার বা পুনঃলিখনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকবে বলে প্রত্যাশা করা যাচ্ছে।
নজরুল ইসলাম : লেখক, বিশ্লেষক ও গবেষক।