প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:০৪
বিষাদের উৎসব
নবনীতা শোনো, তাজ্জব হয়ে যাবার মতো তোমাকে একটা ঘটনা বলি। আমাদের বাসায় হঠাৎই গ্যাসের চুলা জ্বলে থাকে। এ ঘটনা শুধু রাতে ঘটে না, ঘটে দিনের বেলাতেও, বিশেষ করে ভরদুপুরে। মাঝেমধ্যেই রান্না করতে গিয়ে দেখা যায়, গ্যাস জ্বলছে। কী আশ্চর্য ঘটনা! চোখ কপালে উঠে যাবার মতো বিষয়। তুমি আশ্চর্য হওনি নবনীতা?’ আমি চোখ ছোট ছোট করে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আশ্চর্য ভঙ্গিমায় নবনীতাকে গত রাতের ঘটনা বললাম।
‘সত্যিই? আল্লাহ! আপনারা কীভাবে থাকেন ওই বাসায়? ভয় করে না?’—ধরেই নিয়েছিলাম নবনীতা এমন কিছু বলবে। অথচ না, নবনীতা হাসল। ওর মধ্যে ন্যূনতম ভয় নেই। আমরা বাসার সবাই ভয় পেলাম, অথচ নবনীতা হাসছে। বলল, ‘না। আশ্চর্য তো হলামই না, বরং মজা পেলাম আপনার কথা শুনে। কেউ ভুলে গ্যাস জ্বালিয়ে রাখতেই পারে। এটা আহামরি কোনো ঘটনা নয়।’
আমি একটু বিরক্ত হলাম। মেয়েরা আশ্চর্য হয়ে তাকালে তাদের চোখ ও মুখের ভঙ্গিমা সুন্দর লাগে। কোনো সুন্দরী মেয়েকে এভাবে আশ্চর্য করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে নিজেকে একটা জাহাজের মতো মনে হয়, নাবিক ছাড়া জাহাজ—চলছে তো চলছেই। আমি বললাম, তুমি ভুল বুঝেছ। কেউ ভুল করতেই পারে, কিন্তু ঘটনা তা নয়। তাহলে আরেক দিনের ঘটনা শোনো।
বাসায় কেউ নেই। সবাই ক্লাসে। আমি দরজা লক করতে গিয়ে রান্নাঘরে রান্না করার শব্দ শুনতে পেলাম। বাতিও জ্বালানো। ভাবলাম, খালা রান্না করছেন। কিন্তু না। গিয়ে দেখি কেউ নেই, অথচ গ্যাস জ্বলছে। আমাদের গ্যাস সাত দিনের বেশি কেন যায় না, তারও উত্তর মেলেনি। আমি তখন গ্যাস বন্ধ করে দিয়ে রুমে এলাম। এ ঘটনাকে আশ্চর্য ঘটনা বলেছেন স্বয়ং আমাদের বিল্ডিংয়ের বড় ভাই। তার নাম আরাফাত। প্রচণ্ড সাহসী লোক। নরম মনের মানুষ। নরম মনের মানুষ কীভাবে সাহসী হয়, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কোথাও খুঁজে না পেয়ে আমি হতাশ হই। হিমেল ভাই শক্ত মনের মানুষ, অথচ সাহসী না। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যান। ওই মুহূর্তের জন্য তিনি ভয়ানক মানুষ। অথচ রাগের প্রতিক্রিয়া দেখানোর পর তিনি নিজেকে নিজে দোষারোপ করেন। তিন-চার দিন রাতে ঘুমাতেও পারেন না, ট্রমায় ভোগেন।
আমার রুমমেট রুদ্র দুইটার মিশ্রণ। অনেকটা মিক্স ইকোনমির মতো। আমার বন্ধু রাহাত দুইটার কোনোটাই না। না ভয় পায়, না সাহসী। ওকে নিয়ে বিপদ বেশি। জিন-ভূতের গল্প বললে আগ্রহ নিয়ে শোনে, কিন্তু সে রাতে একা ঘুমায় না। কী মুশকিল! শাওন আছে সবচেয়ে বিপদে। আগে ছিল শক্ত, এখন হয়েছে নরম! নরম মানুষ শক্ত হলে খুব একটা আহামরি কিছু হয় না। অথচ শক্ত মানুষ নরম হলে বিপদ ঘটে। সবাই পেয়ে বসে। আমি মানুষটা কেমন বলতে পারি না। নিজের কথা নিজে বলা যায় না। নিজের সম্পর্কে শুনতে হয় চারপাশের মানুষের কাছ থেকে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একবার একটা যুগান্তকারী কাজ করব। আমাদের বাজারের মধ্যে দঁাড়িয়ে গলায় একটি প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দেব। প্ল্যাকার্ডে লিখব, ‘আমার সম্পর্কে বলুন।’ ইতিবাচক কথা বললে উপহার পাবে একটা, নেতিবাচক বললে উপহার থাকবে দুইটা। নিজের নেতিবাচক কথা শুনে নিজেকে শুধরে নেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় কেউ আবিষ্কার করেনি। আমি করেছি। নিজের সম্পর্কে ভালোর চেয়ে খারাপটুকু বেশি জানা উচিত। যারা বলবেন, উপহার হিসেবে তারা পাবেন বই। এখন বলো নবনীতা, এই সম্পর্কে তোমার মতামত কী?
নবনীতা হাসছে। আওয়াজ করে হাসি। নবনীতার হাসি দেখে আমার একদিনের রাতের কথা মনে পড়ল। সে রাতে আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। মাথার যন্ত্রণা শুরু হলে একটানা সাত দিন আমি উঠতে পারি না। দুনিয়াটাকে তখন মনে হয় বায়বীয় পদার্থের মতো। দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছেঁায়াও যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আমার সেই অনুভবতায় মাঝেমধ্যে নবনীতা আসে। গাল ফুলিয়ে হাসে। আবার কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। আমার মাথার যন্ত্রণা তখন আরও বেড়ে যায়। সেদিন রাতে চোখ তখন কিছুটা ভারী হয়েছে মাত্র। ঠিক একই রকম হাসি, একই আওয়াজ। লক্ষ করে দেখলাম, আওয়াজটা ছাদ থেকে আসছে। আমি ছাদে গেলাম। ছাদের এক কোনায় নবনীতাকে দেখে চমকে উঠলাম, ‘একি! নবনীতা তুমি? এদিকে আসো। পরে যাবে তো!’ নবনীতা দুই হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বাতাসে নিজেকে ভাসিয়ে দিল। আমি দৌড়ে ওকে আটকাতে গেলাম। লক্ষই করিনি, আমার পা ফসকে যেতে পারে! পঁাচতলার ওপর থেকে আমি পড়ে গেলাম।
চমকে উঠে দেখি অন্ধকার ঘর। মাঝরাতে ঘড়ির সেকেন্ডের কঁাটার বিদঘুটে আওয়াজ তখন স্পষ্ট। মাঝরাতে চমকে ওঠা মানুষদের জীবনে ঘড়ির সেকেন্ডের কঁাটার আওয়াজ একধরনের ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি করে। সে পরিবেশে তৈরি হয় হারিয়ে ফেলার বিষাদভরা উৎসব। মন চাচ্ছিল ঘড়িটাকে খুলে ছুড়ে ফেলি। অন্তত আওয়াজ বন্ধ হোক।
চোখে-মুখে পানি দিয়ে ছাদে গেলাম। রাতের ঢাকা শহর দিনের চেয়ে বেশ আলাদা। নিস্তব্ধ শহরটা রাতে সুন্দর। ঢাকা শহরকে সূক্ষ্মভাবে জানতে হলে চিনতে হবে রাতের ঢাকাকে। আমার হাতে এক মগ চা। এই ভোররাতে মানুষ কীভাবে চা খেতে পারে, তা দেখে নিশ্চয়ই পাশের বাড়ির ছাদে দঁাড়িয়ে থাকা মেয়েটি আশ্চর্য হচ্ছে! জ্যোৎস্নার আলোয় আমি স্পষ্ট দেখলাম, মেয়েটি স্তব্ধ হয়ে দঁাড়িয়ে আছে। আকাশে বিশাল আকারের চঁাদ। তারা দেখা যাচ্ছে না। সে আলোয় দেখলাম, দঁাড়িয়ে থাকা মেয়েটি বারবার চোখ মুছছে। সমুদ্রের স্রোতের মতো গড়িয়ে পড়া জল কোনোভাবেই সে আটকাতে পারছে না। পৃথিবীতে মায়াবতী কোনো মেয়ের চোখের জল এ শহরে বন্যার কারণ হতে পারে বলে আমি স্নিগ্ধ মেয়েদের চোখের জলে ভয় পাই। কলেজজীবনে লেখা শেষ কবিতাটা মাথায় এসে এলোমেলো হয়ে ঘুরছে। ডায়েরির শেষ পাতায় লিখেছিলাম একদিন মাঝরাতে—
‘তোমার চোখে চেয়ে দেখি,
ঘন মেঘের মতো জল।
আমাকে ভাসিয়ে নিয়ো সে জলে
হোক তা সমুদ্র কিংবা সমতল।’
লম্বা করে চায়ে একবার চুমুক দিলাম। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, ছাদের এক কোনায় দঁাড়িয়ে থাকা মেয়েটি নেই। আশপাশে তাকিয়েও তাকে খুঁজে পেলাম না। দু-একটি বাসার জানালার গ্লাসে তখনো নিবু নিবু বাতি জ্বলছে। অমাবস্যা কি না। তারাগুলোতে অঁাধার নেমে এসেছে। সেই অঁাধারের আলোতে আমি ছোট ছোট চোখে দেখলাম, সামনের সড়কে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত!
নবনীতা দঁাড়িয়ে ছিল সূর্যের দিকে। ৩০০ ফিট সড়কে তখন বিকেল নেমেছে। সূর্যের ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে বিকট শব্দে বিমান নামাটা আমার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে।
নবনীতা নাটরের বনলতা সেনের মতো খুব নীরবে ঘুরে দঁাড়াল আমার দিকে। কবিতার মতো অপরূপ সুন্দরী মেয়েটি আশ্চর্য চোখে আমার দিয়ে তাকাল। আমার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে, অথচ আমি তার চাহনিতে দেখলাম বিশ্বের বিস্ময়! সে বিস্ময়েরও বিস্ময় আছে। ঝিরঝির বাতাসে কিছুটা ঠান্ডা লাগছে নবনীতার।
অত্যধিক মায়াবতী মেয়েদের আশ্চর্যজনক দৃষ্টি দেখার এক শ এক উপায়—এ ধরনের কোনো বই আজকাল মেলায় পাওয়া যায় না। অথচ এ বইয়ের খুব প্রয়োজন। পৃথিবীতে এত এত মায়াবতী নারী। অথচ পুরুষ তার শখের মায়াবতী নারীর চোখের আশ্চর্য ভঙ্গিমা না দেখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, তা হতে পারে না।
নবনীতার খোলা চুলগুলো বাতাসে ভাসছে। চুলগুলো ভেসে ভেসে পৃথিবীর সমস্ত সুখের প্রতিচ্ছবি অঁাকছে। মেয়েরা আশ্চর্য হওয়ার পর অত্যন্ত শান্ত আচরণ করে। নবনীতাও তা-ই।
আমাকে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘চা খাবেন? আজ আমি খাওয়াব। চাইলে আপনি একটা সিগারেটও নিতে পারেন। সমস্যা নেই।’
আমি হেসে বললাম, ‘খাওয়া যায়।’