বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৬

কর্মসংস্থানের সামাজিক বয়ান ভাঙা দরকার

মাহফুজুর রহমান মানিক
কর্মসংস্থানের সামাজিক বয়ান ভাঙা দরকার

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের হতাশা লক্ষণীয়। এমনকি প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদেরও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ কম নয়। উচ্চশিক্ষার শুরুতেই তাদের এ হতাশার কারণ দুটি বলে আমি মনে করি। প্রথমত, সামাজিক প্রত্যাশা; দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত বেকারত্বের ভয়াবহ পরিসংখ্যান। যে কারণে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও একাডেমিক পড়াশোনা ও চাকরির প্রস্তুতির মধ্যে দুলতে থাকেন। গত ১৫ অক্টোবর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা গত ৯ বছরে হয়েছে তিন গুণ। প্রতিবেদনমতে, ২০১৩ সালে দেশে মোট বেকারের ৯ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল উচ্চশিক্ষিত। ২০২২ সালে এসে তা হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক চিন্তা অনেকটা সমাজই তৈরি করে দেয়। এর সূচনা পরিবার থেকেই। সমাজে এর কদর বেশি বলে কেউ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার আগেই মা-বাবা চিন্তা করেন তাঁর সন্তান বড় কর্মকর্তা হবে। ভাইবোনদের প্রত্যাশা আরও বেশি। প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়স্বজনের চাপও কম নয়। গ্রাম থেকে যে শিক্ষার্থী এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তাঁর ওপর এই প্রত্যাশার চাপ কতটা, তা বলা বাহুল্য। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই স্বপ্ন থাকে সরকারি চাকরি। দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীরা বিসিএসসহ সরকারি চাকরির জন্য উঠেপড়ে লাগেন। এমনকি গ্রন্থাগারগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীর চেয়ে চাকরিপ্রার্থীর ভিড়ই বেশি দেখা যায়।

এই সামাজিক ও পারিবারিক চাপের কারণে উচ্চশিক্ষিতরা চাইলেই যে কোনো পেশা বেছে নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেন না। যেমন ঢাকা শহরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর কতজন গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজ করে জীবন ধারণ করতে পারবেন? অনেকে অবশ্য কৃষি খামার করে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় তাঁকে ব্যতিক্রমই বলতে হবে। আমাদের কৃষি কর্মসংস্থানের একটা বড় ক্ষেত্র এবং শিক্ষিতরা সরাসরি এতে যুক্ত হলে তাদের কর্মসংস্থানের যেমন বিকল্প ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে, তেমনি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। মৎস্য সম্পদে যে সম্ভাবনা আছে, সেখানেও তরুণদের অবদান রাখার সুযোগ আছে।

সমাজে ভালো কর্মসংস্থান সম্পর্কে যে বয়ান তৈরি হয়েছে, তরুণ প্রজন্ম অনেকটা সে স্রোতেই গা ভাসাচ্ছে। ছোটখাটো ব্যবসা দিয়ে শুরু করে কেউ বড় শিল্পপতি হতে পারেন। আজকে সমাজে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত অনেকের সূচনা সেভাবেই হয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা সমাজ তৈরি করতে পারেনি। রাষ্ট্রও উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে না। এমনকি যারা ফ্রিল্যান্সিং করছেন; বিদেশ থেকে পরিশ্রম করে বৈদেশিক মুদ্রা আনছেন, তাদেরও পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

এটাও ঠিক, ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজের ভালো লাগা থেকে পেশা বেছে নেন। সমাজ কিংবা পরিবারের মতের বাইরে গিয়েও প্রতিষ্ঠিত হন। এ মানুষের কাফেলা বড় হলে কর্মসংস্থান নিয়ে সংকীর্ণ ওই সামাজিক বয়ান ভেঙে যেতে পারে। তখন কর্মসংস্থানের বিচিত্র ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে তরুণদের হাত ধরেই। একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সংস্কারের বিষয়ও এখানে জরুরি। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহের বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন বলছে, তিন বছরে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন প্রায় ১৯ লাখ শিক্ষার্থী। এর অধিকাংশই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে স্নাতক হয়েছেন ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৬২০ জন। এদের ক’জন জীবিকা অর্জনের জন্য মানসম্পন্ন কাজ পেয়েছেন? তাই প্রশ্ন উঠছে, উচ্চ মাধ্যমিকের পর সবার জন্য উচ্চশিক্ষা কতটা জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন ভোকেশনাল, টেকনিক্যাল, সামাজিক ব্যবসা, উদ্যোক্তা তৈরি, প্রযুক্তিগত কর্মসংস্থান প্রস্তুত করা। এই প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সমাজকেই সর্বাগ্রে ভূমিকা পালন করতে হবে।

তথাকথিত ‘ছোট’ চাকরি করলেও শিক্ষিতদের যেভাবে বেকারত্বের খাতায় ফেলা হয়, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। মনে রাখতে হবে, কোনো কাজই ছোট নয় এবং রাষ্ট্রে সব পেশারই গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। সেই সঙ্গে সামাজিক বয়ান ভেঙে গেলে কাজের ক্ষেত্রে লজ্জা-শরম বলে যে বিষয় আছে, তা উঠে যাওয়ার পথ তৈরি হবে। এর পর তরুণরা ইচ্ছামাফিক যে কোনো বৈধ কাজকে তাঁর পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারবেন। বিশেষ করে উদ্যোক্তা হওয়া, কৃষিকাজ, ছোট ব্যবসা ইত্যাদির পথ উন্মুক্ত হবে। বিদেশে পড়াশোনা কিংবা কর্মসংস্থানের জন্য যাওয়া এর বাইরে নয়। উল্লেখ্য, এখনও যেসব তরুণ সামাজিক বয়ানকে ধরে ওই পথে এগিয়ে যান এবং দিন শেষে সেখানে সংগত কারণেই ভীষণ প্রতিযোগিতা থাকায় অনেকে সেখানে পৌঁছতে পারেন না, তখন বাস্তবতা মেনে তারা সুযোগ অনুসারে অন্য কাজ করতে বাধ্য হন। মাঝখানে মূল্যবান কয়েক বছর হয়তো নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিবার ও সমাজের চাপে এই সময় নষ্ট করেন। সে জন্য তরুণরা ঝোঁক অনুযায়ী যে পেশায় যেতে চান, সে অনুযায়ী স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন। তারুণ্যের প্রতি আস্থা রেখে এ লক্ষ্যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। তারুণ্যের উদ্যম

থাকলে তারা যে কোনো পেশা বা কাজে ভালো করতে পারেন; ছোট উদ্যোগকেও করে তুলতে পারেন বড়। তাতে দিনশেষে ব্যক্তি নিজে, সমাজ এবং রাষ্ট্রও উপকৃত হবে।

মাহফুজুর রহমান মানিক : জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়