প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৭
সুখের চিরকুট
কবিতাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু যখন পরিপাটি প্রেমিকা অগোছালো স্ত্রী হয়ে গেল, তখন কেন জানি আমার আর ওকে ভালো লাগত না। মেয়েটা অল্পতেই খুশি হয়ে যেত। আমার মনে আছে, যখন ওর সঙ্গে বিয়ে হয়, তখন আমার মাসিক বেতন ছিল পনেরো হাজার। এই টাকায় ও কতটা সুখী ছিল, তা কাউকেই বলে বোঝাতে পারব না। পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের খেয়াল রাখত সে। দিন শেষে চাইত কেবল একটু ভালোবাসা। যেটা আমি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া কমিয়ে দিলাম।
আস্তে আস্তে আমার পজিশন ভালো হতে লাগল। চিন্তাভাবনা হলো উচ্চাভিলাষী। কিন্তু সংসারের চাপে পরে কবিতা ঠিক আগের মতোই রয়ে গেল। আমার পনেরো হাজার বেতন ত্রিশ হাজারে গিয়ে ঠেকল। ঘর পরিবর্তন হলো, আমি পরিবর্তন হলাম। শুধু পরিবর্তন হলো না কবিতা। হ্যাঁ, আমার স্ত্রী নিজেকে পরিবর্তন করল না। টাকার নেশা আমাকে গ্রাস করে দিল আস্তে আস্তে। ভুলে গেলাম প্রিয় অতীতকে। সুখ পেয়ে ভুলে গেলাম দুঃখের দিনে পাশে থাকা মানুষগুলোকে।
সারা দিন খাটাখাটনি করে খাবার টেবিলে যখন কবিতা অপেক্ষা করত, আমি বলতাম যত সব আদিখ্যেতা। বৃষ্টি হলেই আমার হাত দুটি ধরে যখন বলত, ‘চলো না দুজনে বৃষ্টিবিলাস করি।’ আমি বলতাম, ‘বয়স তো কম হলো না; এখন এসব পাগলামি ছাড়।’ মাঝরাতে যখন পিরিয়ডের ব্যথায় কুঁকড়ে উঠত, আমি নাক সিটকে পাশের রুমে ঘুমাতে চলে যেতাম। দিনের পর দিন তার ভালোবাসা বেড়েছিল আমার প্রতি, আর আমার অবহেলা। একটা সময় পর আমার পরিবারও ওকে অবহেলা করতে শুরু করল। যার হাতের রান্না সবাই তৃপ্তি নিয়ে খেত, এখন নাকি তার রান্না ভালো হয় না। যে ওষুধ না দিলে বাবার ওষুধ খাওয়ার কথা মনে থাকত না, আজকাল নাকি সে ভুল ওষুধ দিয়ে আমার বাবাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে!
একটা সময় আমাদের বাড়িতে থাকার মতো কোনো সম্বল খুঁজে পেল না কবিতা। তাই সরাসরি বলেই দিলাম, আমি তোমায় ডিভোর্স দিতে চাই। সে সেদিন খুব অবাক নয়নে চেয়ে ছিল। কোনো প্রতিবাদ করেনি। হয়তো বুঝতে পেরেছিল, তার এই বাড়ির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তারপর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সময় এল, যখন কবিতা আর আমার ডিভোর্স হবে। সেদিনও সবটা কি সুন্দর করে মেনে নিয়েছিল। কোনো প্রতিবাদ করেনি। এমনকি খোরপোষের টাকাটাও দাবি করল না।
উকিল যখন জিজ্ঞেস করল, সে কেন টাকাটা নেবে না। তখন ও বলল, যে মানুষটাই আমার হয়নি, তার টাকা দিয়ে আমি কী করব।
ওর বাবা সেদিন আমায় একটা কথা বলেছিল, ‘আল্লাহ দিয়ে ধন দেখে মন, কাইড়া নিতে কতক্ষণ।’ কথাটার মানে সেদিন না বুঝলেও আজ ঠিক বুঝতে পারি।
তিন মাসের মাথায় মিথ্যা অপবাদে আমার চাকরি চলে যায়। বড় বোনটাকে মাঝেমধ্যেই তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মেরে ধরে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। বাবা ভুল ওষুধের রিয়াকশনে আজ বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। মা প্রায় আজকাল তরকারিতে নুন, হলুদ দিতে ভুলে যায়। আর আমি উন্নত মানের চাকরি থেকে ফুটপাতে ছোট্ট একটা ফুলের দোকান নিয়ে বসে আছি। আজ ওই কথার মানে বুঝলাম, দিয়ে ধন দেখে মন, কাইড়া নিতে কতক্ষণ।
লুকিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম কবিতার। শুনেছি অন্য জায়গায় তার বাবা বিয়ে দিয়েছেন। স্বামী ডাক্তার। খুব সুখে আছে। খুব ভালো ভাগ্য সেই মানুষটার, যার সঙ্গে কবিতার বিয়ে হয়েছে। গেছে মাসে নাকি তাদের একটা মেয়েও হয়েছে। সে সুখের আশা করেনি, তাই তার এত সুখ।
আর আমি সুখের আশা করে মানুষকে অমানুষ ভেবেছি। তাই আজ আমার এই পরিস্থিতি। তাই তো মানুষ বলে, শেষ হাসিটা তারাই হাসে, যারা নিজেকে নয় অন্যকে ভালোবাসে।