প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:১১
অপেক্ষায় দাসী
আমাদের বিবাহবার্ষিকী যদি বৈশাখ মাস থেকে ধরি তাহলে এবারের বৈশাখে, চার বছর হবে। আমি, আমার শাশুড়ী,একটা টিনসেড ঘরে থাকি। তার পাশে খড় দিয়ে একটি ঘর বাধাঁনো। ঘরটি দেখতে সোনালী বর্ণের। অপরুপ সুন্দর দেখতে। এ ঘরটা প্রতি বছরই নতুন করে বানাতে হয়। সারা বছরের রোদ বৃষ্টি তে নষ্ট হয়ে যায়। গত সপ্তাহে সোনালী খড় দিয়ে বাধানো চালাঘরের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। আমরা এ ঘরটাতে আমন ধান রাখি।
নবান্নের শীতে পিঠাপুলির উৎসবে পাড়া প্রতিবেশিরা একত্রিত হয়ে আমাদের বাড়িতে রকমারি পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাসিখুশী হয়ে হুইহুল্লোড়, অবশেষে একত্রে খাওয়া। এভাবেই চলছে আমাদের সোনালী সংসারের, সোনালী সময়।
গতকাল পূর্ণিমার আলোয় চকচক করতেছিল উঠান, ঝিঝি পোকার ডাকে মুখরিত পুরো এলাকা।চাঁদ তাঁরারা মিতালি করেছিল একে অপরের সাথে। তাদের সাথে আমরাও গল্প করতে বসে গেলাম। কতো রকমারি গল্পের উদঘাটন! আগের দিনকার কথা আমাকে খুব করে টানে, তাই তো আমি আমার পাশের ঘরের দাদি শাশুড়ী মেহেরজান কে বলেছিলাম, দাদি জীবনে কতকিছুই তো করলা, আমাদের কে কিছু বলো আজকে। তিনি বলেন তাহলে শোন! ভালোই ছিল আমাগো কালের দিনগুলা। তগো দাদায়, করাতের কাম করতো। আসার সময় এক পাতা কক্সো সাবান নিয়ে আইতো। এইগুলো দিয়ে মাস দুহান যাইতো। তগো দাদায় একবার কী করছে হুন তাইলে...
হেরা যেহেতু করাতের কাম করত, তো ঐ হানতনে এক নৌকা, কাঠের গুঁড়ো আনছিলো। আর এগুন গ্রামের সবাইরে ভাগ কইরা দিছিলাম ।কারন কাঠের গুড়োর লগে নিমপাতা দিয়ে আগুন নিভু নিভু করে মাটির পাত্রে রাখলে মশা লাগতনা। সবাই সন্ধ্যার সময় এগুলো জ্বালিয়ে অনেক সময় ধরে গল্প করতে পারতাম।
এভাবেই একেকজন একেক রকমারি গল্প করেছিল। সুন্দর কেটেছিল প্রকৃতির রূপে মার্জিত সময়টা। এতো হাসি-খুশির মাঝেও আমার বৈবাহিক জীবনে কিছু অপ্রকাশিত ব্যথা রয়েছে। একজন সত্যি কারের বধুর জন্য তাঁর স্বামীই সবকিছু, আর আমি আমার স্বামীতে আসক্ত এক কুলহারা বধু। যার খোঁজ নেওয়ার ফুরসত টুকুন পাচ্ছেন না, আমার প্রিয়তম স্বামী। আমাদের পূর্বপুরুষ যেহেতু করাতের কাজ করত, সেই ধারা অব্যাহত রেখে আমার স্বামী ও সে কাজেই গিয়েছে। অবশ্য বিয়ের দু'বছর আগে থেকেই তিনি কাজের সাথে সম্পৃক্ত।
নামকরা মিস্ত্রি তাই যেতে হয় দূর বহুদূর। দূরের কোথাও গেলে মাস ছয়েক পরে একবার আসেন। মাসে মাসে চিঠি লিখে খোঁজ খবর জানিয়ে রাখেন। আজ ন’মাস তেরোতম দিন হল, উনি বাড়ি আসেনা! কোন খোঁজ খবর পাইনা। কোন চিঠিও ডাকবাক্সে পাঠাননি।
যিনি চিঠি এনে দিতেন রোজ তাকে জ্বালাতন করি।বারংবার জিজ্ঞেস করি আমাদের নামে কোন পত্র আসছে কি না? উনি বলেন; চিঠি আসলে তো আমি নিজেই পৌঁছে দিব।
এভাবেই কেটে গেল আর দুটো মাস। উনি আমায় সব সময় বলতেন তুমি চোখে কাজল দিও। আর মনে রেখ আমি যদি পাশে না থাকি তোমার চোখের কাজলে আমাকে ফুটিয়ে রেখো। আমি উনার জন্য সব সময় চোখে কাজল পড়ি, যেন উনি সর্বদা দু'চোখের কাজলে লেপ্টিয়ে থাকে। কিন্তু আজ অনেক দিন হয়েগেল, উনার দেখা নেই। আমার মন ক্ষত হয়ে যাচ্ছে উনার বিরহে। হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়াটা আমার কাছে কেমন যেন মনে হচ্ছে! ভাবতে বসলেও বুক দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবারের চিঠিটা আমিই লিখবো!
ওহে প্রাণপ্রিয় স্বামী,
বহুদিন গত হলো ওহে প্রাণপাখির!
তুমি বিনে সমবিনে আমি চিনতে অতি।
বিরহ বেদনা আমি সহিতেনা পারি,
পত্র দিয়ে শান্তি করো অতি তাড়াতাড়ি।
কোন'বা দোষে দোষী করলে ওহে প্রাণ স্বামী
কবে কোন কথা না শুনেছি আমি?
এ যাবতে কেন আমি পত্র নাহি পাই?
যতদূর জানি মম দোষ নাই।
অথবা-ততবা তুমি কাহাকে করিয়াছ নিকা
উপার্জন করিয়া দাও তারে টাকা দ্বারা-সিকা।
পত্র লিখিয়া পাঠাইলে, আমি অতি সুখী হবো,
পত্র পাইলে মম তোমায় মাথায় রাখিবো।
একি ছিল ভাগ্য আমার, একি ছিল ভাগ্যে লিখিত,
ভাইগ্য আমার ভালো হলে স্বামী খোঁজ খবর নিত।
নিবেদক
আপনার অপেক্ষার দাসী
রাজিয়া খাতুন।
পত্রটা লিখে উনার দেওয়া সেরা উপহার জাপরান শাড়ির আঁচলে মুড়িয়ে ডাকবাক্সে দিয়ে এসেছি। আর উনার থেকে পত্র পাওয়ার আশায় রাত্রি পার করতেছি। উনাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি সেটা জানতে হলে আমার সাথে জীবনের শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে। আর উনি যে চেনা থেকে অচেনা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। এটা বুঝতে পারাটাই হচ্ছে উনার জন্য আমার ভালোবাস।