বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৩, ২১:৩৬

চাঁদপুরের মাটি ও মানুষ

খান-ই-আজম
চাঁদপুরের মাটি ও মানুষ

শৈশব, কৈশোর ও প্রাক-যৌবনের স্মৃতিবিজড়িত চাঁদপুর আমার প্রিয় জন্মস্থান। চাঁদপুরের আলো-বাতাসে অবগাহণ করে আমি দিনে দিনে পলে পলে বেড়ে উঠেছি। চাঁদপুরেই আমার শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। চাঁদপুর শহরের অনতিদূরে গ্রাম বাংলার এক নিভূতপল্লী ডাকাতিয়া নদীর কোলঘেঁষা ছোটসুন্দরে আমার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করি। সময়কাল ১৯৬২-১৯৬৬। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসের কোন এক সকালে চাঁদপুরের শহরতলীতে অবস্থিত তৎকালীন গৌরবময় বিদ্যাপীঠ চাঁদপুর গভঃটেকনিক্যাল হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। ১৯৬৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র বৃত্তিলাভ করি। ১৯৭২ সালে মাধ্যমিক পাস করার মধ্য দিয়ে স্কুল জীবন শেষ হয়। স্কুল জীবনে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন খেলাধুলায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করি। পরে আমি কোটবাড়ি, কুমিল্লায় অবস্থিত রেসিডেন্সিয়াল গভঃ মডেল স্কুলে (যা পরে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ) ভর্তি হয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নপর্ব সম্পন্ন করে ১৯৭৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি। আমার বেশ কিছু সহপাঠী-বন্ধু মাধ্যমিক পাস করার পর শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়ে। অবশিষ্ট বন্ধুদের সিংহভাগ ঐতিহ্যবাহী চাঁদপুর কলেজে ভর্তি হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করে। মাধ্যমিক স্তরের প্রাক্তন বন্ধুদের পেয়ে তাদের এ সময়টা খুবই আনন্দের মাঝে অতিবাহিত করে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সেবার (১৯৭৪) উচ্চ মাধ্যমিক পাসের হার কম থাকায় মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগ পাওয়া অনেকেই অনুত্তীর্ণ রয়ে যায়। জলের মাছ ডাঙ্গায় তুললে যেমনটি হয় উচ্চ মাধ্যমিকে সম্পূর্ণ অজানা পরিবেশে প্রথম দিকে আমার অবস্থা তথৈবচ। স্কুল জীবনের চাঁদপুরের বন্ধুদের ছেড়ে নিজকে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছে, যা আমার জন্য ছিল অনেকটা পীড়াদায়ক। পরীক্ষায় অকৃতকার্য চাঁদপুরের বন্ধুদের সনে দেখা হলে অনেকেই তাদের হতাশার চিত্র তুলে ধরতো, যা আমাকে রীতিমত ব্যথিত করে তুলতো। পরে আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া গভঃকলেজে (বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার শীর্ষস্থানীয় কলেজ) স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হই। আমার চাঁদপুরের প্রাক্তন বন্ধুদের হাতেগোনা ক’জন চাঁদপুর কলেজে স্নাতকে অধ্যয়ন করে। মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে দেখা হলে কী যে আনন্দ হতো তা ব্যক্ত করা সত্যিই খুব কঠিন। ছুটির দিনগুলোতে বাড়ি এসে তাদের সনে এমনভাবে মিশে যেতাম যে তাদের ছেড়ে কুমিল্লা যাবার সময় হলে মনে খুব কষ্ট পেতাম।

স্নাতক পাস করার পূর্বেই কৌতূহলবশত চাকুরির ইন্টারভিউ দিই। স্নাতকের ফল বেরোবার মাত্র কয়েক দিন আগে ব্যাংকের চাকুরিতে যোগদান করি। এটি ১৯৭৭ সালের কথা। পোস্টিং কুমিল্লা শহরের প্রধান শাখা। চাকুরি অবস্থায় সুযোগ পেলেই মাটির টানে যথারীতি চাঁদপুর চলে আসতাম। চাঁদপুরের স্মৃতিবিজড়িত স্কুল ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে আড্ডা ও বিনোদনের বিশেষ বিশেষ স্থান (তখনকার সময় অত্যন্ত রমরমা) ফিশারী ক্যাম্পাস, ওয়াপদা কলোনী, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীরপাড়, চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন (বড় স্টেশন), স্টীমার ঘাট, ডব্লিউ রহমান ও স্টার আলকায়েদ জুটমিল এলাকা ইত্যাদি স্থানে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের আরেকটি আনন্দের অনুসঙ্গ ছিল কয়েকজন মিলে একটি নৌকো কিছু সময়ের জন্য ভাড়া নিয়ে সবাই নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো। কখনো কখনো ফ্লাক্সভর্তি করে চা ও হালকা নাস্তা নিয়ে যেতাম। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চা খাওয়াটা ছিল খুবই তৃপ্তিদায়ক। সর্বোপরি সিনেমা দেখার প্রচণ্ড নেশা থাকায় চিত্রলেখা, ছায়াবাণী ও কোহিনুর সিনেমা হলে (আজ এসবের অস্তিত্ব নেই)। প্রাক্তন বন্ধুদের সনে দলবেঁধে সিনেমা দেখতাম। কখনো কখনো সিনেমার টিকেট কালোবাজারীদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ বেঁধে যেতো। টিকেট কাউন্টারে ভিড়ের মধ্যে অনেক সময় হাত রক্তাক্ত হতো। সিনেমা হলেগুলোতে দর্শকপ্রিয় কোনো কোনো ছবি চলাকালীন এমন ভীড় লেগে যেতো যে দ্বিগুণ তিনগুণ দাম দিয়ে কালোবাজারীদের কাছ থেকে টিকিট কিনে লোকজনকে সিনেমা দেখতে হতো। বাস্তবতা হলো এখনকার তুলনায় তখন বিনোদনের সুযোগ খুব কম থাকায় সর্বস্তরের মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। ২/১ জন মেয়ে বন্ধু সঙ্গে থাকলে লুকিয়ে খুবই সন্তর্পণে ড্রেসসার্কেল বা ব্যালকনিতে বসে সিনেমা দেখতে হতো, যা তখনকার সময়ে রীতিমত ব্যয়বহুল ছিল।

আমাদের বিনোদনের আরেকটা অনুসঙ্গ ছিলো দূরের কোন দিঘি অথবা ডাকাতিয়া নদীতে স্নান করা ও সাঁতার কাটা। ২/১ জন ভীতু বন্ধু কুমিরের ভয়ে নদীতে নামতে না চাইলে আমরা জোর করে তাদেরকে নদীতে নামিয়ে দিতুম। চাঁদপুর কলেজ মাঠে প্রতি বছর নিয়মিত ফুটবল লীগ খেলার আয়োজন করা হতো। স্থানীয় খেলোয়াড় ছাড়াও ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানের স্বনামধন্য খেলোয়াড়গণের ক্রীড়ানৈপূণ্য আমরা প্রাণভরে উপভোগ করতাম এবং খেলা চলাকালে বাদাম চিবুতাম। সত্যিকথা বলতে কী আড়ালে-আবডালে আমরা মাঝে মাঝে সিগারেট ফুঁকতাম। তবে নেশা করে নয়, অনেকটা কৌতূহলবশত কিংবা বিলাসিতা করে।

এমনিভাবে চাঁদপুরের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে যেতাম যে সবসময় চাঁদপুরের প্রতি একটা দুর্বার আকর্ষণ অনুভূত হতো। সুযোগ পেলেই ছাত্রজীবন কী কর্মজীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও চাঁদপুরে ছুটে এসে বন্ধুদের খুঁজে বের করে দলবেঁধে আড্ডা কিংবা সিনেমা হলে ভীড় জমাতাম।

আজ ৬৭ বছরে পদার্পণ করেও শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো দিনগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় ও নস্টালজিক করে তোলে। কখনো কখনো নিদারূণ বিষণ্নতা বোধকরি, যখন সহপাঠী কিংবা কোন বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ পাই। আগেই বলেছি, চাঁদপুরে আমার পড়ালেখা ও অবস্থানকাল মাধ্যমিক স্তর পর্যন্তই। তথাপি জন্মস্থান চাঁদপুর আমার অন্তরে লালিত আজীবন স্বপ্নের লালন ভূমি। তাইতো জীবনের শেষপ্রান্তে (অবসরজীবনে ২০১৬) এসে চাঁদপুরের মাটিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়ে অসমবয়সী বন্ধুদের (অনেকেই পুত্রতুল্য), বিশেষত কবি-সাহিত্যিক-লেখক ও গবেষকদের সাথে সময় কাটানোর নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত রেখেছি। জানি না, এ আনন্দঘন সময় কতটা স্থায়ী হবে! আমার জন্মস্থান চাঁদপুরের মাটিতে মিশে যাবার সৌভাগ্য যেন আমার ললাটে লেখা হয় তারই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়