প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
বন্ধু এগ্রো ফার্ম
চাঁদপুরে অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে গরু
চাঁদপুর শহরের জিটি রোড উত্তর মহল্লায় বন্ধুরা মিলে দিয়েছে গবাদি পশুর খামার। তার নামকরণ করেছেন বন্ধু এগ্রো ফার্ম। অনলাইনে এবারই প্রথম পশু বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। তারা এর আগে একসঙ্গে গরুর লালন-পালন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেন।
|আরো খবর
বন্ধু এগ্রো ফার্মে যে কোনো সময়েই গরু ক্রয় করতে পারবেন ক্রেতাগণ। তবে এখন গরুর বিক্রেতা হিসেবে সব তথ্যই ক্রেতাদের দিচ্ছেন। তারা বলেন, ভিডিওতে গরু নিয়ে কথা বলছি। অনলাইনে গরুর ওজন, কয়টা দাঁত, মাংস কতটুকু পাওয়া যাবে, ক্রেতাদের এ ধরনের জটিল সব প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছেন তারা। লাইভে বা ভিডিওতে তাদের গরু নিয়ে কথা হয় ক্রেতাদের সাথে। এমনকি এই উদ্যোক্তাদের ফেসবুক পোস্টও গরুর ছবিতে ভরে যাচ্ছে। এখন অনেকেই পারিবারিক প্রোগ্রাম, বিবাহ-শাদি ও মেজবানির জন্য অনলাইনে আমাদের থেকে গরু ক্রয় করছেন। যুগের প্রেক্ষাপটে মানুষ এখন আধুনিক হয়েছেন। তাই হাটে না যেয়ে ঘরে বসেই অনলাইনে আমাদের থেকে গরু ক্রয় করছেন।
বন্ধু এগ্রো ফার্মের কাউসার আহমেদ মানিক অনলাইনে গরু কেনা প্রসঙ্গে চাঁদপুর কণ্ঠের কৃষিকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, বিগত বছর আগেও নিজেদের ফার্মের গরু কোরবানি দিতাম। তবে বিভিন্ন ঝামেলায় ফার্মটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। করোনার সময়ে হাটে গিয়ে কোরবানির গরু কেনার পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক। তাই অনলাইনে গরুর ছবি দেখিয়ে গরু কিনতে উদ্বুদ্ধ করি আমি এবং আমার উদ্যোক্তা বন্ধুরা। আমরা বন্ধু উদ্যোক্তারা সেই বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। এখন অনায়াসে যে কোনো মানুষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ওজনের ষাঁড় আমাদের থেকে ক্রয় করে নেন।
জোবায়ের হোসেন নামে এক ক্রেতা বললেন, ‘উদ্যোক্তাকে শুধু বলেছিলাম, এক লাখ টাকার মধ্যে একটি গরু কিনতে চাই। তিনি ২০৫ কেজি ওজনের গরু দেখালেন, তা পছন্দ হয়ে গেল। পরে কিনে ফেললাম। সবকিছুই এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।’
জোবায়ের হোসেন আরও বলেন, চাঁদপুরে আমাদের গ্রামের যুবকরা অনলাইনে ব্যবসা করছেন, তাদের স্যালুট জানানো প্রয়োজন। অর্থনীতিকে সচল রাখার পাশাপাশি পুরো পরিবারকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করছেন, অনেক যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বন্ধু এগ্রো ফার্মের লাখের বেশি সদস্যদের লিংক রয়েছে। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) প্রেসিডেন্ট আতিয়া পারভীন জানালেন, প্রথম উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কোরবানির গরু ক্রয় করার সুযোগ পেয়েছেন। উদ্যোক্তারা গরুর ছবি দিয়ে তার ওজনসহ বিভিন্ন তথ্য জানিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন। ক্রেতারা ছবি দেখে পছন্দ হলে উদ্যোক্তার সঙ্গে ম্যাসেঞ্জার বা টেলিফোনে কথা বলে দরদাম ঠিক করছেন।
উদ্যোক্তাদের অন্যতম মোঃ শাহ আলম আখন্দ বলেন, ‘আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন থেকেই গরু নিয়ে কাজ করার কথা চিন্তা করতাম। তবে এ খাতে বিনিয়োগ করতে সাহস পাইনি। অথচ বর্তমানের উদ্যোক্তারা অনলাইনে অনেক ধরনের ব্যবসা করছেন। আমরা বন্ধুরা মিলে এই প্রথম সবসময়ের জন্য অনলাইনে ক্রেতারা যাতে গরু ক্রয় করতে পারেন সেই উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এত দিন যত উদ্যোগ নিয়েছি, তার মধ্যে এবারের উদ্যোগটা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। কোরবানির বাইরেও বন্ধু এগ্রো ফার্ম থেকে সারা দেশে গরু ডেলিভারি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’
ওই ফার্মের মাশিকুর রহমান বলেছেন, রোজার ঈদের পরেই গরু কিনে খামারে লালন-পালন করছেন। তার সঙ্গে রোববার রাতে টেলিফোনে যখন কথা হয়, তখন তিনি জানান, অনলাইনে হাজীগঞ্জের একজন ক্রেতা একসঙ্গে ৫টি গরু নেবেন বলে কথা হয়েছে। শাহরাস্তির আব্দুল মান্নান বলেন, তিনি সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করেন। তিনি অনলাইনে গরু বিক্রির ছবি দেখেন। তার পছন্দমত ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যে একটি গরু ক্রয় করেন। মাশিকুর রহমান আরো জানান, আমাদের যেহেতু খামার আছে, তাই সব গরু বিক্রি না হলেও তেমন সমস্যা নেই।
শামীম ও রিয়াদ বলেন, আমরা বন্ধুরা গরু নিয়ে অনলাইনে এবারই প্রথম ব্যবসা করছি। আলাপের শুরুতেই জানালেন, তিনি ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালোই সাড়া পাচ্ছেন। এ পর্যন্ত অনলাইনে ৯টি এবং ফার্ম থেকে সরাসরি ১৫টি গরু বিক্রি করেছেন। অনলাইনের ক্রেতাদের ট্রাকে করে গরু বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। অনলাইনে অনেক ক্রেতা দ্বিধায় থাকেন, ছবিতে বা ভিডিওতে দেখা গরুর সঙ্গে বাস্তবের গরুর মিল পাবেন কি না। আমরা অনলাইনে গরুর ছবি ও ওজনসহ দাম উল্লেখ করে দেই। এতে কোনো প্রতারণার সুযোগ নেই। এ পর্যন্ত যারা গরু ক্রয় করেছেন তাদের থেকে কোনো ধরনের অভিযোগ পাইনি। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে সততার সাথে এগ্রো ফার্মের পরিচালনা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
উদ্যোক্তা সদস্য রাজন আখন্দ জানান, এবার কম দামের ছোট গরুর চাহিদা বেশি। জেলা পর্যায়ের চাষিদের থেকে গরু সংগ্রহ করে লালন পালন করি। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কিছু মানুষ থেকে কটু কথা শুনেছিলাম গরু নিয়ে কাজ শুরু করার পর, কিন্তু সবার থেকে সহায়তাও পেয়েছি অনেক বেশি। তাই তো সাহস করে আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছি।’
উদ্যোক্তারা বললেন, অনলাইনে ক্রেতারা যেমন দ্বিধায় থাকেন, তেমনি বিক্রেতারাও দ্বিধায় থাকেন। গরু ডেলিভারি দেওয়ার পর ক্রেতা যদি পুরো টাকা না দেন, সে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্রেতারাও গরু হাতে পাওয়ার আগে টাকা পরিশোধ করতে ভরসা পান না। তারপরও আমাদের এমন কোনো সমস্যা হয়নি যাদের ক্রেতা হিসেবে পেয়েছি। তাদের থেকে অনেক উৎসাহ পেয়েছি। বেশ সাড়াও পাচ্ছি। এ পর্যন্ত সব থেকে বেশি দুই লাখ টাকার দামড়া গরু বিক্রি হয়েছে। দুজন খামারির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী অনলাইনে গরু বিক্রি করছি। ক্রেতারা গরুর ছবি দেখে পছন্দ হলে খামারির সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। গরু বিক্রি হলে তার লাভের একটি অংশ পান স্থানীয় খামারিরা।
গত বছর অনলাইনে ৬টি গরু বিক্রি করেছিলেন। এবারও ১০টির বেশি অর্ডার পেয়েছেন। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ক্রেতারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আর তিনি দেশি গরুগুলো প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন।
বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা সাধারণত গরু কিনেন সফরমালী ও বাকিলা হাট থেকে। এখন অনেকেই বন্ধু এগ্রো ফার্ম থেকে গরু ক্রয় করছেন। ফার্মে শাহীওয়াল, ফ্রিজিয়ান ক্রস, দেশি, গ্রির বা নেপালি জাতের ষাঁড় এ বছর কোরবানির জন্য বিক্রি করা হবে। একেকটি গরুর ওজন ২৪০ থেকে ৬০০ কেজি বা তারও ওপরে।
ফার্মটিতে লাইফওয়েটে গরুর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ৫০০ কেজির ওপরে একটি গরুর প্রতি কেজির দাম ধরা হচ্ছে ৫৪৯ টাকা। এছাড়া ৪০০ থেকে ৪৯৯ কেজি ওজনের গরুর প্রতি কেজির দাম ধরা হচ্ছে ৫২৯ টাকা, সাড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি ওজনের গরুর প্রতিকেজি দাম ধরা হচ্ছে ৪৯৯ টাকা, ৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি ওজনের গরুর প্রতি কেজির দাম ধরা হচ্ছে ৪৯৯ টাকা, ২৭৫ থেকে ২৯৯ কেজি ওজনের গরুর প্রতি কেজির দাম ধরা হচ্ছে ৪৪৯ টাকা এবং ২২৫ থেকে ২৭৪ কেজি ওজনের গরুর প্রতি কেজির দাম ধরা হচ্ছে ৪৪৯ টাকা।
ফার্মটিতে পাহাড়ি গয়াল জাতের গরু রয়েছে পাঁচটি। পরীক্ষামূলকভাবে এই গরুগুলো লালন-পালন করা হচ্ছে। সেই গরুগুলোও এ বছর কোরবানির উপযোগী। এই গরুর চাহিদা বেশি রয়েছে বলে জানানো হয়। এছাড়া কোরবানির উপযোগী ফার্মে ১০টি গাড়লও রয়েছে।
কোরবানির এখনও বেশ ক’মাস বাকি আছে। তবুও এরই মধ্যে অনলাইনে কয়েকটি গরু বিক্রি হয়েছে। কোরবানি ঘনিয়ে আসলে আরো বিক্রি বাড়বে। এখন অনেকেই এসে গরু দেখে যাচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে এই ফার্মের সব গরু বিক্রি হয়ে যাবে বলে উদ্যোক্তারা আশাবাদী। তারা বলেন, চাঁদপুরে আমাদের ফার্মেই শুধু লাইফওয়েটে গরু বিক্রি করা হয়ে থাকে। তাতে ক্রেতারা পরিকল্পনা মাফিক গরু কিনতে পারেন। ফলে ক্রেতারা ঠকে না। এছাড়া এই ফার্মের গরুকে কোনো ধরনের মেডিসিন খাওয়ানো হয় না। সবুজ ঘাস ও ধানের খড় খাওয়ানো হয় বলেই তারা জানান।
চাঁদপুরের জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের প্রদান কর্মকর্তা ডাঃ মোহাম্মদ বখতিয়ার উদ্দিন বলেন, আমার অফিস থেকে এক কিলোমিটার পরেই বন্ধু এগ্রো ফার্ম। এই ফার্মে গরু লালন-পালন হয় ন্যাচারাল ভাবে। অনলাইনে গরু ক্রয়-বিক্রয় অনেক জেলাতেই আছে। চাঁদপুরে আমাদের পরামর্শ নিয়ে তারা শুরু করেছেন। মানুষ এখন আধুনিক হয়েছে। ঘরে বসেই তাদের চাহিদা অনুযায়ী গরু কিনতে পারবেন।