প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:২৪
বীর মুক্তিযোদ্ধা নীলিমা আহমেদ
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো গেরিলা অপারেশনের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। যুদ্ধের খবর আদান-প্রদান, অস্ত্র পৌঁছে দেয়া, যোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, বাড়িতে আশ্রয় দান, খাবার রান্না করে দেয়া, পাকিস্তানিদের গতিবিধির খবর জোগাড় করা এসবই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশটির সিংহভাগ করেছিলেন নারীরা।
|আরো খবর
আর রান্নাবান্না, খাওয়ানো, অস্ত্র এগিয়ে দেয়া, খবর আনা, সেবা করার কথাই যখন উঠে তাহলে বলিÑ বেঁচে থাকার প্রথম অধিকার খাদ্য, যা নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের জোগান দিয়েছেন। যুদ্ধ করতে যে অস্ত্রের প্রয়োজন তাই নারীরা সংগ্রহে রেখেছেন, সময়মতো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। নারীরা যদি গোপনে তথ্য না নিয়ে আসতেন তাহলে কোন্ তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা পদক্ষেপ নিতেন। আর সেবা করা, লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করে সুস্থ না করলে যুদ্ধে না পাঠালে দেশ স্বাধীন হতো কি করে। তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত থাকা সব ব্যক্তিই আমাদের মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সবার ত্যাগ অপরিসীম, তারা আমাদের অহঙ্কার।
শুধু যুদ্ধের সময় নয়, যুদ্ধপরবর্তী সময় অনেক নারী নিজেদের কথা না ভেবে শুধু দেশের জন্যে, জনগণের জন্যে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করেছেন। তাদের একজন হলেন মুক্তিযোদ্ধা নীলিমা আহমেদ। কিশোরী নীলিমার দুরন্তপনাটা মিশে গিয়েছিলো দেশমুক্তির লড়াইয়ে। একাত্তরে বিজয়ী নীলিমা আহমেদ তারুণ্য আর বার্ধক্যের পুরোটা সময় ব্যয় করেছিলেন স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ নাজিম উদ্দিন আহমেদ ও সহযোদ্ধাদের নিয়ে। আমৃত্যু কাজ করেছেন বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে।
১৯৫২ সালের ১২ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নীলিমা আহমেদ। পিতা মৃত রমনী মোহন বৈদ্য, মাতা মৃত সুষমা বৈদ্য। গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানার আরিচপুর গ্রামের মরহুম আমজাদ আলী সরকারের সুযোগ্য পুত্র খ্যাতিমান চিকিৎসক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ ডাঃ নাজিম উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। লেখাপড়া শুরু করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ-ঢাকা থেকে ¯œাতক এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা থেকে বিএড পাস করেন।
১৯৭১ সালে একটি পরিবার থেকে দেশ মাতৃকাকে রক্ষা করার জন্যে বাবা-মার প্রথম সন্তান হয়েও কারও কথা চিন্তা না করে নীলিমা আহমেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে সাহসী নন্দিনীর ন্যায় ঝাঁপিয়ে পরেন। ঘর-সংসারের মায়া তাকে আটকাতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বিশ্রামগঞ্জে গিয়ে বাংলাদেশ ফোর্সেস হাসপাতালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ত্রিপুরায় ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হস্পিটাল’-এর মাধ্যমে তার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ নাজিম উদ্দিন আহমেদ এবং অন্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবী সহযোগে গুলিবিদ্ধ আহত মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার শিকার আহত শরণার্থী, পাকিস্তানি বাহিনীর শেলিংয়ে আহত কিংবা গুলিবিদ্ধ স্থানীয় সীমান্তবর্তী ত্রিপুরাবাসী এবং কলেরাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন। সেই হাসপাতালের তিনিই ছিলেন একমাত্র পাস করা স্টাফ নার্স। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জেনারেল ওসমানীর হাত থেকে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্টিফিকেট লাভ করেন গাজীপুর জেলার একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা নীলিমা আহমেদ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ফোর্সেস হাসপাতালটি ঢাকার সাভারে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নাম করনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সেবা কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করেন। স্বামীর পাশে থেকে তিনিও সমাজসেবা কাজে দেশের বিভিন্ন দুর্যোগের সময় দুস্থদের মানুষদের অর্থ দিয়ে, ওষুধ দিয়ে সাহায্য করেছেন।
১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গ্রামপর্যায়ে স্বাস্থ্য কার্যক্রম আরম্ভ হয়। উক্ত কার্যক্রমে বিভিন্ন পর্যায়ে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এর মাঝে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত টঙ্গী পৌরসভার ১ম নারী কমিশনার হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তিনি অত্যন্ত সততা ও সুনামের সঙ্গে টঙ্গী পৌরসভার কমিশনার হিসেবে ১৯৮২ সাল থেকে ৭ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এলাকায় নিরক্ষরতা দূরীকরণে তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
১৯৭৪ সালে তিনি আমজাদ আলী সরকার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত হন। প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কার্যকালে অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যালয়টি উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে বিদ্যালয়টি কলেজে রূপান্তর হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় উৎসাহিত করতেন। বিদ্যালয়ে ছাত্রীরা ১৯৯০ সালে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ১৯৯১ সালে ভলিবল প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায়ে রানার্স আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
২০০০ সালে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক আয়োজিত ‘স্কুল বির্তক প্রতিযোগিতায়’ রানার্স আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ২০০১ সালে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক আয়োজিত ‘কুইজ প্রতিযোগিতা-তুখোড়’-এ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বিদ্যালয়টি বিগত ৮-৯ বছর ধরে এসএসসিতে শতভাগ পাস, অধিকসংখ্যক জিপিএ-৫, প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি প্রাপ্তিতে গৌরবময় ফলাফল অর্জন করেছে। এতে তার প্রশাসনিক দক্ষতা, কার্যকুশলতা, সাফল্য, কৃতিত্ব ও অবদানের পরিচয় বহন করে। তিনি বিদ্যালয়টিকে বিভিন্ন সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। ২০০৩ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ বালিকা বিদ্যালয়’ হিসেবে স্বীকৃতি সনদ ও ক্রেস্ট অর্জন করে। বর্তমানে এ বিদ্যালয়ে ২টি ‘মহিলা’ ক্রিকেট টিম আছে। টিম ২টি ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আয়োজিত ‘গার্লস স্কুল টুর্নামেন্ট প্রতিযোগিতায়-২০০৯/২০১০’-এ ২য় রানার্স আপ এবং ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে রানার্স আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
নিজের চেষ্টা তার সঙ্গে স্বামীর সহযোগিতার কারণেই তিনি বিনা বাধায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করতে পেরেছেন। পাশাপাশি স্বামীর সব কাজে তিনিও সমানভাবে সহযোগিতা করেছেন। ১৯৮৮ সালে দীর্ঘ প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ডাঃ নাজিম তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে টঙ্গী পৌরসভা, গাছা ইউনিয়ন, পুবাইল ইউনিয়ন ও উত্তর খান, হরিরামপুর, কালীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ১১টি কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিদিন হাতে তৈরি ৩০-৩৫ হাজার আটার রুটি-গুড়সহ এলাকায় দীর্ঘ একমাস বিতরণ করেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সাভারের তৈরি পুষ্টিকর বনরুটি ও টোস্ট বিস্কুটসহ খাবার স্যালাইন বিতরণ করেন এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। উক্ত কার্যক্রমে সর্বিক তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নীলিমা আহমেদ।
নীলিমা আহমেদ বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা গণপরিষদ ও মুক্তিযুদ্ধা ঐক্য পরিষদের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। একাধারে এফএফ কাউন্সিলের সদস্য, টঙ্গী থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন এবং টঙ্গী বাজারে অবস্থিত কমান্ড কউন্সিল অফিসটি দখলবাজদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। মহিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সম্মাননা লাভ করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের সব শ্রেণী-পেশা, অবস্থানের মানুষের সার্বিক জনযুদ্ধ ছিলো। এ যুদ্ধে নারী-পুরুষ উভয়েই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন; কিন্তু এ জনযুদ্ধে নারীর কৃতিত্বের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। বীরশ্রেষ্ঠ, বীর প্রতীক, বীর উত্তম-এর মতো উপযুক্ত স্বীকৃতি পাননি আমাদের মায়েরা। অনেকে পারেননি ভাতা, আবার অনেককের নাম তো মুক্তিযুদ্ধের তালিকাতেই উঠেনি। আবার কেউ কেউ যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি কাউকে বলতে চাননি বলে নিজেও তালিকায় নাম তুলতে চাননি। কিন্তু অসীম সাহসে ভর করে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধের সংবাদ আদান-প্রদান করেছেন। নীলিমা আহমেদ সবদিক দিয়েই ছিলেন আলাদা। মৃত্যু প্রতিটি মানুষের জন্যে এক সত্য বিধান। একদিন সবাইকে চলে যেতেই হয়, রয়ে যায় শুধু তার কর্মফল। জীবনের প্রতিটি সময় দেশ ও দশের জন্যে কাজ করেছেন নীলিমা আহমেদ। ১৪ জুন ২০১৮ বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এ বীর নারী।