শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

কাল ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় বড় স্টেশন বধ্যভূমিতে মঞ্চস্থ হবে

একাত্তরের গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারের নাটক ‘মধ্যরাতের মোলহেড’

একাত্তরের গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারের নাটক ‘মধ্যরাতের মোলহেড’
অনলাইন ডেস্ক

মহান মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুরের বড় স্টেশন ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম ক্যাম্প আর টর্চার সেল। চাঁদপুরে নতুনবাজার-পুরাণবাজার মিলিয়ে অনেক বধ্যভূমি তারা বানিয়েছিল একাত্তরে। সেসব বধ্যভূমির মধ্যে সবচেয়ে বড় নির্যাতন কেন্দ্র ছিল নদীনিবিড় নৈসর্গিক স্থান বড়স্টেশন মোলহেড। এখানেই পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার, শ্বাপদ সৈন্যরা একের পর এক অকথ্য নির্যাতন করতো বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা আর মা-বোনদের। ঢাকা-চট্টগ্রাম-বরিশাল-লাকসাম হতে লঞ্চ ও ট্রেনে আসা যাত্রীদের এখানেই পিছমোড়া দিয়ে হাত বেঁধে, চোখ বেঁধে জমা করা হতো নির্যাতনের উদ্দেশ্যে। রেলওয়ে রেস্টহাউজ, জিআরপি থানা এবং রেলের পরিত্যক্ত ওয়াগনে নারীদের বিবস্ত্র করে বিকৃত যৌনাচারে অকথ্য নির্যাতন চালাতো। দেহের স্পর্শকাতর অংশগুলোকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, সিগারেটের আগুন দিয়ে, ছুরি দিয়ে কেটে তারা আধামরা করে স্তূপ করে রাখতো দিনভর। তারপর রাত নেমে ভোর হলে তাদের মৃতদেহগুলো ফেলে দিতো ডাকাতিয়া-মেঘনায়। মাছের খাবার হতো সেসব লাশ । কতশত জানা-অজানা মানুষ এই বড় স্টেশন বধ্যভূমিতে শহীদ হয়েছে, তা আজও অজানা।

মহান একাত্তরের সেসব লোমহর্ষক নির্যাতনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়েই রচিত হয়েছে নাটক 'মধ্যরাতের মোলহেড'। ইতিহাসের সত্যতাকে পূর্ণাঙ্গ বজায় রেখে মুক্তিযুদ্ধের সেসব বিভীষিকাময় দিনের ঘটনা প্রবাহকে আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে কবি, লেখক ও নাট্যকার সৌম্য সালেক এবং লেখক, গবেষক ও ছড়াকার পীযূষ কান্তি বড়ুয়া রচনা করেছেন 'মধ্যরাতের মোলহেড'। আর এই ঐতিহাসিক কাজটি পরিবেশ থিয়েটারে পরিবেশন করার জন্যে পরিকল্পনা ও নির্দেশনার দায়িত্ব পেয়েছেন সাংবাদিক, নাট্যাভিনেতা ও নির্দেশক শরীফ চৌধুরী।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ও নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনা ও পরিকল্পনায় দেশব্যাপী ৬৪ জেলায় মঞ্চায়িত হচ্ছে গণহত্যা পরিবেশ থিয়েটার। এ ধারাবাহিকতায় চাঁদপুরে আগামীকাল ৩০ নভেম্বর মঙ্গলবার বড় স্টেশন মোলহেডে পরিবেশিত হবে মুক্তিযুদ্ধের সেসব বিভীষিকাময় দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নাটক মধ্যরাতের মোলহেড।

নাটকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি। উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ও সভাপতিত্ব করবেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।

এই আয়োজন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘পরিবেশ নাটক হলো প্রচলিত প্রেক্ষাগৃহের বাইরে গিয়ে অন্যত্র নাটক মঞ্চায়ন। এ পদ্ধতিতে যেকোনো স্থানে মঞ্চায়নের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে নাটক পরিবেশনা সম্ভব। সে কারণেই পুরানো গ্যারেজ, পরিত্যক্ত অস্ত্র কারখানা, অব্যবহৃত কসাইখানা, গির্জা ইত্যাদি স্থান নাট্য কর্মীদের হাতে পড়ে রঙ্গালয়ের মাহাত্ম্য লাভ করেছে। বাংলাদেশে এ ধারণা ভিন্ন মাত্রা পায়। যেখানে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, ঠিক সেখানেই নাটক মঞ্চস্থ করে পরিবেশ থিয়েটার প্রকৃত অর্থে পরিবেশবাদী হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে এ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা আশাবাদী।

মধ্যরাতের মোলহেড নাটকের নাট্যকারদ্বয় সৌম্য সালেক ও পীযূষ কান্তি বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডের অভ্যুদয় কোনো কুসুম কোমল করুণার পরিণাম নয়; এটি নয়মাস দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও ত্যাগের পবিত্র ফসল। তিরিশ লক্ষ বাঙালির রক্তধারা যেমন এতে মিশে আছে, তেমনি মিশে আছে দ’লক্ষ ঊননব্বই হাজার মা-বোনের লুটে নেয়া সম্ভ্রমের বেদনাশ্রু। জল্লাদ-কসাই পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের সাথে যোগ দেয়া এদেশের কুলাঙ্গার রাজাকারদের সম্মিলিত বর্বরতায় সারাদেশ পরিণত হয়েছিল এক বীভৎস বধ্যভূমিতে। সেই আঁচড় থেকে বাদ পড়েনি তিন নদীর সঙ্গমসিক্ত ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরও। মধ্যরাত আমাদের কাছে নির্যাতন আর রহস্যময়তার মিথ, অশনিমাখা যাদুবাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। মোলহেড বধ্যভূমির সেই ঐতিহাসিক স্থান যেখানে রাতভর নির্যাতিত হতো মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি বীরাঙ্গনা মা-বোনেরা। যত প্রত্যক্ষদর্শী আছে এ নির্যাতনের, তাদের সবার চেয়ে মোলহেডই সবসময় পূর্ণাঙ্গভাবে দেখেছে বাঙালি-নির্যাতনের নির্মমতা। কাজেই মধ্যরাতের মোলহেড বাঙালির ইতিহাসে চির জীবন্ত এক সত্তা।

তাঁরা আরো বলেন, বড়স্টেশন এবং মোলহেড ইতিহাসের আরও এক নির্মমতার সাক্ষী। ঊনিশশো একুশ সালের মে মাসে এখানে সংঘটিত হয় এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, যাতে প্রায় তিরিশ হাজার নিরীহ চা-শ্রমিককে খুন করা হয় তৎকালীন বৃটিশ পুলিশ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। এই নির্মমতার ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে সেই একই স্থানে সংঘটিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন পাশবিক নির্যাতন আর গণহত্যা। এই নাটকে সেই ইতিহাসও সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে গুরুত্বের পারম্পর্যতায়। ‘মধ্যরাতের মোলহেড' আমাদের কালের কথক। ইতিহাসের মর্মবাণী তার মাধ্যমেই প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে প্রবহমান থাকবে, এ আমাদের চেতনাদীপ্ত প্রত্যাশা।

নাটকের পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশক শরীফ চৌধুরী বলেন, সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশতর্বষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুরেও মুক্তিযুদ্ধকালীন লোমহর্ষক নির্যাতন ও বিভীষিকাময় সত্য ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছে পরিবেশ থিয়েটারের নাটক ‘মধ্যরাতের মোলহেড’।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে কুলাঙ্গার রাজাকার আলবদর হায়নার দল মুক্তিযোদ্ধা আর বাঙালি মা-বোনদের উপর করেছে অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন। এদেশের বাঙালি নারীদের বিবস্ত্র করে বিকৃত যৌনাচার ও গণহত্যা চালিয়েছে তারা। পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যোগ দিয়ে এদেশের কুলাঙ্গার রাজাকাররা বর্ববরতা চালিয়ে ইলিশপুর চাঁদপুরের বড় স্টেশন মোলহেডকে পরিণত করেছে বীভৎস বধ্যভূমিতে। এই মহান ঐতিহাসিক নাটকের নির্দেশনা দিতে পেরে আমি হয়েছি গর্বিত। আর এই গুরুত্বপূর্ণ মহান দায়িত্বটি আমাকে দেয়ায় আমি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ভাইয়ের প্রতি পরম আন্তরিকতার সাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

তিনি আরো বলেন, ‘মধ্যরাতের মোলহেড’ শুধুমাত্র একটি নাটকই নয়, নয় কোনো নিছক ইতিহাস। এ হলো বাংলাদেশের জন্মের আর্তনাদ। এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে স্বাধীন ভুখণ্ডের জন্ম ক্রন্দনের ইতিহাস। এই ইতিহাসের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত ‘মধ্যরাতের মোলহেড’ নাটকের নির্দেশনা দেয়ার গুরু দায়িত্বটি আমার জন্য একটি ইতিহাস। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের অনুপ্রেরণায় সাহস করেছি নাটকটির নির্দেশনা দেয়ার। গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারে এ ধরনের নাটক এটাই আমার জীবনের প্রথম নির্দেশনা। তাই হয়তো অনেক ভুলত্রুটি হতে পারে, সবাই ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আমাকে সংশোধন হবার সুযোগ করে দিবেন বলে আমার বিশ্বাস। ‘মধ্যরাতের মোলহেড’ নাটকের নির্দেশনা দিতে গিয়ে যাঁরা আমাকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহ জুগিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। চাঁদপুর থিয়েটার ফোরামের সদস্য সংগঠনগুলোর মঞ্চশিল্পীরা এক ও অভিন্ন হয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির রেপাটরি নাট্যদলের হয়ে এই নাটকে কাজ করেছেন, সে সকল সংগঠনের দল প্রধানদের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই নাটকের কলা-কুশলি, মঞ্চশিল্পী সকলের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। ২৯ নভেম্বর কারিগরি প্রদর্শনী হলেও ৩০ নভেম্বর ২০২১ প্রথম প্রদর্শনী হিসেবে বড় স্টেশন মোলহেডে গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারে ‘মধ্যরাতের মোলহেড’ নাটকটিতে ভিন্নমাত্রা খুঁজে পাওয়া যাবে আশা করি। এ নাটকের প্রযোজনা অধিকর্তা, অনুষ্ঠানের সভাপতি আমাদের অভিভাবক চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ-এর কাছেও আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আমার চলার পথের সঙ্গী, জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার, নাটকের প্রধান সমন্বয়কারী সৈয়দ মুহম্মদ আয়াজ মাবুদ প্রতি মুহূর্তে আমাকে সাহস ও উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন-এজন্য তাঁর প্রতি আমি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, জানি না, নাটকের শিল্পীরা তাঁদের অভিনয়ের নৈপুণ্য দিয়ে কতটুকু দর্শকদের দিতে পারবে। যতটুকু চেষ্টা করেছি ভালো কিছু করবার। বিচারের দায়-দায়িত্ব সবটুকু ছেড়ে দিলাম আমার প্রিয় নাট্যামোদী দর্শকের উপর। পরিশেষে আবারো বলছি, একাত্তরের সেই রাজাকারদের কোনো ক্ষমা নেই। যারা আমাদের দেশের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে, অত্যাচার করেছে, তাদের কোনো ক্ষমা নেই। যারা এ দেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে তাদের কোনো ক্ষমা নেই-ক্ষমা নেই।

কালকের প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি, উদ্বোধক-বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ও সভাপতিত্ব করবেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।

পারিপার্শ্বিক অবস্থা : চাঁদপুর বড় স্টেশনের সম্পূর্ণ দক্ষিণ পাশে ডাকাতিয়া নদী, যা মেঘনায় মিশেছে; পশ্চিম পাশে প্রমত্তা মেঘনা, পূর্ব পাশে রেলওয়ে ক্লাব, রেলওয়ে শ্রমিক কলোনী, রেলওয়ে সুইপার কলোনী, রেলওয়ে কবরস্থান, রেলওয়ে কলোনী, মাদ্রাসা রোড, যমুনা রোড, বকুলতলা জিআরপি ও লোক কলোনী। বড় রেলস্টেশন এলাকাটি চাঁদপুর শহরের পশ্চিম দিকে। বড় স্টেশনটি একটি সবুজ ত্রিভুজের মতো ভূখ-। মেঘনা-ডাকাতিয়ার সঙ্গমস্থলে যেখানে বিপদজনক ঘূর্ণির অবস্থান। দুরন্ত ঢেউ প্রতি মু¬হূর্তে আছড়ে পড়ে।

এ অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে সুবেদার ইসলাম খানের সাথে পর্তুগীজদের যুদ্ধ এবং মোঘলদের সাথে পাঠানদের যুদ্ধ। এ অঞ্চলেই সংঘটিত হয়েছে ফরায়েজী আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় আসামের চা বাগানে কর্মরত উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু, বিহার প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আনা নিপীড়িত-লাঞ্ছিত দরিদ্র শ্রমিকরা করিমগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর স্টিমার ঘাটে আটক হয়। ১৯২১ সালের মে মাসের একরাতে স্টেশনের আলো নিভিয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গুর্খা সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে অভুক্ত অসহায় শ্রমিকদের উপর। বেয়নেট চার্জে হত্যা করে বহু শ্রমিককে। মৃতদেহগুলো বস্তায় পুরে পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দেয়া হয় মেঘনা নদীতে। এই নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে রেল ও জাহাজের কর্মচারীরা ধর্মঘট করে। কলকাতা থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ নেতৃবৃন্দ চাঁদপুরে আসেন। চা শ্রমিকদের এ যুদ্ধ, লড়াই ও আত্মত্যাগের কাহিনী শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। চাঁদপুরের প্রধান রাজনৈতিক নেতা চাঁদপুর-গান্ধী খ্যাত হরদয়াল নাগ (১৮৫৩-১৯৪২) চা শ্রমিকদের ওপর গণহত্যার প্রতিবাদে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে ১৯৭১ সালে একই স্থানে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক আরেক নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়।

ঘটনাধারা : মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর ছিল গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। কারণ চাঁদপুর নদীবন্দর নৌপথ, রাজপথ ও রেলপথ দ্বারা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সাথে যুক্ত। রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মেজর জেনারেল রহিমের নেতৃত্বে চাঁদপুর এলাকার এক ডিভিশন সেনা মোতায়েন করে। ৭ এপ্রিল চাঁদপুর শহর দখল করে তাদের সামরিক কেন্দ্রগুলো স্থাপন করে। বড় স্টেশন ছিল এর মূল কেন্দ্র। সরকারি টেকনিক্যাল স্কুলে স্থাপিত হানাদার বাহিনীর ৩৯তম অস্থায়ী ডিভিশনের সদর দপ্তর পুরো চাঁদপুর জেলা, চাঁদপুর শহর, নদীবন্দর, মেঘনা-ডাকাতিয়া, ধনাগোদা নৌপথ ঢাকাগামী সামরিক নৌযানের দায়িত্ব পায়। এর অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মুহাম্মদ আতিকউল্লাহ।

পাকিস্তানি বাহিনী বড়স্টেশন এলাকার রেলওয়ে স্থাপনা সমূহ সামরিক কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। তারা সড়ক ও রেলপথে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লার পশ্চিম অঞ্চল এবং নৌপথে মুন্সীগঞ্জ, শরিয়তপুর, ভোলা, বরিশাল, খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষ ও যাত্রীদের ধরে এনে নির্মম অত্যাচার পূর্বক হত্যা করে। ধারণা করা হয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করে মেঘনা নদী ও ডাকাতিয়ার মিলনস্থলে ফেলে দেয়। এ মিলনস্থলে ঘূর্ণির গভীরতা প্রায় নয়শ’ ফুট। পাথর বেঁধে মৃতদেহ ফেলে দিলে তা মুহূর্তেই ২০-২৫ মাইল দূরে চলে যায়।

ঢাকা শহরের সাথে খুলনা, বরিশাল, বাগেরহাট, ফরিদপুর, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের নৌ যোগাযোগ মেঘনা নদী দিয়েই হতো। রাজধানী ঢাকাকে রক্ষা, সামরিক সরঞ্জাম, অভ্যন্তরীণ সৈন্য চলাচল এবং সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ব্যুহ হিসেবে চাঁদপুর নৌ বন্দরকে বেছে নেয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৬৩তম ব্রিগ্রেড ও ১১৭তম ব্রিগ্রেড সংযুক্ত ছিল। তিনটি ব্রিগ্রেডকে মোকাবিলা করতেন সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের এক কোম্পানি শক্তির মুক্তিসেনাদল ও বিএলএফ-এর এফএফ সদস্যরা।

৭ এপ্রিল চাঁদপুর শহর পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তারা চাঁদপুর রেলস্টেশনের অফিসসমূহ, রেলওয়ে রেস্ট হাউজ, নূরিয়া হাই স্কুল, আক্কাস আলী হাই স্কুল, বে শিপিং কর্পোরেশন, ওয়াপদা রেস্ট হাউজ এবং পুরাণবাজারের পুলিশ ফাঁড়ি, পৌরসভার দাতব্য চিকিৎসালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রত্যেকটি ক্যাম্পেই ছিল নির্যাতন কেন্দ্র। বড় রেলস্টেশন ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র। রাজাকার, আল-বদররা বাঙালিদের ধরে নিয়ে আসতো বিভিন্ন ক্যাম্পে এবং বড় স্টেশন টর্চারিং সেলে পাঠিয়ে দিতো। পাকিস্তান বাহিনীর নৌযানগুলো ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত সমগ্র নদীতে টহল দিতো। মাঝে মাঝে লঞ্চ ও নৌযান থামিয়ে যাত্রীদের তল্লাশি করতো। যাকে ইচ্ছে তারা বন্দি করে বড় স্টেশন নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে আসতো। এদের প্রায় বেশির ভাগই গণহত্যার শিকার হতো।

চাঁদপুরে শান্তি কমিটি গঠিত হয় ১১ মে। চাঁদপুরের প্রাক্তন এমএলএ আবদুস সালাম মোক্তার ছিলেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। তার বাড়িতে হতো শান্তি কমিটি ও পাকিস্তানি বাহিনীর সভা। ২১ সেপ্টেম্বর শান্তি কমিটির এক সভায় বক্তারা বলেন ‘আওয়ামী লীগ জনগণের সাথে বেঈমানি করেছে। এই বেইমানদের এমনকি আমাদের বংশধররাও ক্ষমা করবে না।’

স্থানীয় শান্তি কমিটির সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী চাঁদপুর শহর ও শহরতলীতে গণহত্যা, লুট, নারী নির্যাতন, বাড়িতে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রেল, বাস, রাস্তাঘাট, নৌকাসহ আশপাশের গ্রামাঞ্চলে হানা দিয়ে নিরাপরাধ বাঙালিদের ধরে এনে ক্যাম্প সংলগ্ন নির্যাতন কক্ষে নির্যাতন শেষে বড় স্টেশন টর্চারিং সেলে পাঠিয়ে দিতো। মেজর ইফতেখারের নেতৃত্বে চলে জঘন্য অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন।

মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী সন্দেহে রাজাকাররা বড় স্টেশনের মূল নির্যাতন ক্যাম্পে চালান দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা এই ক্যাম্পে নারকীয় গণহত্যা চালায়। অত্যাচার-নির্যাতনের সমস্ত উপায় তারা অবলম্বন করতো। এমনিভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই ক্যাম্পে মারা যেত অথবা শেষ অবধি গুলি করে অথবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বা এসিড দিয়ে তাদের মেরে ফেলা হতো। যেহেতু বড় স্টেশনের পাশেই মেঘনা নদী, কাজেই তাদের এখানে কোনো লাশ গুম করতে বা গর্ত করে মাটি চাপা দেয়ার জন্য বধ্যভূমি তৈরি করতে হয়নি। রাতভর অত্যাচার করে হত্যার পর ভোররাতে এক সাথে ২০-৩০ জনের লাশ মেঘনায় ফেলে দিতো।

বড় স্টেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রেলওয়ে বড় স্টেশনের অফিসার্স রেস্ট হাউস, জিআরপি থানার পাশে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুম ছিলো হানাদারদের নির্যাতন ক্যাম্প। জল্লাদখানায় ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাসদস্য জল্লাদ শওকত। অনেক সময় মেঘনা নদীর পাড়ে নিয়ে লাইন ধরিয়ে ব্রাশ ফায়ার করেও নদীতে ফেলে দিতো। সংখ্যা বেশি হলে ডোম তলব করা হতো। তাদের দিয়ে লাশ রেলওয়ে ওয়াগনে তুলে নদীতে ফেলে দিতো। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বে ফিশিং কর্পোরেশনের পেছনে বাঙালিদের হত্যা করে ২০-৩০ জনকে এক সাথে লোহার তারে গেঁথে নদীতে ফেলে দিতো যেন লাশ না ভাসে।

চাঁদপুর পৌরসভার ডোম ব্রজনাথ একাত্তরে পুরাণবাজার হরিজন কলোনিতে বাস করতেন। নতুনবাজারে ডোমের কাজ করতো তার শ্যালক ছুনুয়া ও গয়াপ্রসাদ এবং তার নিকাত্মীয় দেওয়া ও বাঙালি। পুরাণবাজারের বড় স্টেশন নির্যাতন ক্যাম্পে পুরুষ ও মহিলাদের ওপর নির্যাতনের খবর পেতেন ছুনুয়া ও গয়াপ্রসাদের কাছ থেকে। তাদের ভাষ্য এ রকম : রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে, জিআরপি হাজতে বা আক্কাস আলী হাই স্কুলে রক্তাক্ত লাশের স্তূপ দেখিয়ে পাকিরা বলতো, ইয়ে জলদি সাফ করো। তাদেরকে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে নদীতে ফেলতে হতো এবং ভোর হবার আগেই নির্যাতন কক্ষের স্থান পরিষ্কার করতে হতো। সারারাত ধর্ষণের পর ভোর বেলা মহিলাদের রেলওয়ে মালগাড়ির ওয়াগনে ঢুকিয়ে বাহির করে তালা মেরে রাখতো এবং পরবর্তী রাতে আবার ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করতো। স্কুলগামী ১২-১৪ বছরের ছেলে-মেয়েদেরকেও একইভাবে বলাৎকার করতো এবং ওয়াগনে ঢুকিয়ে রাখতো।

চাঁদপুর শহর এবং শহরতলী এলাকার স্কুল-কলেজের ছাত্রী, মেয়ে, সুন্দরী নারীদের ধরে নিয়ে আসতো রাজাকাররা। পাঞ্জাবি, বিহারি, পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা জিভ চাটতে চাটতে বাঙালি রমণী বোঝাই ওইসব যানের সামনে এসে দাঁড়াতো এবং সেসব যান থেকে টেনে হিচঁড়ে নামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধর্ষণে মেতে ওঠতো। গয়া ও ছুনুয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে ব্রজ বলেন, বহু যুবতী মেয়েকে জল্লাদখানার বারান্দায় টানানো মোটা লোহার তারের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সৈন্যরা প্রতিদিন সেখানে যাতায়াত করতো এবং সেই যুবতীদের দেহের কোমরের মাংসে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করতে থাকতো, কেউ তাদের স্তন নিয়ে যেতো, কেউ উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে স্তনের মাংস তুলে নিয়ে অট্টহাসি হাসতো। এতে অনেকের মৃত্যু হতো। পরে ক্ষত-বিক্ষত লাশ তারা পায়ে রশি দিয়ে বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়ার জন্য ট্রাকে তুলে দিতো।

এখানে শহীদ হন রেহান উদ্দিন বেপারী, ফয়েজ আহম্মেদ ও হরিপদ দত্ত। রেহান উদ্দিন ছিলেন চাঁদপুর শহরের চিত্রলেখা সিনেমা হল মোড়ে ‘কালু এন্ড তুফান’ মাইক সার্ভিসের মালিক। আওয়ামী লীগের সমর্থক রেহান উদ্দিন কখনও জামায়াত বা মুসলিম লীগকে মাইক ভাড়া দিতেন না। মুসলিম লীগ নেতা সালাম মোক্তার পরবর্তী সময়ে চাঁদপুর মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান-এই কারণে রেহানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। ৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা চাঁদপুর শহর দখল করে নিলে রেহান শহর ছেড়ে পালিয়ে যান এবং ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে দেখার জন্য গোপনে বাসায় আসতেন। ১৮ জুলাই গোপন খবরের ভিত্তিতে ১৫-১৬ জন বেলুচ মিলিশিয়া মেজর তৈমুরের নির্দেশে তাকে ধরে নিয়ে যায়। চাঁদপুর বড় স্টেশন টর্চার সেলে নেয়ার পর চলে নির্মম অত্যাচার। তার হাত-পা ভেঙ্গে ফেলা হয়। দাঁত উপড়ে ফেলা হয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সালাম মোক্তার সে সময় তৈমুরের সামনে উপস্থিত ছিলেন। ২৫ জুলাই ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণ পাড়ে মেঘনা সংলগ্ন খালে রেহানউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়।

শহীদ হরিপদ দত্তের পিতা বঙ্গচন্দ্র দত্ত ছিলেন আইনজীবী ও কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা। তাদের মুন্সেফ পাড়ার বাড়িতে মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এসেছিলেন। বঙ্গ চন্দ্র দত্ত ১৮৯৯ সালে চাঁদপুর জেলার প্রথম ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় হরিণা চালিতাতলী এডওয়ার্ড একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। হরিপদ দত্ত ছিলেন স্কুলটির সভাপতি। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, চাঁদপুর বণিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচিত কমিশনার। পৌরসভার নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সালাম মোক্তার। তখন কমিশনারদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতো। সালাম মোক্তার কমিশনারদের ভোটের পূর্ব মুহূর্তে আটকিয়ে রাখেন ও ১ ভোটে বেশি পেয়ে নির্বাচিত হন। এ বিষয়টি হরিপদ দত্তের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

১৮ জুলাই শহরের কোড়ালিয়া রোডের অশি^নী মোক্তারের দালানের চিলাকোঠা থেকে চাঁদপুর মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি সালাম মোক্তারের নির্দেশে দালাল মান্নান মিয়ার ছেলে রাজাকার মুনীর হরিপদ দত্তকে ধরে নিয়ে আসে। তার আগে বাড়ির প্রবীণ কেয়ারটেকার প্রিয়লালকে তারা ভীষণ মারধর করে এবং হরিপদ দত্তের খোঁজ করে। মারের চোটে সে খবর বলে দেয়। তারপর হরিপদ দত্তের ওপর চলে নির্মম অত্যাচার। সালাম মোক্তার ও মান্নান মিয়া গভীর রাতে হরিপদ দত্তকে বড় স্টেশনস্থ হানাদার বাহিনীর বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের প্রধান মেজর তৈমুরের নিকট হস্তান্তর করেন। সেখানে বন্দি ছিলেন ১০ দিন। সেখানেও চলে অমানুষিক নির্যাতন। ২৮ জুলাই তাকে হত্যা করে লাশ মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। ৩০ জুলাই হরিপদ দত্তের ক্ষতবিক্ষত লাশ বহরিয়া এলাকায় মেঘনা নদীর তীরে পাওয়া যায়। এসব তথ্য জানিয়েছেন তার সন্তান দেবব্রত দত্ত (৮১)।

নরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী (৭১) পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং তাকে লকআপে ঢুকিয়ে অত্যাচার শুরু করে। তার বাম চোখ ফুলে যায়। পরদিন তাকে নিয়ে যায় এসডিও অফিসে স্থাপিত মেজর তৈমুরের অফিসে। মেজর তৈমুর তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। স্টেটম্যান অব ফ্যাক্টস দেয়ার জন্য পরদিন বেলা আড়াইটায় তাকে হাতকড়া লাগিয়ে পালের বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটিয়ে মেজর তৈমুরের ক্যাম্পে নেয়া হয়। তাকে মুক্ত করার জন্য তার মা নানাজনের কাছে ছুটাছুটি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ছাড়া পান। রেলওয়ের মালখানার একটি কক্ষে তাকেসহ ধরে আনা আরও ২০-২৫ জন বাঙালিকে রাখা হয়। সেই কক্ষটিকে বড়জোর ৫-৬ জন লোকের থাকার জায়গা ছিল। কক্ষ থেকে একজন করে বন্দিকে দুজন হানাদার সেনা ধরে নিয়ে যেত। কিছুক্ষণ পরই বন্দির আর্তচিৎকার এবং মারধরের শব্দ ভেসে আসত। এক সময় তাকেও নিয়ে যায় এবং দুজন বর্বর সৈন্য মারতে থাকে। এক সময় বেয়নেট চার্জ করে বন্দিটিকে হত্যা করে। সারারাত ধরে একই ঘটনা চলতে থাকে। ভোর হওয়ার আগেই ২২ জন বন্দিকে হত্যা করে। তিনি দেখেছেন স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কী করে সুপারি কাটার ছুরতার মতো যন্ত্র দিয়ে বন্দির আঙ্গুল কেটেছে পাকিস্তানি বাহিনী। কী করে এক ধরনের হুক দিয়ে টেনে জীবন্ত বন্দির পিঠের চামড়া টেনে তুলেছে হানাদার সদস্যরা। তিনি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পান।

দেবাশীষ কর মধু তার পিতা শহীদ প্রিয়লাল কর ওরফে কালীবাবুকে অত্যাচার-নিপীড়নের বর্ণনা দিয়েছেন। নভেম্বর মাসের দিকে দুপুর বেলা পালবাজার সংলগ্ন বকুলতলার বাসা থেকে তাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা হাত পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলে। এ অবস্থায় দেবাশীষ কর ও তার ছোট ভাই কাঁদতে কাঁদতে পেছনে ছুটতে থাকেন। তাদেরকেও মারধর করা হয়। প্রিয়লাল করের ছেলে দিলীপ কর ও ভাইপো শিবপ্রসাদ কর ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। সে সূত্রে তাদের বাসায় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আসতেন। আলোচনা হতো। কালীবাবু তাতে সমর্থন জোগাতেন। কালীবাবুকে বকুলতলা রোড দিয়ে হাঁটিয়ে স্ট্যান্ড রোডে থাকা লাকড়ির দোকান থেকে ১ মণ ওজনের একটি লাকড়ির বোঝা পিঠে বেঁধে দেয়। তারপর হাঁটিয়ে ৩নং কয়লাঘাট দিয়ে বড় স্টেশন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তিনি তখন পানির জন্য চিৎকার করলে হানাদার ও তাদের দোসসরা প্রস্রাব করে পানি খাওয়ার জন্য বলে। পরদিন সন্ধ্যায় আহত ও নির্যাতিত অবস্থায় ফিরে আসেন। পিতার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে দেবাশীষ কর মধু বলেন, বড় স্টেশনে ধরে নেওয়ার পর তিনি আরও ১৩-১৪ জন বাঙালিকে দেখতে পান। সকল বন্দির ওপর চলে নির্মম অত্যাচার। জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত চলে মারধর। অত্যাচারের মধ্যে ছিল চোখে মুখে গরম পানি ঢালা, উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা, হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া। জিজ্ঞাসাবাদের পর নদীর পাড়ে নিয়ে এক একজনকে গুলি করে হত্যা করতে আরম্ভ করে পাকিস্তানি বাহিনী। তিনি ছিলেন সবার পেছনে। কর্নেলের কাছে অনুনয়-বিনয় করে তিনি মুক্তি পান।

একাত্তর সালে চাঁদপুর ফায়ার ব্রিগেডের ইনচার্জ মোঃ জয়নাল আবেদীন (৮১) স্মৃতিচারণ করে বলেন, কর্নেল বশির খান ও মেজর অনোয়ার শাহ বড় স্টেশন নির্যাতন ক্যাম্পে পানি সরবরাহ করার জন্য তাকে নিয়োজিত করেন। স্টেশন এলাকায় স্থাপিত বন্দি শিবিরগুলোতে খাবার পানি দেয়া, রক্ত ধুয়ে ফেলা, লাশ রাখার রেলওয়ে ওয়াগনগুলো ধুয়ে ফেলার জন্য ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি চাঁদপুর ডাকাতিয়া-মেঘনা নদীর মধ্য দিয়ে হাজার হাজার লাশ ভেসে যেতে দেখেছেন। লাশগুলোকে চিংড়ি মাছে খেত। কেউ বাজার থেকে চিংড়ি মাছ ক্রয় করতো না। ৭ ডিসেম্বর চাঁদপুর শহর থেকে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে সালাম মোক্তার রাত ১২টার সময় তার নিকট একটি গাড়ি চান। সালাম মোক্তারের পরিবার লঞ্চে ঐ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে ঢাকায় পালিয়ে যান। কিন্তু তার ব্যক্তিগত ডায়েরিটি ভুলে গাড়িতে ফেলে যান। ডায়েরিটি পরে সাব-সেক্টর কমান্ডার সুবেদার মেজর জহিরুল হকের নিকট জমা দেন। ডায়েরিটি থেকে জানা যায় তিনি কত লোককে হত্যা করেছিলেন।

অলি গাজী (৬৭) ছিলেন চাঁদপুর রেলস্টেশনের কুলী। রাতে প্রায়ই স্টেশন এলাকায় থাকতেন। সাক্ষাৎকারে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের কথা বলেছেন। বলেছেন, শত শত নারীর আর্তচিৎকার, বন্দিদের করুণ আর্তি এখনও শুনতে পাই। যুদ্ধের পর বহুদিন আমি ঠিক মতো ঘুমাতে পারিনি। মরে যাওয়া বন্দিদের লাশ ফেলে দেয়ার জন্য অন্য একটি কক্ষে জমা করা হতো। মাঝে মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের দিয়ে লাশ বহন করাতো।

পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক চাঁদপুর বন্দরে নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি স্থাপনের পর মুক্তিসেনারা বহুবার চেষ্টা করেছে স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাতে। চাঁদপুরে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক পাঠান বাহিনী তথা মধুমতি কোম্পানির সেনারা নদীর পাড় থেকে চেষ্টা করে হামলা চালাতে। ১ আগস্ট রাতে চাঁদপুর অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নৌকামান্ডো মমিনউল্লাহ পাটোয়ারী ও সাথীরা ডাকাতিয়া-মেঘনার মিলনস্থলে নোঙ্গর করা ছয়টি জাহাজ লিম্পেট মাইনের সাহায্যে ডুবিয়ে দেন। ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যা রাতে বড় স্টেশনস্থ বার্মা ইস্টার্ন তেল ডিপোতে বিস্ফোরণ ঘটান। ৯ নভেম্বর মমিনউল্লাহ পাটেয়ারী বীর প্রতীক ও আবদুল হাকিম বীর প্রতীক এবং তাদের সঙ্গী নৌ কমান্ডোরা মেঘনা নদীতে ‘চায়না কোস্টার’ জাহাজটি ডুবিয়ে দেন। ১১ নভেম্বর বন্দি বহনকারী ট্রেনটি বিস্ফোরকের সাহায্যে লাইনচ্যুত করেন। পাঠান বাহিনীর দুর্ধর্ষ দল ২২ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের ওপর মর্টার সেল বর্ষণ করে। এভাবে পাঠান বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। পাকিস্তানি বাহিনী চাঁদপুর এলাকায় বড় স্টেশন বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রে বাঙালিদের ধরে আনা ও পাহারা দেয়ার জন্য অনেক নৌযানকে ব্যবহার করার উপযোগী করেছিল। ‘লোরাম’ তেমনি একটি নৌযান। একাত্তরের ৩০ অক্টোবর ভোর রাতে নৌ কমান্ডো দলের দুর্ধর্ষ মুক্তিসেনারা লন্ডনঘাট নামক স্থানে জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়। ডুবন্ত জাহাজটি দীর্ঘদিন ডাকাতিয়া নদীতে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়েছিল।

পাকিস্তানি বাহিনী যখন ক্যাম্প ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে পালাতে থাকে সেদিন বড় স্টেশনের কাছে বে ফিশিং কর্পোরেশনের ক্যাম্প থেকে বেঁচে যাওয়া নির্যাতনের শিকার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ক্যাম্পের পেছনে তিনটি বাংকারে ১০-১২টি মেয়ের গলিত লাশ এবং ক্যাম্পের ভেতর একটি বস্তায় আধা বস্তা চোখ দেখতে পান। ৮ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল রহিমের পলায়নের মধ্য দিয়ে চাঁদপুর ডিভিশনের পতন হয়। মেঘনা-ডাকাতিয়ার স্রোতের সাথে মিশে যায় অসংখ্য মানুষের রক্তধারা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়