সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২১, ০১:৪৩

স্মার্টফোনেই সর্বনাশ

স্মার্টফোনেই সর্বনাশ
অনলাইন ডেস্ক

তথ্য আদান-প্রদানে মোবাইল ফোন বদলে দিয়েছে শহর ও গ্রামের মানুষের জীবন। পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে মোবাইল কার্যত বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই ডিভাইস কয়েক সেকেন্ডেই পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর অন্যপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। বিজ্ঞানের বদৌলতে বলতে গেলে মোবাইল মানুষের যাপিত জীবনের অতিপ্রয়োজনীয় একটি অংশ হয়ে গেছে। দেশে চলতি বছরের শুরুতে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ছিল সর্বোচ্চ ৯০০ জিবিপিএস। বছর শেষে সেই ব্যান্ডউইথের ব্যবহার দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০০ জিবিপিএসে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই গুণ। অন্যদিকে গত বছরের ফেব্রæয়ারিতে ইন্টারনেটের গ্রাহক ছিল ৯ কোটি ৯৯ লাখ ৮৪ হাজার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে সেই ইন্টারনেট গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ২৭ লাখ ১ হাজারে। এর মধ্যে গত বছরের ফেব্রæয়ারিতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল ৫৭ লাখ ৪৩ হাজার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ লাখ ২ হাজার। কিন্তু অতিরিক্ত মোবাইলের অপব্যবহার দেশের নতুন প্রজন্মকে যেন ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল বলেন, মোবাইলে ইন্টারনেট গেম আসক্তি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্য ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদ ইত্যাদি আসক্তির মতোই। পার্থক্য হচ্ছে- এটি আচরণগত আসক্তি, আর অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি, রাসায়নিক আসক্তি। মস্তিষ্কের যে অংশে (রিওয়ার্ড সেন্টার) ইয়াবা বা গাঁজার মতো বস্তুর প্রতি আসক্তি জন্ম নেয়, ঠিক সেই অংশেই কিন্তু ইন্টারনেট বা গেমের প্রতি আসক্তি জন্মায়। তাই একে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এটা থেকে সন্তানদের দূরে রাখতে পরিবারকে সতর্ক হতে হবে।

সা¤প্রতিক সময়ের কয়েকটি আত্মহত্যা ও অপরাধের ঘটনা মোবাইল ব্যবহারে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। চলতি বছরের ছয় মাসে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় ১৩৯ জন নারী নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা করেছেন অভিভাবকরা। একই সময় জেলার মতলব উত্তর থানায় ৪৩ নারী ও শিশু নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জিডি করা হয়েছে। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে চাঁদপুর সদর মডেল থানায় ৯৭ জন নারী ও কিশোরী নিখোঁজ থাকার বিষয়ে জিডি হয়েছে। শুধু চাঁদপুরের থানাগুলোতে নয়, দেশের অন্যান্য থানাতেও নারী ও কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার জিডি এবং মামলার সংখ্যা উদ্বেগজনক। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, নিখোঁজ এসব নারীর মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজের ছাত্রী, আর বড় একটি অংশ প্রবাসীর স্ত্রী। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন এ্যাপস ব্যবহার করে ছেলেদের প্রতি আসক্ত হয়ে ঘর ছাড়ছেন। আবার ঘর ছেড়ে অনেকেই হচ্ছেন প্রতারিত ও পাচারের শিকার। মাত্র পাঁচ মাসে ৯৭ জন নারী ও কিশোরী নিখোঁজ থাকার তথ্য দিয়ে জিডি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমরা বিষয়গুলো গভীর পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, নিখোঁজ নারীদের বেশির ভাগই প্রবাসীদের স্ত্রী। সাধারণ মানুষের সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ভিগো, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটক এ্যাপসসহ বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করেন। এসবের মাধ্যমে ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের। অনেকে বখাটে যুবকদের পাল্লায় পড়ে ঘর ছাড়ছেন।’ ওসি আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুল-কলেজে পড়া কিশোরীরা ঘর ছাড়ছে। তারাও স্মার্টফোন ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেলেদের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করছে এবং আসক্তি ও নানাবিধ প্রলোভনে পড়ে ঘর ছাড়ছে।’ তার মতে, ‘করোনা সংক্রমণজনিত কারণে স্কুলগুলাতে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়ে মনে করেন, সন্তানরা অনলাইনে ক্লাস করে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক ছেলেমেয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।’

এদিকে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কম বয়সী ছাত্রছাত্রীরা মোবাইলে আশক্ত হয়ে পড়েছেন। দিন নেই, রাত নেই, সব সময় মোবাইলে পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেম খেলছে। এমনকি খেতে না চাইলে কখনও কখনও মা-বাবা বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন। এভাবে কোমলমতি শিশুরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মোবাইল ফোনে। ছোট শিশু এবং প্রাইমারি স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের অ্যাপ, গেম, ভিডিও, চ্যাটিং নেশায় পরিণত হয়েছে।

মনোচিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের শাসন ইত্যাদি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে মোবাইলে গেম খেলছে। এটা এক সময় নেশায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে গেম খেলা মদ, গাজ, হেরোইনের নেশার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। নেশায় পড়লে সেখান থেকে সরে আসা কঠিন। অনেকেই প্রেমঘটিত টানাপোড়েন, আর্থিক সঙ্কট, বিষণœতা ও একাকিত্বসহ ছোট ছোট সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য মোবাইল গেমে আসক্ত হচ্ছেন। অনেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে তুচ্ছ ঘটনায়ও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করছেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে শিক্ষার্থীদের এই আসক্তি কিছুটা হলেও কমে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল ওয়াহাব বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি, খেলাধুলা ও বন্ধু-বান্ধবের সান্নিধ্য তারা পাচ্ছে না। সে কারণে অনেকেই মোবাইলে গেম খেলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। করোনাকালে অনেক অভিভাবকের চাকরি চলে গেছে, আর্থিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। এ জন্য হতাশা ও বিষন্নতা থেকে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। আর মোবাইলের বদৌলতে ইন্টারনেটে গেলে অনেক কিছু দেখা যায়। ফলে যে যা করতে চায় তা সহজেই করতে পারেন। প্রফেসর ড. আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ধরন দুই রকমের। একটি অবধারণগত বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অন্যটি আচরণগত শিক্ষা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে বন্ধু-বান্ধব ছিল তাদের সঙ্গ থেকেও তারা দূরে। এমতাবস্থায়, তারা নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য মোবাইল ডিভাইসের দিকে ঝুঁকে সময় কাটাচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের আসক্তি ক্রমে বাড়ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেলে এ আসক্তি আস্তে আস্তে কমে যাবে। গোটা বিশ্ব এখন অতিমারি করোনার ছোবলে জর্জরিত। এ থেকে উত্তরণের পথ অনেকটা চ্যালেঞ্জিংও বটে। তারপরেও শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত আছেন, তাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। কিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায়, সে ব্যাপারে সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়