প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটাল টুলস ও অ্যাপস
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
স্বল্প সময়ের মধ্যেই পুরেনো প্রথায় চলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল (অনলাইন) শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসেছিল কোভিড-১৯ পরিস্থিতি। বিশ্বব্যাপী প্রায় সর্বত্র সরাসরি অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার জন্য বহুল ব্যবহৃত সফটওয়্যার/অ্যাপ হলো জুম ও গুগল মিট। ইন্টারনেটের মাধ্যমে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করে জুম ও গুগল মিট অ্যাপের মাধ্যমে ক্লাসে বা ভিডিও কনফারেন্সিং করা কতই না সহজ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন বিবেচনা করে এই অ্যাপসগুলো তৈরি করা হয়েছে।
|আরো খবর
করোনা কেটে গেলেও অনলাইনের বেশকিছু সুযোগ-সুবিধার জন্য কোথাও কোথাও এখনো চলছে অফলাইন ও অনলাইনের মিশ্রণে ব্লেন্ডেড শিক্ষাব্যবস্থা। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এতে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী নিজেদের গতি অনুসারে পড়াশোনা করতে পারে। নিজেদের পড়ার সময়ও তারাই স্থির করতে পারে। যে শিক্ষার্থীটি হয়ত প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে পড়াশোনা করতে চায়, কিন্তু যাতায়াতে প্রচুর সময় ও অর্থ খরচ হচ্ছে, তার যদি একটা সস্তার ইন্টারনেট অ্যাক্সেস থাকে, তাহলে হয়ত তার পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সহজ হয়।
অথবা, বাড়ির কাছের কোনো প্রতিষ্ঠানে যে কোর্স হয় না, কিন্তু দূরের কোথাও তা হয়, বা বিদেশের কোনো ইউনিভার্সিটি যে কোর্স বিনামূল্যে করাচ্ছে, তা সস্তার ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে সে তা সহজেই করতে পারে। এ সমস্ত সুবিধা শিশুকাল তথা প্রাথমিক স্তরে কাজে লাগানোর জন্য বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অ্যাপসভিত্তিক ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রায় এক দশক ধরেই শিক্ষাবিষয়ক কিছু অ্যাপস চলছে। এগুলোর উপস্থাপনা আকর্ষণীয়, বিষয়বস্তু যথেষ্ট ভালো এবং তা বেশ আদান-প্রদানমুখী, যা শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় এবং বিনোদনমূলক। তাই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রচলিত পদ্ধতির শিক্ষাকে আনন্দময় করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তরের বিকল্প নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। সেই লক্ষ্যকে মাথায় রেখেই বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন খাতে ডিজিটাইজেশনের যাত্রা শুরু করেছে।
শিক্ষার মতো মানুষের মৌলিক একটি চাহিদা পূরণে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা খাতে ই-বুক এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুই ধরনের জ্ঞান অর্জিত হয়, যা তাদের স্মৃতিতে দীর্ঘ সময় সংরক্ষিত থাকে। পাঠ্যপুস্তকনির্ভর মুখস্থ বিদ্যার চর্চা কমিয়ে প্রাথমিক স্তরেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চেতনার বিকাশে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
পাঠ্যবইয়ের বিষয়ভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত, ছবি, এনিমেশন ও মিউজিকের মাধ্যমে খুবই আকর্ষণীয় হয়। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এস্পায়ার-টু-ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রামের উদ্যোগে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরি করা হয়েছে এবং গড়ে তোলা হয়েছে ২৫০০০ মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ। এটি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আইসিটি বিষয়ে শিক্ষকদের জ্ঞান ও দক্ষতার প্রসার ঘটিয়েছে।
বেসরকারিভাবে দেশে ২০০০ ও ২০১৫ সালে শিক্ষাব্যবস্থায় ডিজিটাইজেশন চালু হলেও সরকারিভাবে ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইন্টারঅ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল কন্টেন্টের শুভ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের টেলিকম অধিদফতর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার সুবিধা বঞ্চিত প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৬৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ডিজিটাইজেশনের আওতায় এনেছে সরকার। এরমধ্যে ৩০টি স্কুলে শিশুরা বইবিহীন বা অনলাইনে ট্যাবে লেখাপড়া করছে।
তাদের ক্লাসে ডিজিটাল টিভি, আইপিএস ও ইন্টারনেট সংযোগ আছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্প এবং সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৩শ’ প্রশিক্ষণার্থীর হাতে একটি করে ল্যাপটপ তুলে দেয়া হয়। জাতিসংঘ ২০০৫ সালে তিউনিসে তথ্য সম্মেলনে উন্নয়নশীল বিশ্বের দরিদ্র শিশুদের জন্য মাত্র ১শ’ ডলারে ‘ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড’ (ওএলপিসি) ঘোষণা করে। শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী আরেক বিপ্লবের নাম ই-লার্নিং।
উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, ডিজিটাল কনটেন্ট ও টেক্সটবুক ডিজিটাল করা হয়েছে। ওই সব দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষগুলোও পূর্ণমাত্রায় ডিজিটাল। চালু আছে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমও। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে শতকরা ৮৮ ভাগ শিশুর হাতে ট্যাব আছে।
শিশু বয়স সৃজনশীলতা ও মেধা অর্জনের সঠিক সময়। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে বইয়ের পরিবর্তে একদিন ট্যাব বা ডিজিটাল ডিভাইস পৌঁছে যাবে এবং সেদিন খুবই কাছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশও এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। আউটসোর্সিং এবং ফ্রিল্যান্সিং-এ বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে এখন শীর্ষে। দেশে প্রায় ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন এবং আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ আইটি প্রতিষ্ঠান কর্মরত। আছে অগণিত বিশ্বমানের কম্পিউটার হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তারা তথ্যপ্রযুক্তি সেবা (আইটি) রপ্তানি খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বহির্বিশ্ব থেকে ৫৯২ দশমিক শূন্য ৬ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন।
এছাড়াও অ্যামাজন, গুগল, ফেসবুকসহ বিশ্ব বিখ্যাত অনেক কোম্পানিতে চাকরি করে তারা দেশে পাঠাচ্ছে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা। এমতাবস্থায় আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাপনায় শিক্ষক সহায়িকা ও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে নতুন অ্যাপস বানানোর উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে এই অ্যাপস ডেভেলপ করবে এটুআই। প্রাথমিকভাবে পাইলটিং প্রকল্পের আওতায় ৬৫ বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম চলবে। যা শুরু হবে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে। এরপর সারাদেশের ৬৫ হাজার ৬২০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই অ্যাপস প্রয়োগ করা হবে।
অ্যাপসের ফিচারগুলোতে থাকবে বিদ্যালয়ের নাম, শিক্ষকের আইডি, বিষয়ের কর্মপরিকল্পনাসহ শিক্ষণ সহায়ক যাবতীয় তথ্য। শ্রেণিকক্ষে যত শিক্ষার্থী পড়বে, তারা কি শিখল আর কি শিখতে পারেনি, তাও ট্রেকিং আকারে সংরক্ষণ থাকবে। বাড়িতে পৌঁছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এই অ্যাপস যখন ইচ্ছা তখন ব্যবহার করতে পারবে। অ্যাপসটি যাতে শিক্ষকরা স্বচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারেন সেজন্য পিটিআই ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ২ হাজার মাস্টার ট্রেইনার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি, যা শুরু হবে ডিসেম্বরে।
পরে এসব মাস্টার ট্রেইনার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৩ লাখ ৭৭ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন। শিক্ষকরা অনলাইন প্রশিক্ষণ শেষে অফলাইনে প্রশিক্ষণ নেবেন। প্রশিক্ষণের ভিডিও ইউটিউবে থাকবে, যেখান থেকে শিক্ষকরা ভিডিও দেখে দেখে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও কারিগরি জ্ঞান বিতরণ করতে পারবেন। অ্যাপসটিতে অল্প কিছু বাটন চেপেই শিক্ষার্থীরা তাদের শিখন কার্যক্রম রেকর্ড করা, পড়া, ভিডিও দেখা, এডিট করা, আপডেট করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাজিরা, আগমন, প্রস্থান, শৃঙ্খলা এমনকি শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ই ফিডব্যাক এবং কমেন্টস করার সুযোগ থাকবে, যা চার মাস পর্যন্ত বারে বারে ব্যবহার করে স্থায়ীভাবে রেখে দিতে পারবে।
অ্যাপসটিতে ক্লাস ১-৩ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, জানা, অনুধাবন, প্রয়োগ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে প্রতিটি বিষয়ে ৪০ শতাংশ নম্বরের ওপর সামষ্টিক মূল্যায়নের নম্বরের সঙ্গে ধারাবাহিক মূল্যায়নের নম্বর যোগ করে মোট প্রাপ্ত নম্বর নির্ধারণ হবে, যা অ্যাপস কর্তৃক স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রাফ আকারে প্রকাশিত হবে।
তবে এই ডিজিটাল প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নের সময় গ্রাম ও শহরের মধ্যে যাতে বৈষম্য না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইন্টারনেট উপযোগী ডিজিটাল ডিভাইস, ক্লাসরুম, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম শিক্ষক, ডিভাইস ক্রয়ের সক্ষমতা, ল্যাব রক্ষণাবেক্ষণে আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি কিভাবে নিশ্চিন্ত হবে, তাও পরিকল্পনায় থাকতে হবে। মানসম্মত কনটেন্ট তৈরিতে দক্ষ প্রযুক্তিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কনটেন্ট তৈরি করে থাকে। শিক্ষা বিভাগ তা কিনে ব্যবহার করে।
সর্বোপরি, সরাসরি ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীনতা থাকে অপরিসীম। শিক্ষক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কি আলোচনা করছেন বা ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষককে কি বলছেন, তা ক্লাসরুমেই আবদ্ধ থাকে। বোঝাতে গিয়ে শিক্ষক অনেক প্রাসঙ্গিক উদাহরণ এনে থাকেন। কিন্তু এখন এই অ্যাপসের মাধ্যমে সবকিছুই রেকর্ড হচ্ছে, ফলে শিক্ষককে বক্তব্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে? শিক্ষার্থীদের মাথায় হাত দিয়ে স্নেহ করে পড়াবেন, বোঝাবেন কিংবা অমনোযোগী শিক্ষার্থীকে শাসন করে, সেটি আর থাকছে না। শিক্ষার্থীরা রেহাই পাবে একগাদা বই নিয়ে স্কুলে যাওয়া থেকে। তবে কিছু শিশুর অতিমাত্রায় ডিভাইস প্রীতি এবং চোখের রেডিয়েশন প্রবলেম নিয়ে সচেতন থাকতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।