প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২১, ১৪:০৬
ব্যবসা শেষ পুঁজিও শেষ, সম্পদ বেচে খাচ্ছেন তারা
অদৃশ্য এক ভাইরাসের ছোবলে তছনছ পুরো বিশ্ব। সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে সাধারণ ছুটি, লকডাউন, চলাচলে বিধিনিষেধ অথবা কঠোর বিধিনিষেধ পরিপালনের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। ফলে বন্ধ রাখতে হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়ে অনেকে গুটিয়ে ফেলছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অর্থের সংকটে অনেকে আবার দেউলিয়া হয়েছেন। জমানো পুঁজি ভেঙে কেউ কেউ টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ আবার পুঁজি শেষে এখন সম্পদ বিক্রি করে খাচ্ছেন।
|আরো খবর
এমনই একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শামীম আহমেদ। গুলিস্তানের ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন। দৈনিক উপার্জনও ছিল বেশ। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সুখে দিন কাটছিল তার। গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনা হানা দিলে গুটিয়ে ফেলতে হয় ব্যবসা। প্রাথমিক সেই ধাক্কা কাটিয়ে ফের ব্যবসা শুরুর প্রস্তুতি নেন। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় তার সবকিছু যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। পুঁজি যা ছিল সবই শেষ করেছেন, এখন সম্পদ বিক্রি করে চালাতে হচ্ছে সংসার।
ADVERTISEMENT
শামীম আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে গুলিস্তানের একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করতাম। পরে ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করি। আয় যা হতো ঘরভাড়া, সংসারের খরচ মিটিয়ে ভালোভাবেই চলছিল। গত বছর করোনার কারণে যখন সবকিছু বন্ধ করে দিল সরকার, তখন একটা ধাক্কা খাই। জমানো কিছু অর্থ ছিল, তা দিয়ে ওই সময়টা সামলাই। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবার ব্যবসা শুরু করি। সমিতি থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মাল কিনি এবং আগের কিছু খুচরা ঋণ ও ঘরভাড়া পরিশোধ করি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে ফের সবকিছু বন্ধ করে দেয় সরকার। রোজার ঈদে তেমন ব্যবসা হয়নি। এবার আরও কঠিন অবস্থা।
‘অন্য কোনো কাজও নেই। সমিতির ঋণের কিস্তি আটকে গেছে। গত দুই মাসের ঘরভাড়া দিতে পারিনি। মুদির দোকানেও বাকি পড়েছে। দিন যত যাচ্ছে দেনা তত বাড়ছে। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। আগে মানুষকে সাহায্য করতাম, এখন আমার সাহায্য নেওয়ার মতো অবস্থা! কিন্তু কীভাবে হাত পাতি?’
অন্য কোনো কাজও নেই। সমিতির ঋণের কিস্তি আটকে গেছে। গত দুই মাসের ঘরভাড়া দিতে পারিনি। মুদির দোকানেও বাকি পড়েছে। দিন যত যাচ্ছে দেনা তত বাড়ছে। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। আগে মানুষকে সাহায্য করতাম, এখন আমার সাহায্য নেওয়ার মতো অবস্থা! কিন্তু কীভাবে হাত পাতি
শামীম আহমেদ, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীতিনি আরও বলেন, কারও কাছে হাত পাততে পারি না। কাউকে কিছু বলতেও পারি না। বুধবার মধ্যরাত থেকে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে যে পণ্যগুলো আছে তা লটে বিক্রি করে দেব। এরপর আর ঢাকা শহর নয়, দায়দেনা মিটিয়ে গ্রামে ফিরে যাব।
শুধু শামীম আহমেদ নন, তার মতো অনেক ছোট উদ্যোক্তাও এখন পথে বসতে শুরু করেছেন। এমনই একজন কেরানীগঞ্জের ফারুক হোসেন। ১২টির মতো মেশিন দিয়ে ছোট একটি পোশাক কারখানা চালাতেন। দেশীয় বাজারে বিক্রির জন্য পোশাক তৈরি করতেন। ১৬ থেকে ১৭ জনের মতো কর্মী ছিল তার। করোনার কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় কর্মী কমিয়ে সীমিত পরিসরে টিকিয়ে রেখেছিলেন ব্যবসা। এখন সেই অবস্থাও নেই। অর্ডার নেই, কারখানাও বন্ধ। ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা করে সংসার চালানো অনেকেই আজ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন
‘দেড় বছর ধরে কাজ নেই। টুকটাক যা আসত দুই-তিনটা মেশিন দিয়ে চলত। গত বছর (২০২০ সাল) পুরোটাই এভাবে গেছে। এবার রোজার ঈদের আগে কিছু অর্ডার পেয়েছিলাম। তিন-চারজন কর্মী দিয়ে কাজ করিয়েছি। এরপর আবার বন্ধ। কাজ না থাকায় তারাও চলে গেছে। পুঁজি যা ছিল শেষ। দুই মাস হলো কারখানার ভাড়া দিতে পারিনি। এখন অ্যাডভানস (আগাম দেওয়া) থেকে ভাড়ার টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। জানি না এভাবে কত দিন চলতে পারব’— আক্ষেপের সুরে বলেন ফারুক হোসেন।
এবার রোজার ঈদের আগে কিছু অর্ডার পেয়েছিলাম। তিন-চারজন কর্মী দিয়ে কাজ করিয়েছি। এরপর আবার বন্ধ। দুই মাস হলো কারখানার ভাড়া দিতে পারিনি। এখন অ্যাডভানস থেকে ভাড়ার টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। জানি না এভাবে কত দিন চলতে পারব। এদিকে মেশিন বেশিদিন বন্ধ থাকলে নষ্ট হয়ে যায়। ক্রেতার খোঁজে আছি, মেশিনগুলো বিক্রি করে দেব। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নতুন কিছু করার চিন্তা করব
ফারুক হোসেন, ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাক্ষুদ্র এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, ছয় বছর আগে দুটি মেশিন দিয়ে শুরু করি। এখন ১২টি মেশিন। প্রায় ৩২ লাখ টাকার বিনিয়োগ। সব জলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। সামনে যে ভালো হবে, সেটাও বলা যাচ্ছে না। মাঝে কয়েকটা দিন বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু এরপর ফের কঠোর লকডাউন। এ সময় মেশিন চালিয়েও লাভ নেই। কর্মীর টাকাও উঠবে না।
‘আমার কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের মার্কেটগুলোতে বিক্রি হতো। মার্কেটগুলো বন্ধ থাকায় তারাও অর্ডার দিতে পারছে না। আমার মেশিনও চলছে না। এদিকে মেশিন বেশিদিন বন্ধ থাকলে নষ্ট হয়ে যায়। কী আর করব! ক্রেতার খোঁজে আছি, মেশিনগুলো বিক্রি করে দেব। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নতুন কিছু করার চিন্তা করব।’
এসএমই ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারিকালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩৭ শতাংশ কর্মচারী কাজ হারিয়েছেন। ৭০ শতাংশ কর্মীর চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ৮৩ শতাংশ ছোট উদ্যোক্তা লোকসানে পড়েছেন।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের বিক্রি ৯৪ শতাংশ কমে গেছে। ৩৩ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে ২১ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং ১৬ শতাংশ বিকল্প উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। এ খাতের মাত্র তিন শতাংশের ব্যবসা আগের মতো চালু আছে। ৫৯ শতাংশ কুটির ও ছোট উদ্যোক্তা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে পরিচালিত এটুআই, আইএফসি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইউএনডিপি, ডব্লিউআরএফ, লংকাবাংলা, লাইট ক্যাস্টল ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের বিক্রি ৯৪ শতাংশ কমে গেছে। ৩৩ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে ২১ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং ১৬ শতাংশ বিকল্প উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। এ খাতের মাত্র তিন শতাংশের ব্যবসা আগের মতো চালু আছে। ৫৯ শতাংশ কুটির ও ছোট উদ্যোক্তা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনার কারণে মানুষের এখন আয়-রোজগার নেই। অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। জমানো টাকা যা ছিল তা ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। অর্থ-পুঁজি সবই তাদের শেষ। অধিকাংশই দুর্দশার মধ্যে জীবন পার করছেন। বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের লোকজন খুব সমস্যায় আছেন। আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়লেও সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা।’
ছোট উদ্যোক্তাদের কারখানা বন্ধ। নষ্ট হয়ে যাবে এ কারণে অনেকে মেশিন বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন
‘জরুরি ভিত্তিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ক্ষুদ্র এসব ব্যবসায়ীকে প্রথমে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি এ খাতের ছোট ছোট ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ঋণপ্রাপ্তির বিষয়েও সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে তারা আবারও ব্যবসা শুরু করতে পারেন।’
জরুরি ভিত্তিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ক্ষুদ্র এসব ব্যবসায়ীকে প্রথমে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি এ খাতের ছোট ছোট ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ঋণপ্রাপ্তির বিষয়েও সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে তারা আবারও ব্যবসা শুরু করতে পারেন
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ ভাগ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। লকডাউনের কারণে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।পাঁচ কোটি মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ ভাগ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। লকডাউনের কারণে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ছোট ছোট উদ্যোক্তা/ব্যবসায়ীদের বিষয়ে জানতে চাইলে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ছোট উদ্যোক্তারা। ব্যবসা কমে গেছে। অনেকের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে আমরা সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। চাহিদা বেশি, বরাদ্দ কম। বরাদ্দ বাড়লে ক্ষতিগ্রস্তদের বেশি ঋণ দেওয়া যেত।
আমরা শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করি। কিন্তু এর বাইরেও অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান আছে। আছেন ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। কোভিডের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তাদের জন্য তেমন কিছু করা হচ্ছে না। আমরাও তাদের সহযোগিতা করতে পারছি না। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি
মো. মফিজুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসএমই ফাউন্ডেশনতিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করি। কিন্তু এর বাইরেও অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান আছে। আছেন ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। কোভিডের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তাদের জন্য তেমন কিছু করা হচ্ছে না। আমরাও তাদের সহযোগিতা করতে পারছি না। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।’
সূত্র : ঢাকা পোস্ট