প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
মানুষ বদলে যায়? না সময় বদলায়? কথাটা এতো প্রচলিত যে, আমরা নিজেরাও এই আলোহীনতায় ডুবে যাই প্রতিনিয়ত। আসলে কিছুই বদলায় না। আমরা আমাদের অনুভূতিগুলোকে আলোয় নিয়ে আসতে পারি না। সেই আলো, যে আলো দিনের প্রথম প্রহরে নরম সুগন্ধি আর ফুরফুরে হয়, দুপুরের ঝাঁঝালো রোদে তার কোমলতা হারায়। প্রহর শেষে আবারও সজীব আর পরিণত হয়ে ধরা দেয়। মানুষের জীবনে সম্পর্কগুলোও এমনই। প্রকৃতি আর মানুষ নিজেদের ভাগ করে নেয় এভাবেই। নতুন কিছু পুরানো হলে তার জৌলুস হারায়! আদতে না। প্রকৃতির কিছু সৌন্দর্য যেমন আপনাকে ফিরিয়ে দেয় নতুন নতুন রূপ, বেলা-অবেলায়। তেমনি জীবনের কিছু সম্পর্ক হাজারো বছর পর আপনাকে দেবে আলমারিতে তুলে রাখা বিয়ের বেনারসির মতো স্মৃতিময়, যত্ন, আর ভালোবাসার অদ্ভুত সুবাস। আপনি টের পাবেন না, মাঝের অনেক বছর ছিল না! আপনি মুহূর্তে চলে যাবেন আপনার ১৮/ ১৯ বছরের জীবনে। যে জীবন শুধুই আপনার ছিল। সেখানে আপনিই আপনার সব ইচ্ছের মালিক ছিলেন। ছেলেবেলার বন্ধু বিষয়টা আলাদা রঙের আয়নার প্রতিফলন। যেখানে নিজেকে যাচাই-বাছাই করতে হয় না। আপনি অনায়াসে ভাঙতে পারবেন সব দেয়াল। নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারবেন নিজের মোহনার সীমানা পেরিয়ে।
সেই ক্লাস ফোর আর ফাইভে মাতৃপীঠে একসাথে ৫ জন। এরপর ৯৪-এর পর বিশাল একটা সময় আমাদের চারপাশ বদলে যাওয়ার তোড়ে, নিজেরাও কিছুটা অতিক্রান্ত সময়কে সময় দিয়ে চলা। তারপরের গল্প সবকিছুকে একপশলা বৃষ্টির মতো ভিজিয়ে দিলো অমিয় শুদ্ধতায়। ২০১৯-এ ১৬/১৭ জানুয়ারি আমরা তিনজন আবার একসাথে। কিন্তু মাঝে একজন বিদেশে আর একজন সব ভাসিয়ে, নিজেকে বিলিয়ে চলে গেলো শূন্যতার রেখা টেনে। ১৭ জানুয়ারি সারা রাত আড্ডা। সকালে চলে যাওয়ার সময় একবারও ভাবিনি কাঁদবো। কিন্তু কী অদ্ভুত মোহ মায়ায় নিজেকে ছাপিয়ে বিনে পয়সার ওয়াসার জল নেমে গেলো অনায়সে। বুকের কোথাও খুব সহজ হয়ে কঠিন একটা অনুভব গলে যাচ্ছিল। ১১/১১/২০২১ হঠাৎ আমরা তিনজন আবারও এক হলাম। সাথে একজন ভিডিও কলে। চোখ ভর্তি ওয়াসার পানি। রেডচিলি থেকে নেমে আলিমপাড়া। লিপি বললো, চল হাঁটি আগের মতো। যদিও এ শহর এখন আমার নয়। বললাম, তাহলে আয় হাতে হাত রাখি। আকাশে অদ্ভুত সুন্দর আধখানা চাঁদ। নিমিষেই ভুলে গেলাম বয়স, চারপাশ। ফিরে পেতে জানতে হয়। সম্পর্ক আগলে রাখতে হয়। আমরা একে অপরকে চিনি আত্মার অভয়ারণ্যে।
‘সুকাসু মন্জিল’। আহা সময়! সেই ড্রইং রুম। কতো সময় আমরা পার করেছি এইখানে। ক্লাস শেষে অথবা ৭টা থেকে ৮টা প্রাইভেট শেষ করে, ৯.২০-এর কলেজে ক্লাসের আগের সময়টুকু নিজেদের মতো কাটিয়ে একসাথে কলেজে। এতো বেশি ঝলমলে ছিল সময় যে, কখনো কখনো নিজেরাই ভেসে গেছি আলো হয়ে। নাম না বলি, একদিন ৩-২০-এর ক্লাস শেষে এক স্যারের বাসায় পড়া ছিল। দুপুরে কারো তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। তখন এতো দোকান ছিল না। শুধু ফটোকপি করার একটা দোকান ছিল। সবার পেটে ক্ষিদে। এর মাঝে হালকা বৃষ্টি। স্যার পড়া আরম্ভ করলেন। শিল্পী সাহস করে বলল, ‘স্যার ক্ষিদে পেয়েছে। তো স্যার ভিতর থেকে বড় বাটিতে মুড়ি আর তার ওপর জাম্বুরার কোয়া নিয়ে এলেন!!! আমরা হা করে একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো এটা আসলে কী হলো?? আর একদিন লিপি বাসা থেকে খাবার নিয়ে এলো। সমস্যা একটা বাটি! সমাধান সবাইকে আগলে রাখা শিল্পী আমাদের বসিয়ে রেখে নিজে মেখে সবাইকে মুখে তুলে খাইয়ে দিল। এতো এতো কথা জমে আছে বুকের সবচেয়ে আবরণহীন পলিপড়া কোমল জমিনে। সেখানে চাইলেই চিহ্ন রেখে সজীব করে তোলা যায় জমিন।
জীবনের এ-ই যে চাঁদের নরম আলোর প্রহর তা আসলে প্রতিটি মানুষ পরম যত্নে কোনো এক সুগন্ধি কৌটায় তুলে রাখে। মাঝে মাঝে সে কৌটার ঢাকনা খুলে নরম চোখে জলের তোড়ে ভেসে যায় মনের গভীর রাতের প্রহর। জীবনের এগুলো নিয়ে আফসোস নয়, যেটা আছে সেটা পরম চাওয়ার কিছু অপার্থিব অনুভব। যা মাঝে মাঝে আমাদের শিখিয়ে দেয় বাঁচতে শিখে গিয়েছো তোমরা। আমার সব আগের মতো! মাঝে শুধু সময় তার গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে আমাদের সোনালী রূপোলী কৈশোর। কতো গভীর আলোড়ন তুলে রাখা জীবনের রঙে রঙ্গিন আমাদের অতীত। আমাদের স্পর্শ আমাদের চেনা। আমরা বোধহয় মেয়েদের তথাকথিত নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছুটা আলোয় দাঁড়াতে পেরেছি। আমাদের গল্পে শাড়ি, নারী, বর নেই। আমাদের গল্পে লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা নেই। আমরা এক হলে, চারপাশে কী আছে আমরা বুঝতে পারি না। আমরা শুধুই বন্ধু নই। আমরা আমাদের আয়না। এ শহর আমাদের শিখিয়েছে, উদার হও মেয়ে। এ শহর আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ হিসেবে সম্মানটুকু বহন করো এবং অন্যকে দাও। তুমি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। তুমি তোমার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো। তোমাকে পশু থেকে আলাদা করা হয়েছে বিবেক দিয়ে। তুমি ধারণ করো আল্লাহর সব মহান বাণীকে। তুমি অবনত হও। এটা তোমাকে আলাদা করবে, আবার তোমাকেই ফিরিয়ে দেবে বিশাল আকাশের সবটুকু আলাপন.....
লেখক : সাইদা আক্তার (পান্না), সহকারী শিক্ষক, উদয়ন শিশু বিদ্যালয়, চাঁদপুর।