রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক

রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম, ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিতে প্রণাম, পথ ভাবে ‘আমি দেব’ রথ ভাবে ‘আমি’। মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’ হাসেন অন্তর্যামী। পথ, রথ এবং মূর্তি এ তিনজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? সকলেই নিজেকে দাবি করছে। প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠ হলেন বিধাতা। বিশ^কবির এ উক্তিখানা পাঠ করলে মনে পড়ে যায় সরকারের আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের মধ্যে কার ক্ষমতা বেশি বা কম বা সমান-এ বিতর্কের অবসান করতে পারে শুধুমাত্র সংবিধান। উপমা দিয়ে বলা যায় যে, চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। সূর্যের আলোয় চাঁদ আলোকিত ও উদ্ভাসিত। এখানে সূর্যকে সংবিধানের সাথে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেওয়া যায়। ছোট্ট কথায় সংবিধান হলো যে কোন রাষ্ট্রের মূল ও সর্বোচ্চ আইন। যা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধানের সমষ্টি। অন্যভাবে বলা যায় একটি রাষ্ট্রের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। যার মধ্যে একটি জাতি, দেশ ও রাষ্ট্রের জীবন পদ্ধতি মূর্ত হয়ে উঠে অর্থাৎ সরকারের ক্ষমতা চর্চার শাখাগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের মতে, ‘সংবিধান হলো এমন একটি জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র স্বয়ং বেছে নিয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানই আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং নাগরিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করে’। অধ্যাপক ফাইনারের মতে, ‘মৌল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুষম ব্যবস্থাই সংবিধান।’ যে কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা বা সরকারের ক্ষমতার উৎসই হচ্ছে সংবিধান। কোনো কিছু যেমন ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা হতে সৃষ্টি হতে পারে না বা শূন্যতার ভেতর কাজও করতে পারে না। এক কথায় বলা যায় সংবিধানবিহীন কোনো স্বাধীন, সার্বভৌম ও সভ্য রাষ্ট্র চলতে পারে না।

ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, মানব সভ্যতার প্রথম সমাজ হিসেবে পরিগণিত গ্রীক সমাজে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল এবং তা স্বাভাবিক হিসেবেও সমর্থিতও হয়েছিল। সেখানে দাসগণের কোনো অধিকার ছিল না। দাসগণ ছাড়া সকল নাগরিকই শাসনকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতো। বিভিন্ন প্রাচীন গ্রীক নগর-রাষ্ট্রের সংবিধানসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যে সমস্ত বিশ্বাস এবং ধ্যান ধারণা অনুযায়ী ঐ সকল সমাজ পরিচালিত হয়েছিল তা সেখানকার সংবিধানগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছিল। এথেন্স ও স্পার্টা নগরী দুটির সংবিধানগুলোই এর দৃষ্টান্ত বিশেষ। সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজেরও সংবিধান সেই ধরণের ‘ক্ষমতাগত সম্পর্ক’ প্রকাশ করে। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে সর্বহারাগণই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং বুর্জোয়াগণের কোনো অধিকার নেই। সর্বহারাগণই সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী হবে এমনভাবেই সেখানে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংবিধান ভারতের আর ছোট সংবিধান (মাত্র ১৫-১৬ পাতা) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, তবে ছয় হাজার শব্দের বেশি নয়। ১৭৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের সংবিধান ছাব্বিশ বার সংশোধিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সংবিধান অলিখিত।

আমাদের মহান ও পবিত্র সংবিধান লিখিত, দুষ্পরিবর্তনীয়, মৌলিক অধিকার দ্বারা স্বীকৃত, এককক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১১টি ভাগ, ৪টি মূলনীতি, ৭টি তফসিল, ১টি প্রস্তাবনাসহ পরিপূর্ণ একটি সংবিধান। তবুও কারণে বা অকারণে আজ পর্যন্ত এ সংবিধানে পনেরবার সংশোধনী আনা হয়েছে। প্রতি বছরের ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সংবিধান দিবস সম্পর্কে লিখতে গেলে এর পটভূমি লেখা অত্যন্ত জরুরি বা আবশ্যক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দিন। এ দিন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রবাহিনীর নিকট রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানী সেনা আত্মসমর্পণ করার সাথে সাথেই বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ২২শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার মুজিবনগর হতে ঢাকায় এসে শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দান করেন। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ তাঁর ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ’ জারি করেন। এ আদেশ ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর হয়। এ আদেশ বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো থেকে প্রাপ্ত সকল আইনকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে বৈধতা দান করা হয়।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুযায়ী দেশ শাসিত হতে থাকে। সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিবর্তে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর কালবিলম্ব না করে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ জারি করেন। এ আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯ জন সদস্যদের মধ্যে (জাতীয় পরিষদের ১৬৯+প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০=৪৬৯ জন) ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। কেননা ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিহত হয়েছিলেন ১২ জন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দালালির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন ৫ জন, দুর্নীতির দায়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ৪৬ জন, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন ২জন (ভাষা আন্দোলনের খুনি নুরুল আমীন ও স্বতন্ত্র সদস্য রাজা ত্রিদিব রায়), পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ে চাকরি গ্রহণ করেছিলেন ১ জন। এ ৪০৩ জন গণপরিষদ সদস্যের মধ্যে ৪০০ জন ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়, ১জন ছিলেন ন্যাপ (মোজাফ্ফর) এর এবং বাকি দুজন ছিলেন নির্দলীয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন। অধিবেশনের প্রথম দিনে গণ-পরিষদের সদস্যগণ কর্তৃক স্পীকার নির্বাচিত হন শাহ্ আব্দুল হামিদ ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন মোহাম্মদ উল্লাহ্। ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই ৩৪ জনের মধ্যে ৩৩ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের দলীয় গণপরিষদ সদস্য এবং একজন ন্যাপ (মোজাফ্ফর) সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (আওয়ামী লীগ) একজন মহিলা গণপরিষদ সদস্য (বেগম রাজিয়া বানু) উক্ত কমিটির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই খসড়া কমিটির প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনমত আহ্বান করা হয়। খসড়া কমিটি সর্বমোট ৪৭টি বৈঠকে ৩০০ ঘন্টা ব্যয় করে তাদের খসড়া চূড়ান্ত করে।

১৯৭২ সালের ১০ জুন কমিটি সংবিধানের প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করে। এরপর কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ভারত ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে সংবিধান বেত্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। প্রস্তাবিত সংবিধানের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর কমিটির শেষ বৈঠকে খসড়া সংবিধানের চূড়ান্ত রূপ গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণ-পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে গণ-পরিষদে উত্থাপন করেন। ১৯শে অক্টোবর সংবিধানের ওপর প্রথম পাঠ শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। এতে সর্বমোট ১০টি বৈঠকে ৩২ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়। অতএব ৩১ অক্টোবর দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয় এবং ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলে। ৪ঠা নভেম্বর সংবিধানের ওপর তৃতীয় ও সর্বশেষ পাঠ শুরু হয়। মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে এ কাজ শেষ হয়। ঐ দিনটি ছিল ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণ (বেলা ১টা ৩০ মিনিট)। বিপুল আনন্দ তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে বাংলাদেশ সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক পাস এবং তা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। গণ-পরিষদের সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় নয় বছর (১৯৪৭-১৯৫৬), ভারতের সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর (১৯৪৭-১৯৪৯), কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকার মাত্র দশ মাসে বাংলাদেশকে একটি সংবিধান উপহার দিতে সক্ষম হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সংবিধানের হস্তলিপি সংস্করণে গণপরিষদের সদস্যগণের স্বাক্ষর গৃহীত হয়। গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত এ সংবিধান বিজয় দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। আমাদের সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের সময় বা মহান জাতীয় সংসদের পাসের পূর্ব মুহূর্তে কিছু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল বা গ্রুপ বা গোষ্ঠী সতর্কতার সাথে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিল। কারা এবং কেন, কী উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেছিল ইতিহাসে তা লেখা আছে। তারা সমালোচনা করলেও সংবিধানের মূলনীতি সমূহের বিরোধিতা করেনি এবং সংবিধানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পুরোপুরি ভাবে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় প্রমাণ করে যে, পবিত্র সংবিধানটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। বর্তমানে সকলেই সংবিধানকে আইন হিসেবে এবং শ্রদ্ধার সাথে মেনে নিয়েছে। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর পর থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। কারণ ‘সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অ্যন্য সরকার ব্যবস্থা থেকে উত্তম।’

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, ০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়