প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পসহ স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারি বা বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনও পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই চোখে পড়েনি হাইমচর উপজেলার ২নং আলগী দুর্গাপুর উত্তর ইউনিয়নের কমলাপুর ৫নং ওয়ার্ডে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঢালীবাড়ি মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পটি সংস্কারের। জরাজীর্ণ ভগ্নদশায় বহু স্মৃতি বুকে আগলে রেখে কঙ্কালের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। দিন যত যাচ্ছে ততই খসে পড়ছে ইট, পাথর, সুরকির আবরণ।
লোকমুখে জানা যায়, কালের সাক্ষী শতাধিক বছরের পুরাতন দোতলা এ ভবনটিতেই ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীসহ অত্র অঞ্চলে দাঙ্গাকালীন সময় পা রেখেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অগ্রদূত মহাত্মা গান্ধী। সেই সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এই বাড়িসহ রায় বাড়ি, দেওয়ান বাড়ি ও আশেপাশের বেশ ক’টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। তখন এ বাড়িটি গুরুচরণ দে বাড়ি নামেই পরিচিত ছিলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনে শান্তি স্থাপন পূর্বক দাঙ্গার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি-ঘর ও মানুষদের দেখতে নোয়াখালী থেকে আসার পথে মহত্মা গান্ধী সে সময় এই অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত দে বাড়িতেই কিছু সময় অতিবাহিত করেন এবং বাড়িটির অবস্থান অবলোকন করে তাদেরকে ঢালী উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাড়িটি গুরুচরণ ঢালীবাড়ি নামেই পরিচিতি পেয়ে আসছে, আর বাড়িতে বসবাসরত পরিবারও ঢালী নামে পরিচিতি পেয়েছেন। এলাকার মানুষের ধারণা, সেই সময় অত্র অঞ্চলের মানুষ ঢাল, তলোয়ার ব্যবহারে ছিলো অধিক সাহসী। হয়তো সেই ধারণা থেকেই গান্ধীজী গুরুচরণ দে পরিবারকে ঢালী উপাধিতে ভূষিত করেন। গান্ধীজি এ বাড়িতে আসার পর অত্র অঞ্চলসহ আশপাশে বাড়িটির পরিচিতি অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন সর্ব শ্রেণী-পেশার মানুষ। যুদ্ধে কৌশলগত কারণে বিভিন্ন স্থানের ন্যায় এই ঢালী বাড়িতেই স্থাপন হয় মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প। বাড়ির প্রয়াত বাসিন্দা মনোরঞ্জন দে’র (ঢালী) ছেলে প্রবীর দে ও প্রদীপ দে বাবার মুখে শোনা কথার কিছু অংশ তুলে ধরে জানান, ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন খুব ভোরে আমার বাবা দোতলা থেকে দেখতে পান বাড়ির বাগানে ক’জন মানুষ পায়চারি করছেন। বাবা ছিলেন খুব সাহসী, তিনি উপর থেকে চুপিসারে বিষয়টি দেখার পর এক পর্যায়ে নিচে নেমে এসে তাদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানতে চান। তারা তাদের পরিচয় দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প স্থাপনের কথা বললে বাবা তাতে রাজি হয়ে যান। প্রথম দিকে অল্প ক’জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাম্প স্থাপিত হলেও পরবর্তী সময় এই ক্যাম্পে দুশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেয়। প্রথম দিকে প্রয়াত মনোরঞ্জন দে ও তার পরিবার প্রয়াত কমলা রাণী দেসহ তার ছেলে-মেয়েরা নিজেদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পরক্ষণে তারা গ্রামসহ আশেপাশের এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার জোগান দেন। এজন্যে তাকে বেশ কষ্ট স্বীকার করতে হয়। নানা কথা শুনতে হয় চুপিসারে। এমনকি কেউ কেউ হুমকিও দেয় তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করার কারণে। কিন্তু মনোরঞ্জন দে এসব কথায় আমলই দিতেন না। তিনি উল্টো তাদেরকে বোঝাতেন, যদি কেউই সহযোগিতা না করে তাহলে দেশ স্বাধীন হবে কিভাবে। মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের কাছ থেকে আশ্রয় না পান, সহযোগিতা না পান, তাহলে তাদের নিরাপত্তা কে দেবে? তারা কার জন্যে যুদ্ধ করবে ? আমাদের সকলের উচিত তাদেরকে সহযোগিতা করা। তিনি এভাবেই উৎসাহ জুগিয়েছেন আর চেষ্টা করেছেন মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে। অথচ এই সাহসী মানুষটি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্যে কোনো খেতাব বা সহযোগিতা পান নি। আজ তারই সন্তানরা অভাব-অনটনে, রোগে-শোকে খেয়ে না খেয়ে মামলা-মোকদ্দমাসহ নানা জটিলতার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে থাকা পরিত্যক্ত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ক্যাম্পের দালানে একান্ত নিরূপায় হয়ে বাস করছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। যুদ্ধকালীন সময় তারা যুদ্ধে না গেলেও বাবা-মায়ের সাথে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে খাবার জুগিয়েছেন। এগিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী সময় তারাই আজ প্রাপ্য অধিকার থেকে হয়েছেন বঞ্চিত।
তাদের বাপ-দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ভুয়া দলিলের কারণে। যুদ্ধকালীন সময় যারা এখানে থেকে যুদ্ধ করেছেন তাদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন সম্মান ও প্রভুত্ব নিয়ে। অথচ যুদ্ধকালীন সময় যে মানুষগুলো আশ্রয় দিয়েছে, খাওয়া দিয়েছে, তাদের খবর নেয়ার মত সময় কারোই হয় না। কিছুদিন আগে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল হাইমচরের এক জনসভায় কমলাপুরের মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরতে গিয়ে পরিবারটির অবদানের কথা বলেন। তাতে প্রয়াত মনোরঞ্জন দে’র ছেলে প্রণব দে, প্রবীর দে ও প্রদীপ দে আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আমাদের পরিবারের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের জন্যে কাজ করেছিলো, আমরা বিনিময়ে কিছুই পাইনি। আমাদের বাবা থাকতে যদি তাঁকে একটু সম্মান জানানো হতো, তাহলে হয়তো তিনি মৃত্যুর পর হলেও একটু শান্তি পেতেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ক্যাম্পটি সংস্কারসহ তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের পরিবার হিসেবে স্মীকৃতি দেয়ার জন্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর মাসহ তার পরিবার-পরিজন এ বাড়িতে অবস্থান নেন। এখানে মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারীও কয়েকবার এসেছেন। তার সাথে ছিলো আমাদের পরিবারের আত্মার সম্পর্ক। স্বাধীনতার পর দুবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী এই বাড়িতে এসেছেন। এসেছেন নোয়াখালীর জয়াগ গান্ধী আশ্রম থেকে, তারা জানতে চেয়েছেন গান্ধীজী সম্পর্কে। এসেছেন সাংবাদিকসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। তাদের আসা-যাওয়া আর আশ্বাস বাণীই আমাদের সম্বল হয়েছে। হয়নি ভাগ্যের উন্নয়ন, পরিবর্তন হয়নি জরাজীর্ণ ভগ্নদশায় থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ক্যাম্পের।
কমলাপুরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই ক্যাম্পের সংস্কারসহ তা সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন জেলা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বাসুদেব মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন। তারা প্রয়াত মনোরঞ্জন দে’র পরিবারকে মানবিক সহায়তা প্রদান করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং যুদ্ধকালীন সময় পরিবারটির অনবদ্য অবদানের জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।