প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
চাঁদপুর শহরের ডাকাতিয়া নদীর পাড় মনোরম পরিবেশে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির উদ্যোগে শিশুদের খেলাভিত্তিক এবং অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার জন্যে শিক্ষা তরী উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে মূল্যবোধ, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই ‘ব্র্যাক শিক্ষা তরী’ উদ্বোধন করা হয়। ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার বিকেলে চাঁদপুর প্রেসক্লাব ও আল-আমিন একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজ সংলগ্ন নদীর পাড়ে আয়োজিত এই ব্র্যাক শিক্ষাতরী প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি।
এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দেশে এবং বিদেশে ব্র্যাক সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু অধিকারসহ সমাজ উন্নয়নে আরো বহু কাজ করে বেড়ায়। তাদের এই কার্যক্রমের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষে ব্র্যাক যে শিক্ষা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে ওঠার জন্যে এই তিনটি শিক্ষাতরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শিক্ষাতরীতে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থী তৈরি এবং গণিত ভীতি কাটানোর পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা পাবে শিক্ষার্থীরা।
যেসব এলাকার শিশুরা বর্ষার সময় স্কুলে যেতে পারছে না, সেখানে নৌকায় তাদের স্কুল যাবে। তারা শিক্ষাকে শিক্ষাতরীতে রূপান্তরিত করেছে।
মন্ত্রী বলেন, সুসজ্জিত স্টিলের বড় তিনটি নৌকায় লেখা ‘বিজ্ঞান তরী’, ‘গণিত তরী’ ও ‘মূল্যবোধ তরী’। এর মাধ্যমে আমাদের ছোট্ট শিক্ষার্থীদের খেলতে খেলতে আনন্দের মধ্যে দিয়ে মূল্যবোধ, গণিত ও বিজ্ঞান শেখানো সম্ভব। আমরা যা কিছু শেখায় ছোটবেলা থেকে তাদের জাগিয়ে তুলতে হবে। আনন্দময় শিক্ষার মাধ্যমে তারা করে করে শিখবে এবং মূল্যবোধসম্পন্ন দক্ষ যোগ্য সৃজনশীল মানবিক মানুষ হবে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমের যে প্রচেষ্টা এবং ব্র্যাকের এই যে প্রয়াস এটি একটি আরেকটির পরিপূরক। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এ ধরনের উপকরণ আমাদের মতো করে তৈরি করে আমরাও ব্যবহার করতে পারবো।
শিক্ষামন্ত্রী নতুন পাঠ্যবই প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের বই নিয়ে খুব হৈ চৈ হচ্ছে। যে অভিযোগ উঠেছে সে বইগুলো অনেকে পড়ে দেখেন নি। সেখানে বানর থেকে মানুষ হয়েছে এমন কোনো কথা লেখা নেই। বরং লেখা আছে বানর বা শিম্পাঞ্জি মানুষের পূর্ব পুরুষ নয়। এ কথাটা তিনবার লেখা আছে। অথচ অপপ্রচার করা হচ্ছে উল্টোটা। ছবি পর্যন্ত বিকৃত করে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দিয়েছে। আরো নানা বিষয়ে ছলনা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। নতুন বইয়ের উপর অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। যারা অপপ্রচার করছে তারা আমাদের এসব বই পড়েননি। তাই সবাইকে বলবো, চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে চিলের পিছনে দৌড়াবেন না। সত্য যাচাই করে নিন। সত্য গোপন করে মিথ্যাচার করা কোনো ঈমানদার মুসলমানের কাজ হতে পারে না।
ব্র্যাকের শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও ম্যাইগ্রেশন বিষয়ক পরিচালক সাফি রহমান খানের সভাপ্রধানে এবং ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি প্রধান কার্যালয়ের ম্যানেজার প্রসেনজিৎ বিশ্বাসের সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর আল-আমিন একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ সাইফুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মোঃ জিল্লুর রহমান জুয়েল, চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা শাহনাজ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ইয়াসির আরাফাত। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ, সাংবাদিক, ব্র্যাকের কর্মকর্তা-কর্মচারিবৃন্দ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে শিক্ষা কর্মসূচির প্রোগ্রাম প্রধান প্রফুল্ল চন্দ্র বর্মণসহ ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয় এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
ব্র্যাক কর্মকর্তারা জানান, বিজ্ঞান তরী ও গণিত তরীর পাশাপাশি আছে মূল্যবোধ তরী। শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা কার্যক্রমে আগ্রহী করতেই এই উদ্যোগ।
ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরপূর্তি (সুবর্ণজয়ন্তী) উপলক্ষে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি একটি বিশেষ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়। এর অধীনে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সুনামগঞ্জের উত্তর-পূর্ব জেলা থেকে যাত্রা শুরু করে তিনটি বিষয়ভিত্তিক ‘অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষা তরী’। শিক্ষাতরীগুলোতে মূলত শিক্ষার্থীদের মাঝে এই তিনটি বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে। নৌকাগুলো তাদের যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে থামছে।
শিক্ষাতরী বিভিন্ন ঘাটে ৭ থেকে ১০ দিনের জন্য থামছে। থেমে থাকার এই সময়টাতে তীরবর্তী এলাকার শিশু, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয়রা নৌকাগুলো পরিদর্শন ও বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। পরিদর্শনের জন্য তরী খোলা থাকছে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। যে ঘাটে শিক্ষাতরী ভিড়ছে, সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত শিক্ষকরা দর্শনার্থীদের তরীগুলো ঘুরে দেখতে সহায়কের ভূমিকা পালন করছেন।
শিক্ষা তরীর কার্যক্রম ও উপকরণগুলো বিশেষভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য সাজানো হয়েছে। তবে অন্যান্য শিক্ষার্থী এবং দর্শকরাও এখানে শেখার আনন্দ পাবেন। এছাড়াও শিক্ষাতরীগুলোতে থাকছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ র্যাম্প। অংশগ্রহণকারীদের জন্য মূল্যবোধের উপর নানা ধরনের কার্যক্রম এবং উপাদান থাকবে, অন্যদিকে গণিত এবং বিজ্ঞানের ধাঁধাঁ, হাতে-কলমে পরীক্ষা, মজার মজার নানা কার্যক্রম এবং গেম খেলে সমস্যা সমাধানের সুযোগ থাকছে। শিক্ষাতরীগুলো মহান বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ পোস্টার দিয়ে সাজানো হয়েছে।
মূল্যবোধ তরীটি ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের দর্শনে অনুপ্রাণিত। যিনি ব্র্যাক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মূল্যবোধ ও শিল্পকলা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
সবগুলো শিক্ষাতরী সিসিটিভি নজরদারির আওতায় রয়েছে এবং স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নির্দেশিকাসহ ব্র্যাকের সুরক্ষানীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে।
ব্র্যাক ২০১১ সালে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরে শিক্ষাতরী চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিলো বছরের বেশিরভাগ সময় জলে ঘেরা যেসব এলাকার শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাদের শ্রেণীকক্ষে নিয়ে আসা। শিক্ষাতরী প্রকল্পটি ফিনিশ বৈশ্বিক অলাভজনক শিক্ষা সংস্থা HundrED-এর পক্ষ থেকে ‘২০১৭ সালে বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণামূলক উদ্ভাবন’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।