প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২১, ০০:০০
জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সমাধান চায় শহরবাসী
আলোচিত সেই বাড়িটির প্রকৃত মালিক কে?
সর্বোচ্চ আদালতের রায় গোপন রেখে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বাড়িটি দখলে নিয়েছেন প্রীতি রাণী ঘোষ : বাদী হোসনে আরা
মালিকানা দাবির সপক্ষে বৈধ কোনো কাগজ নেই। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত কোথাও মালিকানা স্বত্ব দাবি প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এমনকি সর্বশেষ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও বিপক্ষে। এরপরও বাড়িটি দখলে নিয়ে সেই বাড়িতে ১৪ বছর যাবত বসবাস করছেন, দোকানও ভাড়া দিয়েছেন। এই আলোচিত বাড়িটি হচ্ছে চাঁদপুর শহরের জোড় পুকুরপাড়ের পূর্ব পাশে জেএম সেনগুপ্ত রোডের সাথে লাগোয়া ‘প্রীতি কুঞ্জ’ নামে দোতলা বাড়ি। আর এই অবৈধ দখলদার হচ্ছেন (বাদীর বক্তব্য অনুযায়ী) প্রীতি রাণী ঘোষ, স্বামী মৃত সুখময় ঘোষ।
|আরো খবর
২০০৭ সালের জুন মাসে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি হুকুম দখল শাখা থেকে প্রীতি রাণী ঘোষকে আরসি ২৬/৪৮নং এই বাড়িটি দখল বুঝিয়ে দেয়ার ঘটনাটি তখন পুরো শহরে বেশ আলোচিত একটি ঘটনা ছিল। দীর্ঘ সাড়ে ১৩ বছর পর ওই বাড়ির প্রকৃত মালিক দাবিদার হোসনেআরা তার বাড়ি ফিরে পেতে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের দখল হস্তান্তরের আদেশ (২০/০৬/২০০৭ তারিখের স্মারক নং আরসি ২৬/৪৮/২০০৭-১৩৪) বাতিলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ফের বাড়িটি নিয়ে আলোচনায় আসে। গত ৬ জুলাই জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির সরজমিনে পরিদর্শনে আসা এবং এ সংক্রান্ত সংবাদ পরেরদিন ৭ জুলাই চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশ হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে শহরে আবার আলোচনার ঝড় উঠে। বাড়িটির আসলেই প্রকৃত মালিক কে- এ প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।
এদিকে এই বাড়িটির (চার দরজা বিশিষ্ট, ১ শতাংশ ৮৯ পয়েন্ট) ক্রয় সূত্রে মালিক দাবিদার ফরিদিয়া হোমিও হলের স্বত্বাধিকারী ডাঃ ফরিদ উদ্দিন আহমেদের মেয়ে হোসনেআরা (স্বামী মৃত খালেদুর রহমান খালেদ) গত বছরের অর্থাৎ ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান বরাবরে দখল হস্তান্তরের আদেশ বাতিলের আবেদন করেছেন। তা থেকে জানা যায়, প্রীতি রাণী ঘোষ সম্পূর্ণ অবৈধভাবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ২০০৭ সালে বাড়িটি দখলে নিয়েছেন। জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার ব্যাখ্যা হোসনেআরা এভাবে দিয়েছেন যে, আন-রেজিস্টার্ড পাওয়ার অব এটর্নি মূলে (যার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই) প্রীতি রাণী ঘোষ নালিশী সম্পত্তিসহ নালিশী দাগের সমুদয় সম্পত্তিতে মালিকানা দাবি করে শান্তি পদ দত্তকে বিবাদী করে চাঁদপুর সহকারী জজ আদালতে ২৮১/১৯৮১ইং স্বত্ব মোকদ্দমা দায়ের করে সুকৌশলে একতরফা ডিক্রি হাসিল করেন। পরবর্তীতে শান্তি পদ দত্ত উক্ত ২৮১/১৯৮১ইং স্বত্ব মোকদ্দমার ডিক্রির বিরুদ্ধে কুমিল্লা জজ আদালতে ১৭৬/৮২ইং নং আপীল মোকদ্দমা দায়ের করেন এবং প্রীতি রাণী ঘোষের নামীয় ডিক্রি বাতিলের আদেশ হয়। প্রীতি রাণী ঘোষ উক্ত ১৭৬/৮২ইং রায় ডিক্রির বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে ৩৪/৮৪ নং সিভিল রিভিশন মোকদ্দমা দায়ের করলে দোতরফা সূত্রে শুনানি শেষে তা খারিজ হয়ে যায়। প্রীতি রাণী ঘোষ মহামান্য হাইকোর্টের উক্ত ৩৪/৮৪ নং মোকদ্দমার রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল লীভ টু আপীল ৩৪৬/১৯৮৫ইং নং মোকদ্দমা দায়ের করলে এটিও দোতরফা সূত্রে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে যায়।
হোসনেআরা আবেদনে আরো উল্লেখ করেন, প্রীতি রাণী ঘোষ নালিশী সম্পত্তিতে মালিকানার সপক্ষে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত মামলা মোকদ্দমা করে কোনোপ্রকার রায় ডিক্রি অর্জন করতে পারেন নাই। অর্থাৎ নালিশী সম্পত্তিসহ নালিশী দাগের কোনো সম্পত্তিতে প্রীতি রাণী ঘোষের কোনোপ্রকার স্বত্ব স্বার্থ মালিকানা কিছুই নাই। পরবর্তীতে প্রীতি রাণী ঘোষ সকল মামলা-মোকদ্দমার রায় ডিক্রি গোপন করে নালিশী সম্পত্তিসহ নালিশী দাগের সমুদয় সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে ওই আন-রেজিস্টার্ড পাওয়ার অব এটর্নি মূলে সদর সহকারী জজ আদালত, চাঁদপুর-এ ২১৫/১৯৮৭ইং নং স্বত্ব মোকদ্দমা দায়ের করলে এই মোকদ্দমার রায়ের পর্যালোচনায় প্রীতি রাণীকে ‘এতোটা নির্লজ্জ ডাহা মিথ্যা কথা বলিয়া আদালতের উপর প্রতারণা করিবে ইহা কাম্য নহে’ বলে মন্তব্য করে মামলা খারিজ করে দেয়।
২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের বরাবরে দখল হস্তান্তরের আদেশ বাতিল চেয়ে হোসেনেআরা আবেদন করার পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাজেদুর রহমান খান ৬ ডিসেম্বর প্রতিপক্ষ প্রীতি রাণী ঘোষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেন। প্রতিপক্ষ বিগত ৪/১/২০২১ তারিখে জেলা প্রশাসক বরাবরে আপত্তি দাখিল করলে গত ২৪ মে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে বিজ্ঞ কৌঁসুলিগণ ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় বিজ্ঞ ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ও বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অমিত চক্রবর্তীর উপস্থিতিতে দীর্ঘ শুনানি হয়। শুনানি শেষে উভয়পক্ষকে ওই বাড়ি সংক্রান্ত লিখিত জবাব দাখিল এবং আরো অধিক শুনানির জন্যে গত ৬ জুন এলএ শাখায় উপস্থিত থাকার জন্যে বলা হয়। এরপর জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত টিম গত ৬ জুলাই নালিশী বাড়ি সরজমিনে পরিদর্শন করেন।
এদিকে ১৯৯৮ সালে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে চার সদস্যের যে তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়, তাঁদের প্রতিবেদনের একটি অংশে উল্লেখ করা হয়, ‘অতএব, আমার উপরোক্ত বক্তব্য ও আলোচনার প্রেক্ষাপটে যে ক্ষেত্রে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত মামলা মোকদ্দমা করিয়া বর্তমানে দরখাস্তকারীনি প্রীতি রাণী ঘোষ নালিশী সম্পত্তিতে স্বত্বার্জন করে নাই মর্মে সুনির্দিষ্ট ফাইন্ডিংস রহিয়াছে, সেক্ষেত্রে তাহার দরখাস্ত বিবেচনা করার মতো সুযোগ নাই বলিয়া আমি মনে করি।’ এই প্রতিবেদনের শেষাংশে উল্লেখ করা হয়, ‘দাখিলকৃত কাগজপত্র ও প্রতিবেদন পর্যালোচনাক্রমে উপযুক্ত আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা বা সরকারের ভিন্নরূপ কোনো আদেশ না থাকিলে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে উত্তম দাবিদার হিসেবে জনাব খালেদুর রহমান খালেদকে (স্বামী হোসনেআরা) রিকুইজিশন অংশের দখল ছাড়িয়া দেওয়া যাইতে পারে’। ২৪/১২/১৯৯৮ইং তারিখে দেয়া এই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর, ভূমি হুকুম দখল অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) চাঁদপুর সদর ও এডঃ মোঃ ইয়াসিন, সরকারি কৌঁসুলি, চাঁদপুর।
আবেদনকারী হোসনেআরা উল্লেখ করেন, প্রীতি রাণী ঘোষ তার বিপক্ষে যাওয়া এই সকল মামলার রায় এবং তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গোপন রেখে ২০০৭ সালে এই বাড়ি দখলে নেয়।
জেলা প্রশাসকের কাছে চাঁদপুরবাসীর দাবি, সকল কিছু পর্যালোচনা করে চাঁদপুর শহরের জোড় পুকুরপাড় এলাকার আরসি ২৬/৪৮ বাড়িটি প্রকৃত মালিককে বুঝিয়ে দেয়া হোক।