প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রাষ্ট্র-সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর নিকট ইতিবাচক অঙ্গীকার কাঙ্ক্ষিত
অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, কখন নির্বাচন হবে, কখন রাজনৈতিক-সংস্কারের কার্যক্রম শুরু এবং শেষ হবে। এরই মধ্যে বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে, সেই ছাত্র-জনতা চায় দেশের প্রয়োজনীয় সংস্কার। এ ক্ষেত্রে তাদের কমিটমেন্ট নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দেশের প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘদিনের। বর্তমান সরকার চায় এবং আমরাও চাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ সংস্কার। কারণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার উপর দেশের গণতন্ত্র-পথের বিকাশ হয় এবং গণতন্ত্র কার্যকর হয়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কোনো সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে, তাহলে কোনোভাবেই সেই দেশে গণতন্ত্র যথাযথভাবে পরিচালিত হতে পারে না।
আমাদের দেশে নানা ধরনের সংকট রয়েছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন থেকে সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি জনগণের আস্থায় আনা সম্ভব হয়নি। যখন যে সরকার এসেছে, তারা সেভাবেই তাদের মতো করে নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে সাজানোর চেষ্টা করেছে। জনগণের চরম প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনী-ব্যবস্থায় আস্থার-সংকট থেকেই গেছে। আমরা দেখেছি এবং উপলব্ধি করেছি, ৯০ পরবর্তী প্রায় প্রতিটি সরকারের মেয়াদ শেষেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। কখনো সংকট থেকে উত্তরণ হলেও আবার কখনো রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিবেশ জাতির এবং এদেশের মানুষের জন্যে দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই আনতে পারেনি। রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের শীর্ষ নেতারা বলে থাকেন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। আর যারা বিরোধীদল মাঠে থাকেন, তারা বলে থাকেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকার করা হয় বটে, গণতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনোটাই রক্ষিত হয়নি।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্যে দেশের রাজনীতিবিদরা অতীতে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো তাঁরা রক্ষা করতে পারেননি। যেমন- ’৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখার মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নানা রকম সংস্কারের অঙ্গীকার করেছিল। তারা জাতীয় সংসদকে সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করাসহ বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে বিদ্যমান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই তিন জোটের রূপরেখার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারে নি। বিরোধী দলগুলো সংসদের অধিবেশনগুলো বর্জন করেছে প্রতিনিয়ত। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সরকারের সহযোগী-বিরোধী দল সেজে সংসদকে কার্যকর করার কোনো প্রক্রিয়াই তারা অবলম্বন করেনি। বরং নিকট অতীতে রাজনৈতিক দল সংসদকে সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো আজও একই কণ্ঠে অঙ্গীকার করতে পারেনি, তারা বর্তমান সময়ে যে সমঝোতা এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং দেবে, তা আগামী দিনেও যথাযথভাবে মেনে চলবে। সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে পুনরায় দেশে কোনো অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে না।
উল্লেখ্য, যদিও বহুদিন পূর্ব থেকে ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখা এবং বিএনপি সহ বিশ দলীয়-জোট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছিল। দেশের সব রাজনৈতিক দলকে হতে হবে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ, জবাবদিহি এবং গণতন্ত্রমনা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিশ্রুতি দেয় ঠিকই, কিন্তু তা রক্ষায় তাদের সফলতার পরিমাণ খুবই নগণ্য। সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক-সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও দলতন্ত্র ও স্বার্থতন্ত্রের লাগামহীন চর্চার ফলে তারা যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সংগঠিত পেশাগত ও নাগরিক সমাজের বেশিরভাগ আজ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিক-অনুগত। ’৯০-এর গণ-আন্দোলনের সময়ে একতাবদ্ধ শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও অন্যান্য পেশাজীবীর অনেকেই তাঁদের অতীতের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে এখন দলীয় অঙ্গ কিংবা সহযোগী সংগঠনের খাতায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। ফলে তাঁরা গণতান্ত্রিক শাসনকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে অতন্দ্র-প্রহরীর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকলেও দেশে একটি প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান অর্থাৎ এখানে প্রধানমন্ত্রীই সব ক্ষমতার মূলে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কিছুই কার্যকর অর্থে করা সম্ভব নয়। এখানে যিনি দলীয় প্রধান তিনিই সরকার প্রধান, তিনিই সংসদীয় নেতা, আর রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে থাকলেও তিনি রাষ্ট্রের প্রতীক।
সংবিধান মতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সকল কাজ করে থাকেন। অপরদিকে সংসদীয় বিধান মোতাবেক সংসদে সরকারের প্রতি অনাস্থা আনার বিধান থাকলেও সংবিধানে বর্ণিত ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। বস্তুত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু যদি এক ব্যক্তি হন, তাহলে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির মাত্রার চেয়ে দুর্নীতি কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগই বেশি তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে লর্ড অ্যাক্টনের ভাষায়, ‘ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয়, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়।’ বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতিতে যেভাবে একতাবদ্ধ হয়েছে তা রক্ষা করা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেন সঠিক এবং ন্যায্য-কাঙ্ক্ষিত পথে এগিয়ে যায়, সেটি আমাদের প্রত্যাশা। এজন্যে শেষান্তে বলতে চাই এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদের আহ্বান রইলো, আপনারা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতা এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে পুনরায় ক্ষমতা ধরে রাখার নতুন ফন্দি করতে সচেষ্ট না হয়ে গণতন্ত্র রক্ষার সংস্কৃতি তৈরির অঙ্গীকার করুন।