বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

প্রোপাগান্ডা এখন নাগরিক-সংস্কৃতির একটি অংশ

অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার

অনলাইন ডেস্ক
প্রোপাগান্ডা এখন নাগরিক-সংস্কৃতির একটি অংশ

প্রোপাগান্ডা এক ধরনের শক্তি। এই শব্দচয়নটি আজকের দিনে বহুল প্রচলিত। চেয়ার-টেবিলের মতো এ শব্দটি ইংরেজি থেকে বাংলায় ঢুকে যাচ্ছে। যা সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ ব্যবহার করেন এবং যারা খানিকটা গুরুগম্ভীর আলোচনা করেন, তারা এই শব্দচয়নটি ব্যবহার করেন বেশি। বস্তুত প্রোপাগান্ডা বলতে যা বুঝায়, Propaganda is the dissemination of informationÑfacts arguments, rumours, half-truths, or lies-to influence public opinion. Its misleading nature, used to promote a political cause or point of view অর্থাৎ প্রোপাগান্ডা হলো এমন এক ধরনের পক্ষপাতমূলক ও ভ্রান্ত তথ্য যা একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশ্যের প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সাধারণত আংশিক-সত্য বা আংশিক-মিথ্যাকে বা সম্পূর্ণ-মিথ্যা তথ্যকে প্রচার করে।

আরো সহজ করে বললে বলা যায়, কোনো তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা এবং মিথ্যা তথ্যটি প্রতিষ্ঠা করা। তবে এখানে কিছু বিষয় যুক্ত থাকে। যেমন-বিকৃতির ক্ষেত্রে সাধারণত দলীয়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থোদ্বারের চিন্তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এ কারণে উদ্দেশ্য সাধনে পরিকল্পিতভাবে তথ্যগুলো বিকৃত করা হয়। বিকৃতির পাশাপাশি বিকৃত সে তথ্য মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার ব্যবস্থা নেয়াও এ প্রক্রিয়ার অংশ। এ ক্ষেত্রে বহুল প্রচারিত সহজ উপায় এবং প্রচারের মাধ্যমেই মানুষের কাছে তা পৌঁছানো হয়। বিকৃত এসব তথ্য বা ঘটনা আংশিক সত্য, যাকে ‘মিথ্যা’ বললে হয়তো ভুল হবে না। ক্রমাগত এসব মিথ্যাকে প্রচারের মাধ্যমে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়। বিখ্যাত দার্শনিক গোয়েবলস বলেছেন, ‘একটা মিথ্যাকে পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে তার প্রতি মানুষের বিশ্বাস আনা সম্ভব। এমনি একটি সময়ে আপনি নিজেও তা বিশ্বাস করতে শুরু করবেন।’

বর্তমানে তথ্যের অবাধ বিস্তারের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে উপজাত হিসেবে বিকৃত তথ্যের অবাধ বিচরণ বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে কেবল বৃদ্ধিই পায়নি, হয়ে উঠেছে জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। সহজলভ্য এবং একই মাধ্যম দ্বারা বহুজনের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ থাকার কারণে তথ্য প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক, ইনস্ট্যগ্রাম, টুইটার প্রভৃতি। বিগত দশকে এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি রাজনীতি থেকে ব্যবসা-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে হয়ে উঠেছে প্রোপাগান্ডার অন্যতম অনুষঙ্গ।

কয়েকদিন আগে এক অপপ্রচার হয়-শেখ হাসিনা বিদেশে পলায়ন করেছে, যা তিনি নিজে বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে খালেদা জিয়া মারা গেছেন এরূপ অপপ্রচার ঘটে, যা বিএনপির সেক্রেটারী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। তবে আর যাই বলুন না কেন, এ ধরনের মিথ্যা প্রচার মারাত্মক রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক প্রোপাগান্ডা না হলেও প্রোপাগান্ডা তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সাম্প্রতিক দুটি ঘটনাই যথেষ্ট উদাহরণ। কেননা প্রোপাগান্ডা সাজানোর ক্ষেত্রে তা যাদের কাছে প্রচারিত হবে তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝা দরকার। এ অঞ্চলের মানুষ আবেগী বয়ান শুনতে পছন্দ করে।

প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রে এ ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি হওয়া কাহিনীর উদাহরণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখান থেকে বাংলাদেশে প্রোপাগান্ডা প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তিটা বোঝা যায়। এ ধরনের প্রোপাগান্ডা পরবর্তী সময়ে আরো বড় প্রোপাগান্ডা তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করবে। যেমন এবারের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’, পূর্বের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রান্তিক সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানকে পর্যন্ত প্রভাবিত করেছে। সেই কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে ‘গুজব’ কথাটি খুব শুনেছি এবং বলা হচ্ছিল গুজব ছড়ানো যাবে না। একটা পর্যায়ে এ ‘গুজব’ শব্দটিকেই একটি ‘প্রোপাগান্ডা টুল’ হিসেবে ব্যবহার করে পরবর্তী সময়ে নানা সুযোগ নেয়া হয়েছে। কোনো কথার অভিযোগ উঠলেই ‘গুজব’ বলেই তাকে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি বহুকাল ধরেই প্রোপাগান্ডা তৈরির অনুষঙ্গ। এখনো চলমান। মানুষের বিশ্বাস এবং নৈমিত্তিক জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলোকে ব্যবহার করেই কাজটি করা হয়। প্রতিনিয়ত কাজটি করা হচ্ছে, কখনো ঢাকঢোল পিটিয়ে, আবার কখনো খুব কৌশলের সঙ্গে। ব্যাপারটা এক পর্যায়ে এমন হয় যে, প্রতিটা মানুষ প্রোপাগান্ডার উপাদান হয়ে উঠে।

এ সময়ে এসে ‘প্রোপাগান্ডা টুল’ বদলে গেছে। আগে যেখানে আড্ডা কিংবা আলোচনা, পাঠচক্র, গোপন-সভা থেকে শুরু করে মুখে মুখে ছড়ানো হতো। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা সহজে করা যায় এবং করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা তৈরি ও ছড়ানো এখন নাগরিক সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। সেখানেও বহু উপাদান রয়েছে-লেখার পাশাপাশি ছবি, ভিডিও এমনকি ইদানীং ‘মিম’ তৈরির মাধ্যমে কাজটি করা হয়।

একটা কথা বললে বলতে হয়, জুলাইয়ে প্রোপাগান্ডার-সাইবারযুদ্ধে সরকার, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ-চেতনার পক্ষের শক্তির পরাজয় ঘটেছে। ইন্টারনেট চালুর পর ইউটিউব যেন এখন মিথ্যার ঝুড়ি। ইউটিউব যেভাবে জুলাই তাণ্ডবের চিত্রকে একপেশে বিকৃতভাবে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, তা রীতিমত ভয়াবহ। শিক্ষার্থী-তরুণরা টেলিভিশন দেখে না, সংবাদপত্র পড়ে না বললেই চলে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি জড়িত থাকে। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, ফেসবুক, টিকটক বন্ধ। কিন্তু তরুণরা ভিপিএন বা অন্য কৌশলে ঠিকই ফেসবুকে গুজব, অপপ্রচারগুলো গিলছে। আপিল বিভাগের রায় এবং সরকারের পরিপত্রের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সন্তোষ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি হয়নি। আবেগপ্রবণ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উত্তেজিত করার সব মাল-মসলা উগলে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনন্তকাল বন্ধ রাখা যাবে না। সেনাবাহিনীও একসময় ব্যারাকে ফিরে যাবে। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ বিতাড়িত, সমঝোতা করে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর বিশ্বাস কিংবা আস্থা রাখবে না। ছাত্রলীগের চেয়েও করুণ অবস্থা আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের। এ শিক্ষকদের বেশির ভাগই দলকানা। পদ-পদবির জন্য নানা দেনদরবারে তাদের বেশির ভাগ সময় কাটে। তারা শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হয়ে উঠতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবকতুল্য দল নিরপেক্ষ শিক্ষকরা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এ শিক্ষকরা বিবেকের তাড়নায় থানায় গিয়ে তাদের ছাত্রকে মুক্ত করেছেন। ডিবি অফিসে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের খোঁজ-খবর নিতে গেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ ও আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ নাই বললেই চলে। আর ব্যক্তিগত যোগাযোগ কম বলেই ফেসবুক-প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের এই সংকটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তোলপাড়। এটার কারণও সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম। বাংলাদেশ নিয়ে একপেশে বিতর্কিত সংবাদগুলোকে লুফে নিয়েছে আন্তর্জাতিক বেশ কিছু গণমাধ্যম। নেতিবাচক খবরে সয়লাব বিশ্ব মিডিয়া। অনেকক্ষেত্রে সন্ত্রাসীর মৃত্যুকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু বলা হচ্ছে। বেঁচে থাকা শিক্ষার্থীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে বলতে হচ্ছে ‘আমি মরি নাই।’ এর ফলে বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এটি সৃষ্টি করতে পারে নতুন বিদেশি চাপ। এ চাপ দেশে আন্দোলনকে নতুন করে উসকে দিতে পারে। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিএনপির আন্দোলনে নতুন প্রাণ দিয়েছিল।

যত কথাই বলি না কেন, আজকের দিনে প্রোপাগান্ডা দ্রুত ছড়ায়। বিকৃত হোক বা না হোক এবং যে উপায়েই ছড়াক, প্রোপাগান্ডা সফল হয়ে চলছে। আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় (এমন কি পরাজয়) থেকে শুরু করে ভারতের দিল্লিতে দাঙ্গা, ইউরোপে শরণার্থী সমস্যা-সব ক্ষেত্রেই প্রোপাগাণ্ডা ব্যবহৃত এবং সফল। কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়।

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার : সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়