বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

আমার বাবু ভাই : স্মৃতির অ্যালবামে উজ্জ্বল মুখ

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

অনলাইন ডেস্ক
আমার বাবু ভাই : স্মৃতির অ্যালবামে উজ্জ্বল মুখ

তাঁকে নিয়ে এতো তাড়াতাড়ি শোকগাথা লিখতে হবে ভাবিনি। তিনি একজন চির তরুণ। সকালে আদালত প্রাঙ্গণে কর্মের প্রয়োজনে বিচরণ। বক্স ভরে নিয়ে যান অপরাহ্ণের আহার। তাঁর কাছে আসা বিচার প্রার্থীদের সবার সমস্যা আইনজীবী হিসেবে সামাধান করেন। তারপর দুপুর গড়িয়ে সূর্য পাটে যাওয়ার সময় হলেই তিনি আহার গ্রহণ করেন। সন্ধ্যাটুকু চেম্বারে কাটিয়ে পরের দিনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে রাত নামার আগে আগে ছোটেন চাঁদপুর ক্লাবের খেলার মাঠে। ব্যাডমিন্টনের শাটলে শরীরে জমে থাকা ক্যালরির দহন ঘটিয়ে নিজেকে ঝরঝরে করে তোলেন প্রতিদিন। খুবই ছকে বাঁধা জীবন। মাঝে বেশ কিছুদিন শুক্র-শনি ছুটির দিনে তিনি গাছ বাইতেন। অর্থাৎ এক এক জায়গায় বেড়াতে যেতেন এবং গাছের সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। তাঁর এই গাছে চড়া ছবি কিংবা গাছলগ্ন হয়ে তোলা ছবি দেখে ঐ জায়গায় আমরাও না গিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পেয়ে যাই। বেশ ভ্রমণপ্রিয় তিনি। দেশের ভেতরে তাঁর ভ্রমণ করার বাইরে খুব একটা বেশি জায়গা নেই বললেই চলে। দেশ পেরিয়ে নেপাল, কাশ্মীর, দার্জিলিং থেকে শুরু করে ভারতের আরও বেশ কয়েকটা জায়গায় তিনি তাঁর পদধূলি রেখেছেন। কাশ্মীরে গিয়ে ঘোড়ায় চড়া এমন একটা ছবি তিনি তুলেছেন, মনে হোলো গব্বর সিং যেন নতুন রূপ পেলেন। এ নিয়ে তাঁকে কত যে খেপিয়েছি! তিনি কখনও পাল্টা জবাব না দিয়ে আমাকে ছাড় দেননি। জবাব দেবেন বলেইতো তাঁকে আমি খোঁচাতাম। তাঁর ভালোবাসার গভীরতা আমার জানা ছিলো বেশ। তাই সেই স্নেহের কলসকে মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে, কাত করে কিছু কিছু ভালোবাসা আদায় করে নিই।

রোটারিয়ান হিসেবে তিনি খুব সক্রিয় ছিলেন। নতুন প্রজন্মের ভাষা ও নাড়ির গতি তাঁর জানা ছিল। তাই পুরনোদের পাশাপাশি নতুন রোটারিয়ানদের কাছেও তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। রোটারী ক্লাবে একটা রীতি আছে। প্রতিজন রোটারিয়ানকে পরিচিত হওয়ার সময় তার পেশাগত পরিচয় তুলে ধরতে হয়। কেননা রোটারী মূলত ‘সেবা স্বার্থের ঊর্ধ্বে’ হলেও এ আন্দোলন বহু বিচিত্র পেশাজীবীর সম্মিলন। এই আত্মপরিচিতি তুলে ধরার সময় নিজের পেশার পরিচিতি তুলে ধরাকে বলে ক্ল্যাসিফিকেশন। অর্থাৎ রোটারী ইন্টারন্যাশনাল হতে রোটারীতে অন্তর্ভুক্ত পেশাজীবীদের পেশার একটা তালিকা দেওয়া আছে এবং পরিচয়দাতা উক্ত তালিকার কোন্ শ্রেণিতে পড়েন তা উল্লেখ করতে হয়। বাবু ভাইয়ের যখন পরিচয় দেওয়ার সময় আসতো তখন তাঁকে বলতে হতো, ‘আমার ক্ল্যাসিফিকেশন হলো ল প্র্যাকটিস, ক্রিমিনাল’। সেই কারণে আমিসহ আরো অনেকেই বাবু ভাইকে খোঁচাতাম, ‘বাবু ভাই ক্রিমিনাল’ বলে। তিনি এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মুচকি হেসে আমাদের দুষ্টুমি প্রশ্রয় দিয়ে অনুমোদন করতেন। মাঝে মাঝে প্রত্যুত্তরে আমার পেশাকে উল্লেখ করে বলতেন, ‘নাড়ি টিপলেই পাঁচশো’। এভাবেই আমাদের বড়োভাই-ছোটভাইয়ের খুনসুঁটি চলতো আর অন্যরা তা উপভোগ করতো। পবিত্র মাহে রমজানে আমাদের রোটারী ক্লাবে প্রতি শুক্রবার অপরাহ্ণে সাপ্তাহিক মিটিং হয়। বিকেল পাঁচটা থেকে ইফতার অব্দি। তিনি প্রতি রমজান মাসে কোনো না কোনো এক সভায় অতিথি সেবক থাকবেনই। যেদিন তাঁর আয়োজনে ইফতার থাকতো, আমরা বুঝে নিতাম, আজ ফল উৎসব হবেই হবে। ওনার ইফতার আয়োজনে রসাল ফলের বাহার থাকতো। রোটারী ক্লাবের বড় কোনো অনুষ্ঠানে র‌্যাফেল ড্র-এর মাধ্যমে কিছু উপহার বণ্টনের রেওয়াজ আছে, যাতে ক্লাবের সকল সভ্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। গত কয়েক বছর ধরে একটা রেওয়াজ চালু হয়ে গিয়েছিলো অলিখিতভাবে, র‌্যাফেল ড্র-তে নিজের কয়েকটা টিকেট ক্রয়ের পাশাপাশি বাবু ভাই নিলামে টিকেটের একটা আস্ত বইই কিনে নিতেন। তিনি একাই জমিয়ে দিতেন আমাদের র‌্যাফেল ড্র পর্বটি।

একবার শহিদ দিবসের জাগরণীতে উনি, আমি এবং আমার পত্নী রাত বারোটার আগে মহান ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে সমবেত হয়েছিলাম কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার চত্বরে। আমার গলায় ঝুলছিল একটা মাফলার। মাফলারটা গলায় দেখে উনি আমাকে বললেন, এটা আমি নিয়ে নিলাম। এই বলে তিনি আমার গলা থেকে নিয়ে তাঁর গলায় পরে নিলেন। ক’দিন পরে ওনার সাথে আমাদের পরিবারের দেখা। আমার পত্নীকে (ওনার ছোট বোনস্নেহে দেখতেন) বললেন, ‘মুক্তা, মাফলারটা নিয়ে আমার একটু মনে কষ্ট হচ্ছিলো, পীযূষের প্রিয় জিনিসটা নিয়ে নিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, এটা ঔষধ কোম্পানি দিয়েছে, তখন আর কষ্ট নেই। এরকমতো আমার আরও নেওয়া উচিত।’ তাঁর এ কথায় আমরা কি আর না হেসে পারি?

রোটারী ক্লাবে অবৈতনিক সচিব পদে আমার দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিলো ২০২২-২৩ রোটাবর্ষে। কোনও কারণে আমি বেগড়বাই করলে তিনি রাত বারোটায় আমার বাসায় এসে আমাকে ম্যানেজ করলেন। তিনি যদি না আসতেন বাসায়, আমার হয়তো সেদিন সিদ্ধান্ত পাল্টাতো না। সে বছর আমার দায়িত্ব পালনকালীন তিনি আমাদের রোটারী ডিস্ট্রিক্টে পদ্মা জোনে ‘বেস্ট ডেপুটি গভর্নর’ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

একবার তাঁর বিবাহবার্ষিকীতে আমরা সপরিবার কেক নিয়ে সোজা ওনার বাসায় চলে যাই। ওখানে সেদিন অ্যাডভোকেট পলাশ মজুমদারও ছিলো। এতো আন্তরিকতার সাথে আমাদের আপ্যায়ন করলেন, আমার মনেই ছিলো না আমার বউয়ের কোনো বড় ভাই নাই। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ, চাঁদপুর জেলা শাখা একটা স্মারকগ্রন্থ বের করবে। আমি দায়িত্ব পেলাম তাঁর লেখা নেওয়ার। তাঁকে আমরা বিষয় নির্বাচন করে দিয়েছিলাম, ‘আইনের ছাত্র বঙ্গবন্ধু’ এই শিরোনামে। দুদিন পরে তিনি আমাকে ফোনে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই মিয়া, আমি কি লিখতে পারি নাকি তোমার মতো?’ তাঁর ধমক খেয়ে আমি দমে গেলাম না। বরং সোৎসাহে তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য। সুতরাং কেউ যদি এ বিষয়ে লেখতে পারে, তবে সেটা আপনিই। দেখলাম, মানসিক প্রণোদনায় কাজ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের কয়েকদিন আগেই একটা ভালো লেখা তিনি পাঠিয়েছিলেন। আরও সুখের কথা এই, ঘোর করোনাকালে তিনিই বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের উপদেষ্টা হয়ে এ স্মারকগ্রন্থটি ঢাকায় দীপু আপার বাসায় ওনাকে দিয়ে মোড়ক উন্মোচন করিয়েছিলেন।

দাড়ি রাখার পরে হুট করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, উনি বুঝি আই কে গুজরাল-এর লুক এ লাইক। তাঁর দাড়ি-গোঁফে তাঁকে সত্যিই তখন দেখতে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দর কুমার গুজরালের মতোই আমার মনে হয়েছিলো। শুধু বাবু ভাই একটু ক্ষীণ স্বাস্থ্যের ছিলেন এই যা।

প্রতিদিন সকালে আমি যখন আমার চেম্বারে যেতাম রিকশা চড়ে, তাঁর সাথে প্রায়ই আমার দেখা হতো। তিনিও রিকশা চড়ে যাচ্ছেন আদালতে। গায়ে শাদা ফুল হাতা শার্ট আর কখনো কালো প্যান্ট কখনো বা ধূসর। মৃদু হেসে হাল্কা হাত নাড়িয়ে আমরা একে অপরকে পেরিয়ে যেতাম যে যার গন্তব্যে। বাবু ভাইয়ের সাথে আমার স্মৃতির বহর অনেক। সবই সুখস্মৃতি। তাঁর সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। কেবল একটা কষ্ট আমার থাকবে আজীবন। চাঁদপুর ২৫০ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতালে তাঁকে পেয়িং বেডে ভর্তি অবস্থায় আমরা দেখতে যাই শেষ অসুস্থতার সূচনাকালীন রোগশয্যায়। জ্বরে জীর্ণ তাঁর সেই মিইয়ে আসা মুখখানি আমার চোখে জেগে আছে আজও। মলিন, বেদনাক্লিষ্ট। অথচ এ লোকটা স্বাভাবিক থাকলে তাঁর সাথে দু-চারবার কথার খোঁচাখুঁচি হতো। আহ্! বাবু ভাই! এতো সকালে আপনার সন্ধ্যা নেমে এলো কেন? আপনার তো আমাদের রোটারী ডিস্ট্রিক্টের গভর্নর পদে দাঁড়ানোর কথা ছিলো। আপনার তো আমাদের ছায়া-মায়া দিয়ে আগলানোর কথা ছিলো। সে দায়িত্বের ভয়ে আপনি আগেই লুকিয়ে গেলেন! ধূর মিয়া! আপনি এতো কাপুরুষ? বাবু ভাই! আমার ক্রিমিনাল বাবু ভাই!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়