শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪  |   ৩০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা গণফোরামের কর্মী সমাবেশ
  •   নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে ফরিদগঞ্জে অবাধে ইলিশ বিক্রি
  •   পিকনিকে যাওয়া শিক্ষার্থীর মরদেহ মেঘনায় ভেসে উঠলো দুদিন পর
  •   নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি না করার শপথ করিয়েছেন এমএ হান্নান
  •   বিকেলে ইলিশ জব্দ ও জরিমানা

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

ডাঃ সুকুমার দাস স্মরণ

একটি গোবরে পদ্ম ফুলের নিভৃতে ঝরে যাওয়া

রফিক আহমেদ মিন্টু
একটি গোবরে পদ্ম ফুলের নিভৃতে ঝরে যাওয়া

লন্ডনে বসবাসরত খ্যাতিমান চিকিৎসক সুকুমার দাস, এই চাঁদপুরেরই সন্তান, সম্প্রতি গত হয়েছেন। ডাঃ সুকুমার দাস চাঁদপুর তথা বাংলাদেশে বিশেষ পরিচিত নন। শুধু প্রথম সারির কিছু চিকিৎসক হয়তো তাঁর নাম জানেন। কিন্তু নানা দিক থেকে তাঁর জীবন এবং তাঁর গড়ে ওঠা অনুসরণীয় শিক্ষার্থীদের কাছে, প্রজন্মের কাছে।

চাঁদপুরের একটি পিছিয়ে পড়া এলাকা পুরাণবাজার দাসপাড়া। সেখানে একটি মৎসজীবী পরিবারে জন্ম হয়েছিল ডাঃ সুকুমার দাসের। সেই সময় দাসপাড়া এলাকায় শিক্ষার আলো একেবারে পৌঁছেনি। আত্মীয়-স্বজন প্রায় সবাই জেলে পরিবারের সদস্য। নদীতে মাছ ধরা এবং মাছ বিক্রি এ নিয়ে পাড়ার সবাই ব্যস্ত থাকে দিন-রাত। পড়াশোনায় উৎসাহদাতা লোকেরও অভাব। দাসপাড়ার ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাবে-এ রেওয়াজ তখনও শুরু হয়নি। তবু মেধাবী সুকুমার এবং তাঁর বন্ধু মনোরঞ্জন দাস এ দুজনই জেলেপাড়ার স্কুলপড়ুয়া ছেলে। ১৯৫৬ সাল তাঁর এসএসসি পরীক্ষার বছর। পরীক্ষার ক’দিন পূর্বে হঠাৎ তাঁর বাবা মারা যান। তখন পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে একটি শঙ্কা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন মুসলিম সহপাঠীর প্রেরণায় সুকুমার পরীক্ষা দেন এবং ভালভাবেই উত্তীর্ণ হন। অতঃপর কুমিল্লা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণের পর ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পান সুকুমার দাস। তখন দাস পাড়া এলাকার তাঁর আত্মীয় পরিজন সকলের গর্বের বিষয় হয়ে উঠেন তিনি। সর্ব দিকের সহযোগিতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৩ সালে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হয়ে বের হন সুকুমার। এলাকায় তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক বছরের মধ্যেই স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন চলে যান সুকুমার দাস। লন্ডনে কৃতিত্বের সাথে উচ্চতর অধ্যয়ন সম্পাদন করে যশম্বী হয়ে উঠেন সুকুমার দাস। প্রসিদ্ধ ডাক্তার হিসেবে তিনি স্বীকৃতি পান। বিলেতের আধুনিক এবং বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা গবেষণায় নিজের মেধা বিকাশের সুযোগ ছেড়ে আর বাংলাদেশে ফেরা হয়নি সুকুমার দাসের। এ ব্যাপারে তাঁকে দোষও দেয়া যায় না। কারণ আরো অভিজ্ঞতা অর্জন এবং গবেষণার মোহ তাঁর প্রধান ছিল। আর্থিক ব্যাপারটি মুখ্য ছিল না বলেই আমাদের মনে হয়েছে। যদিও সুকুমার দাসের আত্মীয় প্রতিবেশীদের একটি ইচ্ছা ছিল তাঁর দেশে ফিরে আসার, এলাকায় ফিরার।

পরবর্তীতে লন্ডনে বৃটিশ সরকারের উচ্চতর পদবী ধারণ করে সরকারি মর্যাদাসম্পন্ন চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ পান তিনি। ইতোমধ্যে তাঁর বন্ধু মনোরঞ্জন দাস অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাঁদপুর সরকারি কলেজের বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক হন। আমাদের সামনে যে বিষয়টা চলে আসে এবং শিক্ষার্থীদের অনুসরণীয় যে ব্যাপারটি তা হলো, জন্ম যেখানেই হোক, কর্মই মুখ্য। আমার পাশেই দাসপাড়া এলাকা। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সে পাড়াটিকে চরাঞ্চলের জেলেকান্দির মতোই মনে হতো। অর্থাৎ ঝুপড়ি ঘর আর খড়ের ছাউনিতে নদী তীরবর্তী কান্দি এলাকাগুলোকে দূর থেকে যেমন দেখায় অনেকটা সে রকম। কিন্তু তাতে করে সুকুমার-মনোরঞ্জন দের শিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটেনি। আর্থিক সমস্যা হয়েতো ছিল, কিন্তু শিক্ষার অদম্য বাসনার কাছে কোনো কিছুই তাঁদের বাধা হতে পারেনি। পরবর্তীকালে সে পথ দাসপাড়ার অনেকেই অনুসরণ করতে পেরেছেন। সুভাষ, ধিভাষ, তাপস তারাও দাস পাড়ার সন্তান এবং তিন জনই কৃষি কর্মকর্তা হয়েছেন। অঞ্জন দাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাপ্ত করে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া আছেন। তাঁর ভাই দুলাল দাস অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী।

শুধু শিক্ষা নয়, সংস্কৃতির আলোও সে পাড়ায় পড়েছে। আমাদের বন্ধু সুভাষ দাস সম্পর্কে সুকুমার দাসের ভাগিনা। তার কাছ থেকে আমরা সুকুমার দাসের যাবতীয় তথ্য পেতাম। সুভাষ দাসের মেয়ে সুকণ্ঠী স্বর্ণালী দাস রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ডাঃ সুকুমার দাসকে আমরা কয়েকবার পাড়ায় আসতে দেখেছি। আসলে দাসপাড়ায় কয়েকদিন থাকতেন। তখন তাঁর বাড়িতে রোগীদের ভিড় পড়ে যেতো। আত্মীয়দের দেখাদেখি দূরের লোকজনও আসতো। সবাইকে তিনি বিনে পয়সাতেই দেখতেন। সে সময় চাঁদপুরে নামী চিকিৎসক ডাঃ নুরুর রহমান, ডাঃ আমিন আহমেদ এ জাতীয় চিকিৎসকরা সুকুমার দাসের সাথে দেখা করতে যেতেন। জটিল চিকিৎসা বিষয়ে স্থানীয় ডাক্তাররা তাঁর সাথে গিয়ে আলাপ করতেন। লন্ডনের প্রসিদ্ধ গাইনি চিকিৎসক ছিলেন সুকুমার দাস। ঢাকায় তাঁর কয়েকজন বন্ধু চিকিৎসক জটিল কিছু অপারেশনে তাঁর সাথে যোগাযোগ করতেন।

দশ বারো দিন পূর্বে সুভাষ-ধিভাষ তাদের মামা সুকুমার দাসের মৃত্যু সংবাদটি দিলেন। শেষ কয়েক বছর সুকুমার দাস একা জীবনযাপন করেছেন। স্ত্রী গত হয়েছিলেন কয়েক বছর পূর্বে। লন্ডনে তার ১টি ছেলে ও ১টি মেয়ে বর্তমানে সভ্য দেশের ব্যস্ত জীবন-যাপন করছেন, যাদের পরিচয় একদিন দাঁড়াবে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত হিসেবে। সুকুমার দাসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন একজন মেধাবী চিকিৎসক নিভৃতে চলে গেলো। বৃটেনবাসীর কী দায়, একজন বাঙালি, একজন জেলে সন্তানকে মনে রাখার। তাই অনেককেই বলতে শোনা যায়, ডাঃ সুকুমার দাসের জীবনের একটি বড় ভুল ছিলো নিজের দেশে ফিরে না আসা।

রফিক আহমেদ মিন্টু : প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতি কর্মী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়