প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
তৃপ্তি সাহা : একজন আদর্শ লাইব্রেরীয়ান
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে কি হূদয়ের উত্থানপতনের শব্দ শুনিতেছ। এখানে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হূদয় পাশাপাশি এক পাড়ায় বাস করিতেছে।’
মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদ্ল। কারণ, বুদ্ধির জাগরণ-ভিন্ন জাতীয় আন্দোলন হুজুগপ্রিয়তা ও ভাববিলাসিতার নামান্তর, আর পুস্তক অধ্যয়ন ব্যতীত বুদ্ধির জাগরণ অসম্ভব।’
আমরা সহজেই বুঝতে পারি আমাদের ব্যক্তিজীবনে, ছাত্রজীবনে লাইব্রেরীর গুরুত্ব কত বেশি। তাই সরকার প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরীর ব্যবস্থা করেছেন। বলা হয়, যে জাতির গ্রন্থাগার যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত।
তৃপ্তি ম্যাম চাঁদপুর সরকারি কলেজে ‘লাইব্রেরীয়ান’ পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি কখনোই ক্লাস নেননি। সরাসরি আমার শিক্ষকও নন। একজন শিক্ষক বাংলা পড়ান, তার মানে তিনি বাংলার শিক্ষক। একজন শিক্ষক ভূগোল পড়ান, মানে তিনি ভূগোলের শিক্ষক। কিন্তু লাইব্রেরীয়ান সবাইকে পড়ান। ক্লাসে না গিয়েও নিঃসন্দেহে তিনি শিক্ষকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন। একজন লাইব্রেরীয়ান চাইলেই তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন, চাইলেই সময় কাটাতে পারেন ইচ্ছেমতো। আবার চাইলে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে পরম মমতায় বই তুলে তা পড়িয়ে নিতে পারেন। নিজের ব্যক্তিত্বের মোহে আকৃষ্ট করতে পারেন শিক্ষার্থীদের। একজন শিক্ষক যেমন শিক্ষাদানের মহৎ কাজটি করেন, ঠিক তেমনই একজন লাইব্রেরীয়ানও সমান ভূমিকা পালন করেন। এবং সেটা সবচেয়ে সুন্দর উপায়ে। শিক্ষকরা যেমন শিক্ষাদানের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন, ঠিক লাইব্রেরীয়ানও বহু পন্থায় ছাত্রদের জ্ঞান পিপাসা বাড়াতে পারেন। তৃপ্তি সাহা এমনই এক জাদুকর। যিনি তাঁর কথা ও আচরণে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানপিপাসা বাড়াতে জানেন। এমনকি তিনি বইয়ের তালিকা তৈরি করে একের পর এক পড়িয়ে নিতে জানেন। ওনার সাথে আড্ডা দিতে গেলে কোনো বিভাজন নেই, উন্মুক্ত আলোচনা করা যায় বই নিয়ে। যেন তিনি নিজেই একটা লাইব্রেরী। যিনি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেন সামনে এগিয়ে যেতে, উদ্বুদ্ধ করেন জীবনে আরও ভালো কিছু করতে। খুব অধিকার নিয়েই বলেন, ‘আমি তোদের শিক্ষক হতে পারিনি তো কী হয়েছে! তোরা আমার ছেলের মতো।’
আমার মনে আছে, একদিন চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকার পাঠক ফোরামের এক প্রোগ্রামে খুব কষ্টে তিনি পাঁচ মিনিট সময় বের করেছিলেন সেখানে আমি বক্তব্য দিবো বলে। কিন্তু সেই প্রোগ্রামে আমি বক্তব্য দিতে গিয়ে থেমে যাই। এতোটা নার্ভাস হই যে, আর কিছুই বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম খুব বড় বকা খাব। ধরেই নিয়েছিলাম আর পাবলিক প্লেসে কথা বলবো না। আমার জন্যে ওনাকে অপমানিত হতে হলো। কিন্তু প্রোগ্রাম শেষে আমি ওনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করার আগেই উনি বললেন, ‘ধুর বেটা! এবার হয়নি আবার হবে। পরের বার দেখিস তুই আরো ভালো বলতে পারবি।’ তার ঠিক ছয় মাস পর চাঁদপুর কলেজ ডিবেট ফোরামে আন্তঃবর্ষ টুর্নামেন্টে আমাদের দল চ্যাম্পিয়ন ও আমি সেরা বিতার্কিক হই। ম্যামের কথাটা খুব মনে পড়ছিল যে, ‘তুই পরের বার পারবি।’ যে মানুষটা সবসময় ভালোর পক্ষেই পরামর্শ দেন। প্রায়শই বলতেন, ‘আমার লাইব্রেরীতে হাজার হাজার বই। কিছুই পড়িন এখনো, কবে পড়বি? কী করিস্ তোরা?’ এই যে বইয়ের প্রতি লোভাতুর করে তোলার প্রত্যয়, যা একজন সত্যিকারের মানুষের মধ্যেই থাকে।
বলছিলাম একজন লাইব্রেরীয়ানের দায়িত্ব শিক্ষকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তিনি গোটা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর প্রভাব ফেলতে পারেন। তাদেরকে বই পড়ার জন্যে নানামুখী উদ্যোগ নিতে পারেন। আমাদের দেশ ও জাতি গঠন করতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে। জানতে হলে প্রচুর পড়তে হবে। তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় বইয়ের মলাটের গন্ধের কী নেশা, সেটা এ যুগের ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকাংশ প্রায় ভুলতে বসেছে। পুরানো বইয়ের পাতা আন্দাজ করে গল্প পড়ার কী নেশা, সেটা অনেকেই জানে না। এসব জানাতে হলে লাইব্রেরীয়ানের দায়িত্ব অনেক। আগামীর সোনার বাংলা গড়তে এরকম অসংখ্য মানুষ আছেন যারা নিরলস শ্রম দিচ্ছেন। যারা সততার সাথে নিজের দায়িত্ব পালনে সদা তৎপর। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। স্রষ্টা তাদের সৎকর্মের উত্তম প্রতিদান দিক।