প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
স্বাগতম হিজরি নববর্ষ-১৪৪৫। ভোরের সূর্যোদয়ে বর্ষপরিক্রমায় শুরু হলো নতুন বছর। সময়ের পালাবদলে জীবনের সময়-সম্পদ থেকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দোলাচলে কালের আবর্তে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরো একটি বছর। স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু হলো নতুন বছরের। ১৪৪৫ হিজরির প্রথম সূর্যোদয় যাদের ওপর হয়েছে, বছর শেষ হতে হতে তাদের অনেকের সময় ফুরিয়ে যাবে! ১৪৪৬ হিজরির সূর্যোদয় হয়তো অনেকের দেখার সুযোগ হবে না। সত্য কী অমোঘ! ভুলে থাকা যায়, কিন্তু অতিক্রম করা যায় না। যাহোক, আজ নতুন এ বর্ষে সংক্ষেপে জেনে নেই হিজরি নববর্ষের ইতিহাস, একজন চিন্তাশীল-ভাবুক মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে।
হিজরি নববর্ষের ইতিহাস : আজ ১ মুহাররমের মধ্য দিয়ে হিজরি নববর্ষ ১৪৪৫-এর সূচনা। এলো নতুন বছর, নতুন দিন। মু’মিন- মুসলিমেরা এদিনে জিন্দেগি ও বন্দেগির নতুন পরিকল্পনা করে থাকেন। অতীতের পাপ পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র জীবন লাভের মহান ব্রতে নিমগ্ন হওয়ার শপথ গ্রহণ করে থাকেন। এ হিজরি সন মুসলিম উম্মাহর জন্যে এক বিশেষ স্মারক। কালেমায় বিশ্বাসী প্রত্যেক মুসলিমের তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি এর সাথে সম্পৃক্ত। মুসলিমদের নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, শবেক্বদর, শবেবরাত, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহাসহ সকল ধর্মীয় বিষয়ের জন্যে হিজরি সন অপরিহার্য। আমাদের দেশে সাধারণত বাংলা, ইংরেজি ও হিজরি এ তিনটি বর্ষের প্রচলন রয়েছে। কিন্তু জীবনের প্রাসঙ্গিকতায় ইংরেজি ও বাংলা সনের বিদায় ও বরণকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, হিজরি সনের বেলায় তা মোটেও লক্ষ্য করা যায় না। অথচ হিজরি নববর্ষকে গুরুত্ব সহকারে পালন করাই মুসলিম অধ্যুষিত এ জনপদের একান্ত কাম্য।
হিজরি সনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্মরণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে ও তার পূর্বে রোমান, পারসিয়ান ও অন্যান্য জাতির মধ্যে তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা প্রচলিত ছিল। আরবদের মধ্যে কোনো নির্ধারিত বর্ষ গণনা পদ্ধতি ছিল না। বিভিন্ন ঘটনার ওপর নির্ভর করে তারিখ বলা হতো। খলিফা হযরত উমর (রাঃ)-এর শাসনামলে খিলাফতের তৃতীয় বা চতুর্থ বছর ইরাক ও কুফার গভর্নর হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) তাঁকে পত্র লিখে জানান যে, আপনার সরকারি ফরমানগুলোতে সন-তারিখ না থাকায় প্রশাসনিক কাজে জটিলতা দেখা দেয়, এজন্যে একটি বর্ষপঞ্জি ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজন। তখন হযরত উমর (রাঃ) সাহাবীগণের নিকট পরামর্শ চান। কেউ কেউ রোম ও পারস্যের পঞ্জিকা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। কিন্তু অন্য সাহাবাগণ তা অপছন্দ করেন এবং মুসলিমদের জন্যে নিজস্ব পঞ্জিকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
এ বিষয়ে কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীলাদ বা জন্ম থেকে সাল গণনা শুরুর কথা বলেন। কেউ কেউ তাঁর নবুওয়াত থেকে, কেউ কেউ তাঁর হিজরত থেকে আবার কেউ কেউ তাঁর ওফাত থেকে সাল গণনার পরামর্শ দেন। হযরত আলী (রাঃ) হিজরত থেকে সাল গণনার পক্ষে জোরালো পরামর্শ দেন। তখন খলিফা হযরত উমর (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর মত সমর্থন করে বলেন যে, হিজরতই হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যের সূচনা করে। এজন্যে আমাদের হিজরত থেকেই সাল গণনা শুরু করা উচিত। অবশেষে সাহাবীগণ হিজরত থেকেই সাল গণনা এবং মুহাররম মাসকে হিজরি সালের প্রথম মাস হিসেবে ধরার বিষয়ে একমত পোষণ করেন । এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নবীজীর হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে।
একজন মুসলিমের জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে বিধান ও গণনা হিসেবে মাস হলো বারোটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে, এদের মধ্যে চারটি সম্মানিত; এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সূরা তাওবা-৩৬) সম্মানিত চারটি মাস হলো- জুলকাদ, জুলহাজ্জ, মুহাররাম ও রজব। এগুলো ‘হারাম’ অর্থাৎ ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘সম্মানিত’ মাস বলে পরিচিত। এ সকল মাসে সকল প্রকার পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত থাকতে ও অনেক নেক আমল করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে কুরআন ও হাদীসে। এ চার মাসের মধ্যে মুহাররাম মাসকে বিশেষভাবে মর্যাদা প্রদান করে একে ‘শাহরুল্লাহা বা আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর এ মুহাররাম হিজরি সনের প্রথম মাস। এ মাস আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরত ও দাওয়াতী জিন্দেগী শুরু ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা। এ মাসেই রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আশুরা’-দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের পর যেদিন আল্লাহর নবী হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর উম্মতদের বিজয় হয়েছিল। সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে এ মাসের দশ তারিখ ঐতিহাসিক কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রাঃ) সপরিবারে শাহাদাতের নজরানা পেশ করার কথা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এমাসে ফজিলতপূর্ণ অনেক আমলের অন্যতম হলো নফল রোজা রাখা। বিশেষ করে ‘আশুরা’ বা মুহাররমের দশ তারিখ নফল রোজা রাখায় অনেক ফজিলত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস যে, আশুরার রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’ (তিরমিযি)
যাইহোক ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে আজ আমরা উপনীত হিজরি ১৪৪৫ সালে। বিদায়ী বছরের হতাশা ও বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে ভালো কিছু প্রাপ্তির প্রত্যয় নিয়ে আমরা বরণ করে নেব নতুন এ বছরকে।
নতুন বছরে ভাবুক মনের অতীত মূল্যায়ন ও আগামীর সংকল্প : সময়ের পালাবদলে পুরানো একটি বছরকে বিদায় জানিয়ে আগমন করেছে নতুন আরেকটি বছর। নতুন বছর ঘিরে নানা জনের নানা ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে একজন চিন্তাশীল ভাবুক মানুষের ভাবনা হলো-- চলে যাওয়া বছরটি শুধু একাই যায়নি, সাথে করে নিয়ে গেছে অনেক কিছুই। যা আর কখনো এ পৃথিবীর আলো-বাতাসে ফিরে আসবে না। ১৪৪৪ হিজরির প্রথম সূর্যোদয় যাদের উপর হয়েছে, তাদের অনেকেই আজকের সূর্যোদয় উপভোগের সুযোগ পায়নি । আবার আজকের সূর্যোদয় উপভোগকারী অনেকেই হয়তো আগামীর সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পাবে না। তাই রাত-দিনের গমনাগমন, সকাল-দুপুর-বিকেলের পরিবর্তন, সপ্তাহ-মাস-বছরের এই চক্রাকার আবর্তন-এসব কিছুই একজন মানুষকে বারবার বলে যাচ্ছে তার বেলা ফুরোবার কথা। আমাদের দেহ-মনের পরিবর্তন, আমাদের প্রিয়জনদের চলে যাওয়াও আমাদেরকে বার্তা দিচ্ছে নিজেদের বেলা ফুরোবার কথা।
তাই একটি বছরের উপসংহারে দাঁড়িয়ে একজন চিন্তাশীল ভাবুক মু’মিনের মানসপটে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, একটি বছর তো আমি শেষ করেছি; কিন্তু যে মহান উদ্দেশ্যে আল্লাহতা’আলা আমাকে এ পৃথিবীতে পাঠালেন, যেমনটি তিনি কুরআনে বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যেই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার-ই ইবাদত করবে।’ (সূরা জারিয়াত-৫৬) সে পথে আমি কতটুকু অগ্রসর হয়েছি? জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য জান্নাতের দিকে কতটা এগিয়ে যেতে পেরেছি? এর জন্যে কতটুকু পাথেয় সংগ্রহ করেছি? নাকি এখনো উদাসীনতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি? এজন্যে একজন ভাবুক মু’মিনের নতুন বছর আগমনের এ মুহূর্তটি উৎসবের নয়, ভাবনা ও হিসাব মেলানোর সময়। সময়-সম্পদের যে অংশ ব্যয় হয়ে গেল তা কি প্রয়োজনীয় ও লাভজনক ক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছে, না অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর খাতে? জীবনের মূলধন (সময়) খরচ করে জীবনকে আমরা কতটুকু সমৃদ্ধ করেছি?
বস্তুত একটি বছরের বিদায় ও আগমনে প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য হলো, নিজের অতীত জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা তথা আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনার মাধ্যমে জীবনের হিসাব-নিকাশ পর্যালোচনা করা। জীবনের হালখাতা করা। যে নির্দেশ আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক যে, সে আগামীকালের (পরকালের) জন্যে কী সঞ্চয় করলো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ অবহিত। (সূরা হাশর-১৮) তাই দিবস ও রাত্রির আগমন ও নির্গমনে জীবনের হিসাব মিলানোই প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বিচক্ষণ ওই ব্যক্তি যে নিজের হিসাব গ্রহণ করে এবং মৃত্যুর পরের জন্য কর্মব্যস্ত থাকে। আর অক্ষম ওই ব্যক্তি, যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে আর আল্লাহর নিকট অমূলক বাসনা পোষণ করে।’ হযরত ওমর (রাঃ) একবার মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দানের সময় শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, হে বিবেকবান মানুষ! আমি তোমাদের বিবেককে বলতে চাই--‘হিসাব চাওয়ার পূর্বেই নিজের হিসাব করে নাও, তোমার কাজ পরিমাপ করার পূর্বেই নিজেই নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও।’ (সুনানে তিরমিযি)
তাই একটি বছরের বিদায় ও আরেকটি নতুন বছরের আগমনের মধ্যে মু’মিনের জন্যে রয়েছে চিন্তার খোরাক। মু’মিন ভাববে, এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একদিন নিভে যাবে আমার জীবনপ্রদীপ। আমি যদি সময় নামক সবচেয়ে দামি, মূল্যবান ও সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদকে উদাসীনতায়, মনোবৃত্তিপূরণ বা মিথ্যা কামনায় কেটে ফেলি, তাহলে আমি হবো ক্ষতিগ্রস্ততায় নিমজ্জিত। এজন্যে নতুন বছরে একজন মু’মিনের কর্তব্য হলো গত বছরের ভুলত্রুটি সংশোধন করে, সেগুলোর জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন বছরে নির্ভুল ও পাপমুক্ত জীবনযাপনের জন্যে প্রত্যয়ী হওয়া, মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া, তাঁর দিকে সমর্পিত হওয়া এবং তাকওয়ার নতুন লেবাসে নিজেকে সুসজ্জিত করা। আসুন নতুন বছরের জন্যে জীবনকে নতুন করে সাজাই। হৃদয়ের বাগানে যত পাপ-পঙ্কিলতা, হিংসা, অহঙ্কার, স্বার্থপরতা, লোভ ইত্যাদির যে আগাছা জন্মেছে তা বিদায় দিয়ে হৃদয়ের বাগানকে পরিষ্কার করি। একমাত্র আল্লাহর কাছেই আত্মসমর্পণ করি, আল্লাহর ভালোবাসা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা, সকল মু’মিনের ভালোবাসা, সকল মানুষের ভালোবাসা এবং সকল সৃষ্টির ভালোবাসা দিয়ে হৃদয়কে সুশোভিত করি। শহীদ হাসান আল-বান্না (রহ.)-এর দৃষ্টিতে নতুন বছর ও আগামীর সংকল্প এরূপই-- ‘নতুন বছরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে বললাম, সামনের অদেখা-অস্পষ্ট দিনগুলোকে আলেকিত করার জন্যে আমার বাতির প্রয়োজন। সে উত্তর দিল, তোমার হাতটি আল্লাহর কুদরতি হাতে সঁপে দাও, তিনিই তোমাকে পরম গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন।’
নূর মোহাম্মদ : প্রভাষক-ইসলাম শিক্ষা, বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।