বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩, ০০:০০

মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ
মোঃ আকাশ হোসেন

বিশ্ব অর্থনীতি মোটেই ভালো যাচ্ছে না। করোনার ধাক্কা না সামলাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাদুর্ভাব। যা বিশ্ব অর্থনীতিকে টালমাটাল করে দিয়েছে। দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। শাস্ত্রমতে, নির্দিষ্ট একটি সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়াকেই মূল্যস্ফীতি বলে। বলা হয়, ১৯২৯ সালের মহামন্দার পর অর্থনীতিতে এতো বড় আঘাত আসেনি। অনুন্নত দেশের পাশাপাশি উন্নত দেশেও দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পায়নি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মূল্যস্ফীতি লাগামহীনভাবে বেড়েই যাচ্ছে। যা নিয়ন্ত্রণ করা বিশ্ব অর্থনীতির জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমেই সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দামও এখন আকাশচুম্বী। যা সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। প্রতিনিয়তই সাধারণ মানুষকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ। এই অভিশপ্ত মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বিশ্ব অর্থনীতির হাল আরো খারাপ ও ভয়াবহ হয়ে পড়বে। একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি হলো অর্থনীতি। অতএব, মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে যে কোনো দেশকেই অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হবে। এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই এই মূল্যস্ফীতির বেগ সামলাতে হচ্ছে।

বিশ্বের ধনী দেশগুলোর ক্লাব ওইডিসির মতে, বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগস্টে ইউরোপ অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি গড়ে ১০ শতাংশ। তুরস্কের মূল্যস্ফীতি ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ, যা এখন অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। যা ২৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারের দাম অধিক বৃদ্ধির কারণে ইউরোপ অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি হু হু করে বেড়েই যাচ্ছে। রাশিয়া ইউরোপ অঞ্চলে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সার রপ্তানি বন্ধ করায় দেশগুলো প্রতিনিয়তই অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। অথচ সুযোগ কাজে লাগাতে ওপেকভুক্ত দেশগুলো চাহিদামতো তেল উৎপাদন বাড়াচ্ছে না। ইকুয়েডর, কাজাখস্তান ও লিবিয়ার মতো দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তেলের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো লাভবান হলেও ভোক্তা দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তেলের দরে লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র-চীনসহ শীর্ষ ভোক্তা দেশগুলো গত বছরের শেষ দিকে মজুত থেকে জ্বালানি তেল বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এতোকিছুর পরেও নানা কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নতুন বছরে এ পর্যন্ত অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দর ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৪০ ডলার, যা ২০২২ সালের শুরুতে ৯০ ডলারে পৌঁছায়। ইউক্রেনে রুশ সামরিক তৎপরতার পর এই দাম ১১৮ ডলার ছুঁয়েছে।

গত বছরের ১৬ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মূল্যস্ফীতি হ্রাস আইনে স্বাক্ষর করেছে। সেদিন থেকেই আইনটি কার্যকর হওয়া শুরু করেছে। এতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষরা মূল্যস্ফীতি থেকে এতোটুকু হলেও রেহাই পাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। আমেরিকার দেখানো পথকে অনুসরণ করে যুক্তরাজ্যও জ্বালানি তেলের ব্যয় হ্রাস করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, দিচ্ছে ভর্তুকি। লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল, উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, সাব-সাহারা আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপসহ বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ২০২৩ সালে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চাপকে আরো দীর্ঘায়িত করবে। এমনিতে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান অবমূল্যায়নের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। তার ওপর অভ্যন্তরীণ বাজারে চরম মুনাফাকামী গোষ্ঠীর অধিক মুনাফার প্রবণতা মূল্যস্ফীতির চাপকে আরো তীব্রতর করছে। বহু নিত্যপণ্যের দাম বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। এ দাম গত কয়েক বছরের গড় মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এ অবস্থায় যদি আবারো খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্যনিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এ জন্যে সরবরাহ ব্যবস্থা, বিতরণ, আয় বাড়ানোসহ বিভিন্ন খাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বিশ্ব অর্থনীতির এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নির্ভর করে ডলারের মানের ওপর। দ্য ইউএস ডলার ইনডেক্স মোতাবেক, গত ২০ বছরের মধ্যে মার্কিন ডলার এখন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। ডলার শক্তিশালী হওয়ার কারণটি হলো, আমদানির বিপরীতে ডলারের ওপর অতিরিক্ত চাপ, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানোর কারণে ডলারের দাম বেড়ে গিয়েছে। ফলে গোটা এশিয়ার স্থানীয় মূল্য এখন দুর্বল। চীন, জাপান, পাকিস্তান ও ভারতের মুদ্রারও পতন হয়েছে।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির প্রভাব অনেক আগ থেকেই দেখা দিয়েছে। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের এমন কোনো পণ্য নেই যার মূল্য বিগত দিনে বাড়েনি। শুধু জ্বালানি তেল, ডিজেল, অকটেন নয়, চাল, ডাল, সবজিসহ সকল খাদ্যসামগ্রীর দাম প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে। প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশের খাদ্যসামগ্রীর দাম ৩শতাংশ হারে বেড়ে যাচ্ছে। তবে আশেপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক কম। মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকলে দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে থাকা মানুষের একটি অংশ গরিব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের গরিবরা অসহায়ত্বের শিকার হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে সরকার গরিবদেরকে নগদ অর্থ, ভাতা ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা স্থায়ী সমাধান নয়। এই অভিশপ্ত মূল্যস্ফীতিকে স্থায়ী সমাধান দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখাই আগামী বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির হারের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হবে। কারণ, সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া নিয়ে বেশি মাত্রায় উদ্বিগ্ন। এছাড়া অধিক মাত্রার মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য ও বৈষম্য বৃদ্ধি করবে। তাই ভারসাম্য রক্ষার সময় আগামীতে মূল্যস্ফীতিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কখন বন্ধ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না। তার জন্যে বাংলাদেশকে বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। তবে বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় কাজটি যে সহজ হবে না, তা বলাবাহুল্য। একই সঙ্গে অবৈধ মজুতদারেরা যেন যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়ে আমদানি করা খাদ্যশস্যের দাম বাড়াতে না পারে, সে জন্যে তৎপর হতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে। মনে রাখতে হবে, যে কারণে পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া, তার জন্যে অনেকটা দায়ী জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। বাস্তবতা হলো, বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম কিছুটা বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে পণ্যটির ওপর আরোপিত প্রায় ৩৪ শতাংশ কর কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহে অনিয়ম, অবৈধ মজুদণ্ডদুর্নীতি ও অপচয় কমিয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার দিকেও মন দেয়া উচিত।

মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে সরকারকে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেগুলো হলো--১. আমদানি ক্ষেত্রে ডলারের চাপ কমানো; ২. বাজেট অর্থায়নে রাজস্ব বৃদ্ধি করা; ৩. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা; ৪. প্রকল্প নির্মাণে বৈদেশিক ঋণ না নেওয়া; ৫. বিদেশে অর্থপাচার বন্ধ করা; ৬.বাধ্যতামূলক সঞ্চয় চালু করা, ৭. সরকারিভাবে দ্রব্যমূল্যের সীমানা বেঁধে দেওয়া; ৮. কম চাহিদাসম্পন্ন দ্রব্যের তুলনায় বেশি চাহিদাসম্পন্ন দ্রব্যের উৎপাদনে উৎসাহিত করা; ৯. আমদানিনির্ভরতা কমানো ও দেশজ পণ্যের ব্যবহার বাড়ানো; ১০. বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা; ১০. ব্যাংক খাতের ঋণের সুদহারের নির্ধারিত সীমা তুলে দেওয়া ইত্যাদি।

এসব নীতি ও উদ্যোগ যদি সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ অচিরেই মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে এবং গণমানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা যে অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না করতে পারলে মহাবিপদ অনিবার্য! কারণ, মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

মূল্যস্ফীতি সরকার ও অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জকে যদি মোকাবিলা না করা যায়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে টানাহেঁচড়া শুরু হবে, সংকট ও অসহায়ত্বের শিকার হবে সাধারণ মানুষ। বর্তমান সময়ের উচ্চ মূল্যস্ফীতি সারা বিশ্ব অর্থনীতিতে চরমভাবে চাপ সৃষ্টি করেছে। এই দুরূহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়াটাই বর্তমান বিশ্বের মূল লক্ষ্য। মূল্যস্ফীতি রোধে গবেষণামূলক সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা কাজে লাগানোর জন্যে সরকার ও তার সংশ্লিষ্টদেরকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। তাই বলবো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করুন, আর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করুন। এটাই জাতির বর্তমান সময়ের স্লোগান হওয়া প্রয়োজন। লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম; শিক্ষার্থী, হাজীগঞ্জ মডেল সরকারি কলেজ, মানবিক বিভাগ, ০১৬৬৯০৩৯৫৬৪।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়