প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৩, ০০:০০
প্রত্যেক মানুষ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কল্যাণে তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কাজ করে। উৎপাদন, সম্পদ আহরণ, সুযোগ সৃষ্টি করে সমাজের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে। দীর্ঘদিন কাজ করার পর ব্যক্তির জীবনে অবসরগ্রহণের সময় আসে।
অবসরগ্রহণের প্রকারভেদ আছে। যেমন : বাধ্যতামূলক অবসর, শাস্তিমূলক অবসর, স্বেচ্ছায় অবসর, অক্ষমতাজনিত অবসর।
বাধ্যতামূলক অবসর হলো, একটা নির্দিষ্ট বয়সে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অবশ্যই অবসরগ্রহণ করা। যেমন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৯ বছর, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর, উচ্চ আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে ৬৭ বছর।
শাস্তিমূলক অবসর হলো, ঘুষ, দুর্নীতি, অসদাচরণ, অদক্ষতা এবং ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হলে। স্বেচ্ছামূলক অবসর হলো শারীরিক বা মানসিক কারণে যখন কোনো ব্যক্তি কর্ম সম্পাদনে অযোগ্য বিবেচিত হয়। স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ হলো নির্দিষ্ট বয়সের আগে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজেকে কাজ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া। যে কারণেই হোক না কেন, সবাইকে কাজ থেকে অবসরগ্রহণ করতে হয়। অবসরগ্রহণ ব্যক্তির জীবনে, পরিবারে, সমাজে ভিন্ন মাত্রার প্রভাব বিস্তার করে। জন্ম, বিয়ে, ডিগ্রি, পদক, পুরস্কার, পদোন্নতি ব্যক্তির জীবনে আনন্দ স্মৃতি তৈরি করে। অবসর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কষ্টের, বেদনার হয়ে থাকে, বিশেষ করে অল্প আয়ের লোকজনের ক্ষেত্রে।
আমাদের দেশে অবসরগ্রহণ করার পূর্বে কেউই অবসরগ্রহণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে না এবং সে ধরনের কোনো ব্যবস্থাও নেই। এখন সময় এসেছে অবসরগ্রহণের পূর্বে ব্যক্তিকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন এবং দক্ষ করে গড়ে তোলা, যাতে করে অবসরগ্রহণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলোকে সহজেই মোকাবিলা করতে পারে। অবসরগ্রহণের দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে ততই ব্যক্তি আশা-নিরাশার দোলাচালে দুলতে থাকেন। কেউ কেউ ভাবতে থাকেন, খবরদারি নেই, দায়িত্ব কর্তব্য পালনের বেড়াজাল থেকে মুক্তি। ছুটি আর ছুটি, ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়াতে পারবে, নিজের মতো করে সময় কাটানো যাবে।
প্রাক অবসর প্রশিক্ষণে ১০টি বিষয়কে বিবেচনা করতে প্রস্তাব করছি। দশটি বিষয় হলো : শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, আবাসন, আয়-রোজগার, সামাজিক কর্ম, নিঃসঙ্গতা, নিরাপত্তা, বৈধব্য ও অন্তিমকাল।
১. শারীরিক : বার্ধক্যে প্রায়ই সন্ধি প্রদাহ এবং বাত-বেদনা দেখা দেয়। হাঁটু, কোমর, পিঠে ব্যথায় চলাচল সীমিত হয়ে যায়। কারো দাঁত পড়ে যায়। ফলে খাবার চিবিয়ে খেতে পারেন না, কথা বলতে সমস্যা হয়। মাথার চুল পাতলা হয়ে যায়, গায়ের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। বার্ধক্যে ত্বকের তৈলাক্ত ভাব হ্রাস পায়, ত্বক শুকিয়ে যায়। এজন্যে চুলকানি হতে পারে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হৃদপি-ের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। চর্বি -কোলেস্টেরল ধমনীতে জমে রক্ত চলাচল বিঘিœত করতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা থাকে। বয়োবৃদ্ধির ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য, পায়খানা, প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার সমস্যা দেখা দেয়। চোখের দৃষ্টি ক্ষমতা হ্রাস, কানে কম শোনা, ঘ্রাণ শক্তি কমে যাওয়া এবং খাবারে স্বাদ না পাবার মতো সমস্যা দেখা দেয়। বয়সের সাথে ডায়াবেটিস, ক্যানসার হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
২. মানসিক : বার্ধক্যে যে সকল মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা আছে সেগুলো হলো বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া, নিদ্রাহীনতা প্যারানয়া, আলঝাইমার্স, ডিমেনশিয়া, পারকিনসন্স রোগ। দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা, প্রিয়জনের মৃত্যু, বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি, শারীরিক সীমাবদ্ধতা, চাকরিচ্যুতি, অপরাধবোধ, রাগ-ক্ষোভ, একাকিত্ব, ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা, নৈরাশ্যবোধ থেকে বিষণ্নতা তৈরি হতে পারে। তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে।
প্যারানয়া আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে নিপীড়িত, নির্যাতিত, মজলুম, অবহেলিত, বঞ্চিত মনে করেন। তিনি মনে করেন তার চলাফেরা, কাজকর্ম, গতিবিধির ওপর কেউ গোয়েন্দাগিরি করছে।
দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি হ্রাস পেলে আশপাশের লোকজনের সাথে যোগাযোগ কমে যায়। ফলে ব্যক্তির মধ্যে সন্দেহ প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
আলঝাইমার্স হলো স্মৃতি ক্ষয়জনিত এক ধরনের রোগ, যাতে ব্যক্তি সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা মনে করতে পারে না। বিচার-বিবেচনা বোধ হ্রাস পায়, ব্যক্তিত্বের অবনতি ঘটে।
পারকিনসন্স দীর্ঘ মেয়াদী স্নায়ুর রোগ, যাতে করে ব্যক্তির হাত-পা কাঁপে, মাংসপেশী অনমনীয় হয়ে আসে, চলাফেরায় ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না।
৩. আর্থিক বিষয় : জমানো টাকা, পেনশন, জমিজমা, বীমা, ব্যাংক, বয়স্ক ভাতা, সঞ্চয়পত্র, সম্পত্তি হস্তান্তর, উইল, হেবা, পাওয়ার অব এটর্নি। অনেকের এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
৪. আবাসন : নতুন বাড়ি ঘর নির্মাণ, পুরাতন বাড়ি ঘর সংস্কার, বাড়ি ঘর বর্ধিত করা, বন্ধক রাখা, জমি কেনা, জমি বিক্রি ইত্যাদি।
৫. আয়-রোজগার : অবসর গ্রহণের পর জীবন ধারণের জন্য নতুন কাজে যুক্ত হওয়া, ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করা, অন্যের ব্যবসায় টাকা খাটানো, অর্থ বিনিয়োগ, শেয়ার কেনা, সুদে টাকা খাটানো ইত্যাদি।
৬. সামাজিক বিষয় : ব্যক্তির সামাজিক কর্মকাণ্ডে অধিক অংশগ্রহণ ব্যক্তির সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সামাজিক মেলা মেশা বৃদ্ধি পেলে মানসিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। সামাজিক কর্মকাণ্ড ব্যক্তিকে সক্রিয় রাখে।
৭. নিঃসঙ্গতা : বার্ধক্যে নিঃসঙ্গতা অনিবার্য হয়ে উঠে। যৌথ পরিবারের যুগ শেষ হয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীকেন্দ্রিক নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে পিতামাতা নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। যাদের সামাজিক অবস্থান অনেক উঁচুতে, তাদের পক্ষে সাধারণ স্তরের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা কিছুটা কঠিন। অবিবাহিত, বিধবা, বিপতিœক, নিঃসন্তান প্রবীণের নিঃসঙ্গতা কাটাতে কার্যক্রম গ্রহণ।
৮. নিরাপত্তা : প্রবীণ বয়সে নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হয়। কর্মচারী, গৃহকর্মী, সহকর্মী, দারোয়ান, ড্রাইভার, নিকটতম আত্মীয় স্বজনরা স্বার্থ হাসিলের জন্যে প্রবীণ ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারে। কিছু সংখ্যক প্রবীণ নিজে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হন। সেজন্যে হাট বাজার, রাস্তা ঘাট, গ্রাম গঞ্জে অসতর্ক চলাফেরার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সাহায্যকারী গ্রহণ করতে হবে নিরাপত্তা জোরদার করতে।
৯. বৈধব্য : বর্তমানে বৈধব্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। যার স্বামী মারা যায় তিনি বিধবা আর যার স্ত্রী মারা যায় তিনি বিপত্নীক। আমাদের আর্থসামাজিক কারণে দাম্পত্য জীবনে পুরুষের চাইতে নারীর বয়স সাধারণত কম থাকে। ফলে পুরুষ আগে মারা যান। বিধবা নারীকে নানান রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। পুরুষের স্ত্রী বিয়োগ হলে পুনঃবিবাহের সুযোগ থাকে। বিধবা নারীর সেই সুযোগ নেই বললেই চলে। বৈধব্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বিয়ে কোনো সমাধান কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক আছে।
১০. অন্তিমকাল : প্রবীণ যখন ঘরবন্দী জীবনে আটকে পড়ে, অদূর ভবিষ্যতে ঘরের বাইরে বেরুনোর সম্ভাবনা কমতে থাকে, তখন ব্যক্তিকে পরিবারের কল্যাণে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দৈনন্দিন কাজ কর্ম সম্পাদনে সেবা কর্মীর সহযোগিতা অনিবার্য হয়ে পড়ে। পরিবারের পক্ষে সার্বক্ষণিক সেবা-যত্ন, দেখাশোনা করা কঠিন হয়ে যায়। চিকিৎসার ব্যয় বহন করার প্রশ্ন সামনে আসে।
উপরে বর্ণিত ১০টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি বার্ধক্যের নানান রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। এতে ব্যক্তি শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। অনেকেই শরীরে রোগ-ব্যাধিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেন না। কিংবা চিকিৎসা গ্রহণে পরিবারের সমর্থন পান না। ফলে রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে।
দীর্ঘ মেয়াদী ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে হয় কিংবা মৃত্যুবরণ করতে হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর না দিলে জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেয়। জমি জমা, সহায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা, হস্তান্তর, হেবা, উইল করার ক্ষেত্রে আবেগিক সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে পরবর্তী কালে নানা রকমের জটিলতা প্রবীণ জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। নিঃসঙ্গতা মোকাবিলা করতে না পারার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। জীবনকে অর্থবহ করার জন্যে যে সকল বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে সেসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা লাভ করা জরুরি।
প্রবীণ জীবনকে স্বস্তিদায়ক, শান্তিপূর্ণ, অর্থবহ, কর্মক্ষম রাখতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ খুবই জরুরি একটি বিষয়।
হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ক লেখক ও গবেষক।