প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
আগামী বছর বিশ্বে দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক মন্দা আরও ব্যাপকভাবে দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ইতোমধ্যে সারা বিশ্বে ব্যাপক আকারে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। বাহ্যত মনে হচ্ছে দুর্ভিক্ষকে আমরা হাতছানি দিয়ে আহ্বান করছি। একটা বিশেষ শ্রেণি ছাড়া বিশ্বের একটা বড় অংশ দিনদিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বিশাল এ পৃথিবীর কোথাও কোনো প্রাণী খাবারের কষ্ট পেলে তা মানুষের কারণেই পেয়ে থাকে। কখনো মানুষের সীমা লঙ্ঘনের কারণে চেপে বসা দুর্ভিক্ষ জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে। কেউ কেউ বিশ্ব অর্থনীতিতে আকস্মিক ধস নামার কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে তুলে ধরছেন। সম্ভাব্য বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য সংকট থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার পাশাপাশি প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের দেশে বর্তমানে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে যে, যার আছে সে ইচ্ছামতো অপচয় করছে আর যার নেই সে কোনোভাবে দুমুঠো খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে।
বর্তমান বিশ্বের যে অবস্থা আমরা কেউ বলতে পারি না সামনে কী হতে যাচ্ছে। সর্বত্রই যেন হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। তাই কঠিন পরিস্থিতির আগেই আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত খাবার অপচয়ের অপ্রীতিকর চিত্র চোখে পড়ছে। বিয়ের অনুষ্ঠান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পার্টি সেন্টার, ছাত্রাবাস, সাধারণ বাড়ি-ঘরসহ এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে খাবার নষ্ট হচ্ছে না। ডাস্টবিনগুলোর একটা বিশেষ অংশ পূর্ণ হচ্ছে নষ্ট-পচা খাবার দিয়ে। খাদ্য অপচয়ের এমন অসুস্থ প্রবণতা আমাদের জন্য অশনিবার্তা বহন করছে। কেননা অপচয়কারীদের সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং অপছন্দ করেন। বর্তমানে বিয়েতে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় হয়। এরপরই রয়েছে রেস্টুরেন্ট। সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা অনেকেই চোখের ক্ষুধা মেটাতে অতিরিক্ত খাবার প্লেটে নিই। কিন্তু খেতে পারি না। পাশে বসা ছোট বাচ্চার প্লেটেও স্তূপ করে খাবার তুলে দিই। সমাজের মানুষের কাছে ক্রমেই তা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনে সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট তীব্র হবে। সেই অবস্থা এখন কোনো কোনো দেশে দৃশ্যমান হচ্ছে। দিনে দিনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ হতে পারে। সামনে কঠিন সময় ও মন্দা আসছে। বৈশ্বিক মন্দার পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব এখন দৃশ্যমান। ইউনেপের ওই ইনডেক্স অনুযায়ী একজন বাংলাদেশি বছরে ৬৫ কেজি খাদ্য উৎপাদন কিংবা তৈরি খাদ্য নষ্ট করে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য অপচয় হয় বাংলাদেশে। অপচয়ের ফলে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে নেতিবাচক প্রভাব কেবল পরিবেশ ধ্বংসের মধ্যে সীমিত থাকছে না, বরং আমরা যত বেশি খাবার নষ্ট করছি, বিশ্বে খাবারের দাম বৃদ্ধির জন্য আমরা ততটাই প্রভাবক হিসেবে কাজ করছি। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অসংখ্য মানুষের কাছে খাবার কেনার মতো অর্থই নেই। আর এভাবে বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কার শিশুরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায় বলে সম্প্রতি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়েছে। খাবারের অপচয় মানে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার থেকে বঞ্চিত করা। আর ক্ষুধার্তকে বঞ্চিত করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। খাদ্য অপচয় রোধ করতে সব সময় কতটুকু খাদ্য প্রয়োজন আমাদের ততটুকুই প্রস্তুত করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য নষ্ট না করে অসহায়-গরিবদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা যেতে পারে। যারা নির্দিষ্ট এলাকার অতিরিক্ত খাদ্যগুলো সংগ্রহ করে অসহায়-গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেবে। বিয়ে বাড়ি কিংবা পার্টি সেন্টারেও অতিথি বা কাস্টমারকে এক্সট্রা প্লেট দিলে তার চাহিদা অনুযায়ী খেয়ে বাকিটা রেখে দিতে পারবে। পরিশেষে খাদ্য অপচয় রোধ করতে প্রয়োজন মানুষের সঠিক বিবেক ও সচেতনতা। শুধু বাংলাদেশ না, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, নিত্য পণ্যের দাম বাড়ছে, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং জ্বালানিসহ প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে উন্নত দেশগুলোও এখন হিমশিম খাচ্ছে। আসন্ন দুর্ভিক্ষে খাদ্য অপচয় রোধ করতে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, চাঁদপুর সদর। ০১৮৩০৮৮৫০০০