প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
ভাল্লাগে না। এতোসব দুঃসংবাদ দেখে-শুনে ভালো লাগার কথাও না। গল্পগুলো অনেক কষ্টের; তবে নিত্য দিনের। গল্প বলছি এ কারণে, প্রতিনিয়ত গল্পের মতো করেই ঘটছে এসব। গত ১৬ আগস্টের পত্রপত্রিকায় দেখলাম, বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে দেশে। যার সবক’টির বিস্তারিত উল্লেখ করলে এ কলাম লিখে শেষ করা যাবে না। মানুষের জীবন নিয়ে কেন এই হেলাফেলা? কে নেবে এর দায়? কোনো
নিরাপত্তা নেই কোথাও। কার ভালো লাগবে এসব? এসব দেখে আমার লেখা পলাশ লোহের গাওয়া 'ভাল্লাগে না' গানটি মনে পড়ছে আজ। দেশের মানুষ কতটা অনিরাপদ হলে খোদ এয়ারপোর্ট সড়কের উত্তরায় চলন্ত গাড়ির
ওপর উড়াল সেতুর গার্ডারে মানুষ চাপা পড়ে ৫ জন মানুষ মরে; পুরান ঢাকার সেই পুরানো কাহিনী প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লেগে ঘুমন্ত ৬ শ্রমিক অঙ্গার হয় ; সম্পত্তি ও টাকা-পয়সা নিয়ে দ্বন্দ্বে চট্টগ্রামে ছেলে মাইনুল তার মা জেসমিন আক্তারকে (৫০) গুলি করে হত্যা করে ; যাত্রবাড়িতে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ নেতা খুন হয়। সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন আরও অনেক অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এদিকে পণ্য মূলের আকাশ ছোঁয়া ঊর্ধ্বগতি দেখে নকুল কুমারকে বাজারে বাজারে ঘুরে 'আগুন আগুন' বলে চিৎকার করে গাইতে হয়েছে। ডিমের হালি তাও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। চাল, তেল, তরকারির দাম আকাশ ছোঁয়ার পরও আমরা বেহেস্তে আছি এমন গল্প শোনান আমাদের রাষ্ট্রের মন্ত্রী। নিত্য পণ্যের মূল্য চড়া এদেশে, মানুষের মূল্য একদম নেই। মানুষের মূল্য নেই, তাই পথে-ঘাটে মানুষ মরে। আর কতকাল এদেশের মানুষ এই দৃশ্য দেখবে--এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের কাছে করতেই হয়। বাংলাদেশ যেন অব্যবস্থাপনা আর দুর্ঘটনার স্বর্গরাজ্য। প্রতিদিনই অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায় সড়কপথে, নৌপথে কিংবা শিল্পকারখানায়, ঘরে বাইরে অথবা যে কোনো জনসমাগম স্থলে অসংখ্য মায়ের কোল খালি হচ্ছে। এটিই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে। দুর্ঘটনা এখন দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এভাবে আর চলতে পারে না, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না কিছুতে। বিয়ের পর কনের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিলেন বর-কনেসহ স্বজনরা। চলতি পথে রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার চাপায় গাড়িতেই মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। গার্ডার পড়ে এদেশে বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম শহরে ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে মানুষ হতাহতের ঘটনার ১৩ বছরেও বিচার হয়নি। চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জন প্রাণ হারায়। দীর্ঘ নয় বছর ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিচার কাজ শেষ হয়নি। তবে মামলার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)। যেন দায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কারো।
রাজধানীর উত্তরার ঘটনায় এখন দেখছি হৈ চৈ হচ্ছে বেশ। এটাতেও কারো দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মেয়র আতিকুল ইসলাম উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখার কথা বলে দায় সেরেছেন। তাঁর চোখের সামনেইতে বেষ্টনী ছাড়া দীর্ঘদিন এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে। বহু দুর্ঘটনাও ঘটছে। তিনিও কি এ দায় এড়াতে পারবেন? সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের নানা বক্তব্য শুনে মনে হয় ওনারা যেন দুধে ধোয়া। সবাই চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের
(সিজিজিসি) ওপর দায় চাপাচ্ছেন। ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি’র দায় আছে। তবে এসব যারা দেখবেন তাদের দায়টা একটু বেশি। প্রশ্ন হলো, আপনাদের চোখের সামনে চায়না প্রতিষ্ঠান মানুষের জানমাল অনিরাপদ রেখে কাজ করে কী করে? সরকার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে বুঝা যায়, এবারও সবাই অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে পার পেয়ে যাবেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চীফ ইঞ্জিনিয়ার একেএম মনির হোসেন পাঠান পত্রিকায় প্রদত্ত বক্তব্যে বলেন, সড়ক নিরাপত্তা যেকোনো কনস্ট্রাকশন কাজের অন্যতম সেফটি ইস্যু। এগুলো ছাড়া কোনো চুক্তি হয় না। চুক্তির মধ্যে আছে ঠিকাদার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ইস্যুগুলো নিশ্চিত করার পরই কেবল কাজে যেতে পারবে। সেগুলো কনফার্ম করেছে কি না সেটি যাচাই করার জন্যে কনসালটেন্ট আছে, প্রজেক্ট পার্সন আছে। দাতা সংস্থা এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক)-এর কনসালটেন্টও আছে। তারাও বিষয়গুলো মনিটর করে। তারা যাচাই করে দেখবে সেফটি মেজারমেন্টগুলো ঠিক আছে কি না, যদি সেগুলো ঠিকমত কাজ করে তাহলে সে কাজ করার অনুমতি পাবে। অন্যথায় পাবে না। প্রশ্ন হলো সংশ্লিষ্টরা এ দায়িত্ব কি পালন করেছেন? সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চীফ ইঞ্জিনিয়ার একেএম মনির হোসেন পাঠান যে এসব বললেন, তিনিও কি এ দায় কোনোভাবে এড়াতে পারেন? রাজধানীর উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের উড়ালসড়কের গার্ডারের চাপায় প্রাইভেট কারের নিহত পাঁচ আরোহী নিহত হওয়ার ভয়াবহ এ
ঘটনায় বড় মাপের এ নির্মাণ কাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকারের এ কাজে এমন দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক। এটা নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটা দুর্ঘটনা নয়, অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। সেখানে গার্ডার তুলতে যে ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে, এটাকে ‘ক্রলার ক্রেন’ বলা হয়। গার্ডার বা ভারী কোনো জিনিস তুলতে ক্রেনের ব্যবহারের সময় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এসব কাজের সময় ক্রেন উল্টে পড়া বা গার্ডার পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে যেতেই পারে। কিন্তু এর ফলে যেন প্রাণহানি না হয়, তার জন্য নিরাপত্তাবেষ্টনী অত্যাবশ্যকীয় একটি শর্ত। সেটা উত্তরায় মানা হয়নি। অনেকটা জনগণকে অনিরাপদ রেখেই দীর্ঘদিন ধরে সবার চোখের সামনে চলছে। এ দায় কেবল সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানেরই নয়, যারা এর দেখভাল করেন, যাদের দায়িত্ব রয়েছে দেখার, এরা সবাই এ ঘটনার জন্য দায়ী। এমন একটি ঘটনার জন্য খোদ রাষ্ট্রকে দায়ী করা যায়। এতো বড় একটা কাজ, যে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা মোটেও পর্যাপ্ত ছিল না। যখন কোনো ড্রেন সংস্কারের মতো কাজ হয়, সেখানেও কোনো ফিতা দিয়ে এলাকা ঘিরে রাখা হয়। দুই পাশে লোকবল রাখা হয় ব্যবস্থাপনার জন্য। আর এখানে এতো বড় ও ঝঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তাবেষ্টনী বলতে কিছু ছিলো না। বিষয়টাকে একেবারেই অবহেলা করা হয়েছে। কেন? আমরা কি জীবন নিয়ে মোটেও ভাবি? সংশ্লিষ্টদের মোটেও ভাবনা নেই। সর্বনাশ হয়ে যাবার পর ক্ষণিকের জন্য ভাবি আমরা। আহ্ উহ্ করি। তারপর একদম মুখে কুলুপ আঁটা থাকে সবার। সংশ্লিষ্টরা কাঠের চশমা পরে আছে, তাই প্রাণ যাচ্ছেতো যাচ্ছেই। পুরাণ ঢাকার অগ্নিকাণ্ডে মানুষ পুড়ে অঙ্গার হওয়ার কথা আর কতো বলবো। সেখানকার প্লাস্টিক কারখানা আর কেমিক্যাল গোডাউনের কথা কার না জানা? মাঝেমধ্যেই আগুন লেগে মানুষ মরে, তাতে কারো এসে যায় না কিছুই। সেদিনও ঘুমন্ত ছয় শ্রমিক পুড়ে মরলো। এর দায় নেবে কে? প্রতি বছর আগুনে পুড়ে মানুষ মরলেও কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সেখানে রয়ে গেছে সংশ্লিষ্টদের পয়সা দিয়ে যথাস্থানে। তাহলেতো মানুষ মরবেই। কোনোভাবেই আগুনের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলছে না পুরাণ ঢাকাবাসীর। অহরহ ঘটছে প্রাণঘাতী আগুন। এর আগে পুরাণ ঢাকার নিমতলী কিংবা চুড়িহাট্টাই নয়, পুরাণ ঢাকার অলি-গলিতে প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল থেকে লাগা অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডে পুড়েছে শত শত প্রাণ। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ৬৭ জন। এর নয়
বছর আগে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিলেন ১২৪ জন। এ দুই ঘটনার জন্যেই দায়ী করা হয় অবৈধভাবে পরিচালিত কেমিক্যালের গুদামের ব্যবসাকে। আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক কারখানা ও প্লাস্টিক গুদাম করা আইনত নিষিদ্ধ হলেও পুরাণ ঢাকার রাসায়নিক বাণিজ্য কার কব্জায়? স্বাভাবিক ভাবেই এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে। গত এক দশকে পুরাণ ঢাকায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ (১৪৯৩ জন)। তবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ২০১১ সালে, সংখ্যাটা ৩৬৫ জন। এক দশকে আগুনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ২৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৪ টাকা। তারপরেও প্লাস্টিক ও কেমিক্যালের কারখানায় চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে পুরাণ ঢাকার মানুষ। 'সুখের দেখা নাইরে, সুখের দেখা নাই...' আমার এ কলামটির কথাও মনে পড়ছে।
আমেরিকার ঠিকানা পত্রিকায় একযুগ আগে ছাপা হয়েছে আমার এ কলামটি। সেখানেও এসব দুঃখ-কষ্টের কথা লিখেছি। ওসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধ হয়নি; এখনও ঘটছে। কলামটির শুরুতে লিখেছিলাম কোথাও সুখের দেখা নাই। মৃত্যুহীন দিন পঞ্জিকা থেকে বিদায় নিয়েছে বলা চলে। সুসংবাদরা উধাও। চারদিকে কেবলই দুঃসংবাদ। ঘরে বাইরে, হাসপাতাল, বিনোদন কেন্দ্র, রাস্তাঘাট, হাজতখানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোথাও আমরা এখন আর নিরাপদ নই। ঘরে বিপদ, ঘর থেকে বাইরে গেলেও বিপদ। বিপদ যেন পিছু ছাড়তে চায় না। সাগরে নামলে নোনাজল কেড়ে নেবে প্রাণ, যানবাহনে চড়লে দুর্ঘটনা নেবে জান। এই তো হচ্ছে পরিস্থিতি। ট্রেন দুর্ঘটনায় মানুষ মরবে। বিষাক্ত খাবার খেয়ে যেতে হবে হাসপাতালে, হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলে আগুন লেগে দগ্ধ হতে হবে, নয়তো চিকিৎসকদের অবহেলায় বিনে চিকিৎসায় মারা যাবে কেউ। রাস্তায় বাস-ট্রাক, না হয় ছিনতাইকারী কেড়ে নেবে প্রাণ, নয় তো হতে হবে অপহরণ। শিক্ষাঙ্গনে সংঘাত সংঘর্ষে জীবন যাবে। তাহলে আমরা কোথায় নিরাপদ? আমরা জানি দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে। যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেওয়া আরও কঠিন। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকাল মৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারও কাম্য নয়। মৃত্যুর ধরণ যাই হোক, সরকারি খাতায় সেগুলো অপঘাত বা দুর্ঘটনা বলে চালানো হলেও এর সবই সংশ্লিষ্টদের অবহেলাজনিত মৃত্যু। কেবল তদন্ত করলেই চলবে না, জড়িতদের আইনের আওতায় এনে কঠোর দণ্ড নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতাও নিশ্চিত করতে হবে। আর কত প্রাণ ঝরে গেলে কর্তৃপক্ষ দায় বোধ করবেন জানি না। সংশ্লিষ্টদের নিদ্রা ভঙ্গ হলেই এ প্রশ্নের জবাব মিলবে। এভাবে একের পর এক দেশের মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে, আর সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন তা হতে পারে না। এ অবস্থা কিছুতেই চলতে দেওয়া যায় না।
* মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সমাজ গবেষক।