প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২২, ০০:০০
ইসলামি চিন্তাবিদগণ হজের সফরকে পরকালের সফরের সাথে তুলনা করেছেন। কালের যাত্রীকে আত্মীয়-স্বজন, ঘর-বাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-সন্তান সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। হজ পালনকারী যখন হজের সঙ্কল্প করে বের হয়, তখন পরকালের যাত্রীর ন্যায় এসব কিছু ত্যাগ করে যেতে হয়। পরকালের যাত্রীকে যেমন সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে খাটিয়ায় সাওয়ার করানো হয়, তেমনি হজযাত্রী মৃতব্যক্তির কাফনের ন্যায় ইহরামের দু’ টুকরো শ্বেত-শুভ্র সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করে যানবাহনে আরোহণ করে। কেয়ামত দিবসে আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো হজ পালনকারীর কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে- “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক! ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।”
মৃত্যুর পর যেমন সাওয়াল-জওয়াবের সম্মুখীন হতে হবে, তেমনি হজের সফরে হাজিদেরকে বিমান বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট স্থানে সরকারি-বেসরকারি লোকদের নিকট বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণাসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়।
হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করা যেন ঐ জাহানে প্রবেশ করা- যেখানে শুধুই আল্লাহর রহমত। বায়তুল্লাহ তথা কাবাঘরের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করা আরশে আজিমের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সাফা ও মারওয়া সায়ী করা হাশরের ময়দানে দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করার ন্যায়। সূর্যের প্রচণ্ড খরতাপে আরাফার ময়দানে লাখো মানুষের অবস্থান যেন হাশরের মাঠের সাদৃশ্য। হজের প্রতিটি আমলেই হাজিগণের সামনে কেয়ামতের চিত্র ভেসে ওঠে।
আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশ করা এবং রূহকে প্রকৃত প্রেম ও ভালোবাসায় রঞ্জিত করার এক অপূর্ব দৃশ্য হজ। প্রেম আকর্ষণে মাতোয়ারা প্রেমিকের ন্যায় হাজির অন্তরাত্মায় আল্লাহ তায়ালার ইশকের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। দারুণ আগ্রহ-উদ্দীপনায় হাজি সাহেবগণ তাঁর মহান দরবারে ভিড় জমায়। আল্লাহ তায়ালাও চান তাঁর ইশকে প্রেমিকগণ পাগল বেশে এভাবে তাঁর নিকট ছুটে আসুক। হাজিগণ আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে তাঁর ইশকে মাতোয়ারা হয়ে সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধান করে পাগল ও ফকিরের বেশে এলোমেলো চুল-দাড়ি নিয়ে মাঠ-ঘাট, পাহাড়-পর্বত, নদী, সাগর-মহাসাগর, বন-জঙ্গল, মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে চিৎকার দিয়ে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ উচ্চারণ করে ছুটে চলে বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে। পবিত্র মক্কা এবং মদিনায় পৌঁছে একজন হাজি মনে করে জান্নাতে পৌঁছে গেছি। আর আবেগ সমুদ্র এতটাই তরঙ্গায়িত হয়, যা’ বর্ণনা করা এবং অনুধাবন করা কঠিন।
ইহরাম বাঁধা প্রকৃত প্রেমিক হওয়ার এক জ্বলন্ত নিদর্শন। হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া, মুলতাজামে কাবার গিলাফ জড়িয়ে ধরা, কাবার চৌকাঠে মাথা ঠুকে কান্নাকাটি করা, বায়তুল্লাহর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করা ইশকে ইলাহির অনুপম দৃশ্য। তারপর সাফা-মারওয়া দৌড়াদৌড়ি, মিনায় গমন, আরাফায় অবস্থান, খোলা আকাশের নিচে ধূলি-ধূসরিত কঙ্করময় মুজদালিফায় রাতযাপন- প্রতিটি আমলেই আল্লাহর প্রেমের প্রতিফলন। জামরাতে শয়তানকে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ, পশু কোরবানি ও মাথা মুণ্ডানোর মাধ্যমে অনুরাগের শেষ মঞ্জিল অতিক্রম করে নিষ্পাপ শিশুর মতো হাজি সাহেবগণ নিজ মোকামে ফিরে আসলেও তাদের অন্তরে জ্বলতে থাকে পুনঃমিলনের অনির্বাণ শিখা।
রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেও হজের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে ইসলামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলামি চিন্তাবিদগণ হজ মৌসুমে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন। হজ মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় চেতনায় উদীপ্ত হওয়ার এবং আপস, একতা ও সম্পর্ক স্থাপনের সিঁড়ি। হজের সমাবেশে মুসলিম জনতা, দেশ, জাতি, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি বৈষম্য অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের মহান সুযোগ পায়। হজের বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’-এর বাস্তব দৃশ্য। হজের পোশাক চাল-চলন সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থার নিদর্শন। বিশ্ব রাজনীতিতে মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হজ একটি সার্থক এবং সফল আমল। এখানে ধনী-গরিব, বাদশা-ফকির, সাদা-কালো, ভিন্ন শারীরিক কাঠামো, ভিন্ন ভাষার মানবজাতির একই বেশ-ভূষা, একই আমল এবং একই স্থানে একত্রে জীবনযাপন। সারা বিশ্বের মানুষের সামাজিক জীবনব্যবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার, বিভিন্ন দেশের আলেম, জ্ঞানী-গুণীদের সান্নিধ্য পাওয়ার বিশেষ সুযোগ এনে দেয় হজ। ইসলামের পবিত্র স্থান মক্কা-মদিনায় ঐতিহাসিক বহু ইসলামিক নিদর্শন দর্শনসহ মহানবি সা., তাঁর আওলাদ ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতিসমূহ স্বচক্ষে দর্শনের অপূর্ব ব্যবস্থা হজ। হজ বিশ্ব মানবতার ঐক্য-সংহতি-চেতনা জাগ্রতসহ পরকালের মুক্তির মহান ব্যবস্থা।
আদিমানব হজরত আদম ও তদীয় স্ত্রী হাওয়া আ. সুদীর্ঘ সাড়ে তিনশ’ বছর পর্যন্ত কান্নাকাটির পর আরাফার ময়দানে তাদের পুনর্মিলন ঘটে। এ ঐতিহাসিক স্থানটিতে হাজির হতে হাজিদের সে কী উত্তেজনা ও উন্মাদনা! এখানে পৌঁছে প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে মানুষ খোদায়ী প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে।
হজরত ইবরাহিম আ. আল্লাহর হুকুমে মিনা মাঠে স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি দিতে উদ্ধত হয়েছিলেন। অন্যদিকে শয়তান তাদের উভয়কে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ধোঁকা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা পিতাণ্ডপুত্র যথার্থভাবে ইলাহি নির্দেশ পালন করতে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেন। সে স্মৃতি ধরে রাখতে আজও হাজিগণ প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে জামারায় গিয়ে প্রতীকী শয়তানের গায়ে পাথর মারতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এমনকি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কেউ কেউ আবেগের আতিশয্যে জুতাণ্ডস্যান্ডেল, লাঠি নিক্ষেপ করে।
তৃঞ্চার্ত শিশু ইসমাঈলকে পানি পান করাতে মা হাজেরা সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালার কাছে সন্তানের প্রতি মায়ের নির্মল এ ভালোবাসার দৃশ্যটি এতই পছন্দের হয়ে পড়ে যে, তিনি তাবৎ পৃথিবীর হজযাত্রীদের জন্য এ ছুটোছুটিকে আবশ্যকীয় করে দেন। এটি এক ধরনের পাগলামি বা প্রেমের উন্মাদনা নয় তো কী? তাই বলা যায়, প্রতি বছর হজ এসে আমাদেরকে ইলাহি প্রেমে মাতোয়ারা হওয়ার সবক দিয়ে যায়।
হজে সবার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং পাপমুক্ত হয়ে সুস্থ জিন্দেগি যাপন। তাই আকার, আকৃতি, প্রকৃতি, পেশা, বর্ণ, ভাষায় পার্থক্য সত্ত্বেও সব প্রেমিক হাজির মধ্যে অভিন্ন চেতনা লক্ষণীয়। কারও মধ্যেই নেই হিংসা-বিদ্বেষ, আভিজাত্যের অহংকার। কোনো আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের, সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদার নেই শ্রেষ্ঠত্ব। আরাফাহ, মুজদালিফা, মিনায় যথাসময়ে ও শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসম্পাদনেও রয়েছে এ মহৎ চেতনার প্রশিক্ষণ। এখানে সময়নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতার পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ অর্জিত হয়ে থাকে।
আধুনিক বিশ্বে অশান্তির মূল কারণ নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন। খোদাভীতির হজ মানুষের নৈতিক চরিত্র উন্নত করে। মনকে করে আকাশের মতো বড়। তবে এর জন্য প্রয়োজন নিয়তের পরিশুদ্ধতা, অন্তরাত্মার পবিত্রতা এবং হালাল টাকায় হজের কার্যসম্পাদন করা। তবেই আল্লাহর প্রেমিক হাজিগণ হজের কোরবানির মাধ্যমে মনের পশুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তিকে কোরবানি করে হতে পারবে সোনার মানুষ। তখনই তারা আল্ল¬াহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরবে, পরপর বিচ্ছিন্ন না হয়ে একে অন্যের কল্যাণে উজ্জীবিত হবে। ইবরাহিমি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং মুহাম্মদি প্রেমের বাণী নিয়ে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হবে সমগ্র বিশ্বে। মক্কা-মদিনার প্রেমের জ্যোতির্ময় চাদর অঙ্গে জড়িয়েও যাদের মনের ইবলিসি ভাব দূর হয় না তারা বড়ই হতভাগা! তাদের হজ বিলাস ভ্রমণ বা নেহায়েতই মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ তায়ালার গায়েবি ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরই কাছে নিজেকে সোপর্দ করতে ব্যর্থ হয় তারা।
হজ মূলত হাজিদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও নৈতিক দায়িত্ববোধের শিক্ষা দেয়। আল্লাহর রাস্তায় মানুষের জান, মাল উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে। হাজিদের পাপমুক্ত করে। রাসুল সা. বলেছেন, ‘যে হজের উদ্দেশ্যে এ ঘরে আগমন করে কোনো নির্লজ্জ কথা না বলে এবং ফাসেকি না করে সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে।’ (বুখারি, মুসলিম)।
মূলত এমন হাজিদের স্পর্শে অন্যেরা আলোকিত হয়। হয় উন্নত চরিত্রের অধিকারী। মানুষ বুঝতে শিখে ইসলাম ধর্ম কোনো বিভেদ সৃষ্টিকারী নয়; বরং যাবতীয় মতানৈক্য নিরসনকারী ও শান্তির ধর্ম। বিজ্ঞানের যুগে যুদ্ধ, সংঘাত, অশান্তি ও অনাচার মোকাবিলায় পৃথিবীবাসীর জন্য হজের তাকওয়ার শিক্ষা, সৌভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, শৃঙ্খলা, ঐক্য ও সংহতির শিক্ষা অপরিহার্য। হজ আজকের অবহেলিত ও নিপীড়িত মুসলিম বিশ্বের জন্য আলোর মিছিল, প্রেমের অভ্যুত্থান।
লেখক : আলোচক : বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স।