প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
দর্শন ইন্দ্রিয় চক্ষু, আমাদের অমূল্য সম্পদ। সৃষ্টির রহস্য লীলা মানব প্রজ্ঞাতীত। প্রত্যক্ষভাবে পরখের জন্য দুটি চক্ষু আর পরোক্ষভাবে উপলব্ধির পর্দায় মনের মাঝে দুটি আঁখি। যা অনেকদিন আগের স্মৃতির রোমন্থন ঘটায়ে মনকে পুলকিত করে দেয়। সেই দৃষ্টির পর্দা, মন আর জ্ঞান এরা পরস্পর প্রতিবেশী। দৃষ্টিনন্দন কোনো কিছু পর্দায় প্রতিফলিত হওয়ার পর পরই চঞ্চলমতি 'মনে'র বিশ্লেষণের আওতায় চলে যায়। গ্রাহ্য কি অগ্রাহ্য মনের এই দোদুল্যমানতায় মুহূর্তের মধ্যে চলে যায় 'জ্ঞানে'র আদালতে। এটিই দর্শকের ক্ষুধার নিবৃত্তি।
শ্রবণ ইন্দ্রিয় কর্ণ। বাতাসে ভাসমান শব্দের তরঙ্গ কর্ণ কুহুরে প্রবেশ করে শব্দানুভূতির জন্ম দেয়, যা মানুষের শ্রবণানুভূতিতে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দেয়।
নাসিকা হলো শ্বাস-প্রশ্বাসতন্ত্র বিরতিহীন একটি চলমান ইন্দ্রিয় এবং ঘ্রাণ অনুভূতির উদ্দীপক। নাসিকাকে চলমান রাখে দেহ অভ্যন্তরের ফুসফুস এবং হৃদযন্ত্র। এদের স্বাভাবিকতাই জীব জগতের স্বস্তি আর অস্বাভাবিকতাই জীবের অস্বস্তি।
জিহ্বা হলো কোনো কিছুর স্বাদ এবং রস-আস্বাদন ইন্দ্রিয়। জিহ্বা থেকে কোনো কিছুর স্বাদ এতো দ্রুত আপাদমস্তকে সঞ্চালিত হয় যা কল্পনারও অতীত। মুখ গহ্বরের ভেতর জিহ্বা থাকে। জিহ্বার উপরের ফাঁকা স্থানকে মুখ বিবর বলে, যা ধ্বনি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফুসফুস, জিহ্বা এবং নাসাপথ যৌথভাবে ধ্বনি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ত্বক এমন একটি ইন্দ্রিয় যা জীবদেহকে বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন অপদ্রব্য থেকে নিরন্তর রক্ষা করে। ত্বকের ভূমিকায় মানবদেহ অনুভূতিপ্রবণ। মানব দেহ রক্ত-মাংসের তৈরি। এ দেহকে ঢেকে রেখেছে ত্বক। ত্বকের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য অদৃশ্য ছিদ্র, যাকে লোমকূপ বলে। এই লোমকূপ দিয়ে দেহ থেকে ঘাম বের হয়।
এই পাঁচটি বাহ্যিক ইন্দ্রিয় জীবের জন্য অসীম অপরিহার্য। এমন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে পঞ্চ ইন্দ্রিয় গুলো পরস্পর সহাবস্থানে আছে, যা সত্যিই রহস্যাবৃত।
মানব দেহের ভেতর অজ্ঞাত স্থানে দুটি ইন্দ্রিয়, একটি হলো 'মন' অপরটি হলো 'জ্ঞান' অবস্থান করে। মন একটি চঞ্চল ইন্দ্রিয়, আর জ্ঞান চঞ্চলমতি 'মনে'র শিক্ষক। যে মানুষের মধ্যে মনের প্রাধান্য বেশি, সে মানুষ অপরাধপ্রবণ বেশি। আর যে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের প্রাধান্য বেশি সে দুর্নীতিমুক্ত থাকতে চায়।
মানুষ কিন্তু স্বভাবতই রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শ্রবণে অনুরক্ত বেশি। মানবকূল ইন্দ্রিয় সুখে পরিতৃপ্ত এবং জল্পক।
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই ইন্দ্রিয় রসনার পরিচর্যায় কেউ পিছিয়ে নেই। যৌবনে ইন্দ্রিয়ের অপব্যবহার বার্ধক্যের আগেই ইন্দ্রিয় শিথিলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যৌবন জোশে, বেসামাল হলেই বার্ধক্যে ইন্দ্রিয় তার সঠিক কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
শরীরের যোশের আহ্বানে ছয়টি রিপু যেমন :- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাত, মাৎশর্য্য যে মানুষকে ঘিরে ফেলে সে তখন ভুলে যায়, মৃত্যু জীবনের লক্ষ্য, সৌন্দর্যের লক্ষ্য, ঐশ্বর্যের লক্ষ্য, শক্তির লক্ষ্য, এমনকি ধর্মেরও লক্ষ্য।
এই চরাচরে ধার্মিক ও অধার্মিক মরছে, ধনী ও নির্ধন মরছে, শক্তিশালী ও দুর্বল মরছে, সকলেই মৃত্যুর পথে ধাবমান। তথাপি এই নশ্বর জীবনের প্রতি অপরিণামদর্শী মানুষের আসক্তি। মানুষ হলো জীবোত্তম। মানুষের প্রবল এবং একনিষ্ঠ ইচ্ছাশক্তির কাছে জাগতিক অজেয় সব কিছুরই মর্মোদ্ঘাটিত হয়ে যায়। তখনই মানুষের মোক্ষম প্রাপ্তি ঘটে যায়।
প্রভাব সূর্যোদয় যেমন, সারাটা দিন কেমন ভাবে অতিবাহিত হওয়ার ইংগিত বহন করে, তেমনি ১৩-১৯ বছর বয়সী যুবক-যুবতীর বয়ঃসন্ধিকালের চাল-চালন স্পষ্টভাবে বলে দিবে কার পরিণত বয়স আলোকোজ্জ্বল আর কার পরিণত বয়স নিবিড় অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে। ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্ররোচনায় যদি রিপুগুলো তার স্বাভাবিক ধর্ম চরিতার্থে মনোনিবেশ করে, তবে সে ব্যক্তি সমাজে ঘৃণিত, উপেক্ষিত এবং অপাংক্তেয় হবে।
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষের মধ্যে এমন কিছু শক্তি সুপ্তভাবে স্রষ্টা রেখে দিয়েছেন যার বিস্ফোরণ একমাত্র মানুষই ঘটাতে পারে। সেই দুর্দমমীয় শক্তির নাম 'ইচ্ছাশক্তি'। ঐকান্তিক ইচ্ছাশক্তির প্রাবল্যে রিপুগুলো বশে চলে আসে। রিপু মুক্ত মানুষ মহামানব। আর মহামানব হলো বাক্সিদ্ধ মহাপুরুষ। জাগতিক শক্তিগুলোর চাইতে এই আধ্যাত্মিক শক্তি অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। এই বাংলায় মহাপুরুষদের বহু আলোকিক কীর্তি জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। জিতেন্দ্রিয়দের ইহকাল-পরকাল অনিবার্য সুখকর।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও লেখক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।