প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
কোনো এক শারদ পূর্ণিমা তিথির গোধুলিতে চন্দ্রোদয় এবং দিনমণি অস্তাচলের দৃশ্য দেখতে দাঁড়ালাম রাস্তায়। আমাদের বসতবাড়ির সামনেই ছিল সেই পায়ে চলার পথটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় ভরে গেলো ধরণী। কিন্তু একটু দূরের বাড়ির ঘরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো কুপি এবং হারিকেনের আলোর অতি শান্ত আলোকচ্ছটা। যা বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আজ জাদুঘরে নির্বাসিত। একই সাথে দিনমণির আলোকচ্ছটা ক্রমাবলুপ্তি এবং অংশুমানের আঁধার নিবৃত্তির প্রচেষ্টা -- এ যেন সত্যি অবণীর এক প্রকৌশল নীতি। হঠাৎ চোখে পড়লো হারিকেনের টিম টিম বাতিতে কে যেন আমাদের দিকে আসছে। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসার উত্তরে জানা গেল যে, গতানুগতিক মুসলিম রীতি অনুযায়ী এই মধ্যম বয়সী দম্পতি আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছেন। দিনের বেলায় এমনটি ঘটলে, পরপুরুষের নজরে আসলে নাকি ধর্মের গ্লানি হতে পারে।
বিশ্বের মুসলিম নারী গোষ্ঠি এইটুকু রক্ষণশীলতার নির্মম শিকার হয়ে প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃত থেকে বঞ্চিত ছিল। বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর কার্যকর ভূমিকায় অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম নারীরা অযৌক্তিক রক্ষণশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং আলোর মুখ দেখতে হবে। এর জন্য মুক্ত নারী শিক্ষার প্রয়োজন। তাই তিনি নিজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি নারী শিক্ষালয়। যেটি নারী জাগরণের উপ্তবীজ। আজ নারীরা পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে সর্বক্ষেত্রেই সম অধিকার প্রাপ্ত হয়েছে।
এভারেস্ট বিজয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সর্বনি¤œ পদ পর্যন্ত নারীরা নিজেকে চাকুরিতে উপযুক্ত প্রমাণ করেছে। সৌদি আরবের ধূসর মরুর বুকে গড়ে ওঠা বিশ্বের সুন্দরতম অট্টালিকা, বিলাসবহুল হোটেলসহ কর্মব্যস্ত নগর চত্বর হলেও কী যেন একটার অভাব মনে মনে অনুভূত হতো। কিন্তু প্রকাশ করা যেত না। সেটা আজ বিশ্ববাসীর নজরে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত। এক সময়ে শুধু মাত্র তেলভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল দেশ আজ বহুধা অর্থনৈতিক উৎস সম্পন্ন দেশে পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে নারীদের যুগোপযোগী অধিকারের বিষয়ে অনেকটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইউরোপ এবং এশিয়ায় অনেক দেশেই নারী-পুরুষকে সমঅধিকারী করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সৌদিতে যা করা হয়েছে, তা বাস্তবেই প্রশংসার যোগ্য। সৌদি থেকে বেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া এবং ক্রীড়ায় সৌদি নারীদের উৎসাহিত করতে পারার মতো সেই দুঃসাহসিক সৌদি রাজকুমারী রীমা আজ যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি রাষ্টদূত। (সূত্র : দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন। তাং : ১৮/০২/২০২১ খ্রিঃ এবং ০৮/০৩/২০২১ খ্রিঃ)।
সৌদি নারীরা এখন ভোটাধিকার প্রাপ্ত এবং সাথে সাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকারও প্রাপ্ত হয়েছে। নারী সৈনিকও নিয়োগ দিয়েছে সৌদি সেনাবাহিনী, যা এক সময় কল্পনা করাও সাধ্যাতীত ছিল।
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের ৪৫ কিলোমিটার দূরে কিদিয়া নামক স্থানে বিশ্বসেরা বিনোদন কেন্দ্র স্থাপিত আছে। এছাড়াও গড়ে উঠছে বিভিন্ন শহরে হালাল ডান্সবার এবং আনুষঙ্গিক বিলাসবহুল ক্যাফে ও লাউঞ্চ। এই মহাবিশ্ব চরাচরে সৃষ্টির রূপান্তর ধাপে ধাপে হয়ে থাকে। এই অমোঘ নিয়মের ধারাতেই সৌদি নারীরা আজ গাড়ি চালাচ্ছে, বিমান চালাচ্ছে এবং সিনেমা হলকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি পাচ্ছে। এসব পরিবর্তনকে সৌদি নারীদের সামনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি বলে মনে করছেন দেশটির নারী অধিকার কর্মীরা। এ পরিবর্তনগুলো সংশ্লিষ্টদের প্রতীক্ষিত ছিল। তদবধি মানব-মানবী সমাজ পরস্পর সম অধিকারেই চলে আসছিল। হঠাৎ অজ্ঞাত কারণেই এ রীতি কিছুটা বিবর্ণ হয়েছিল। আজ এই অত্যাধুনিক যুগে নরনারী সার্বিক সমঅধিকার কায়েমের জন্য অপেক্ষমান। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের বর্বরতাও অবশ্যই লজ্জিত হবে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের গৃহকর্মী নারীর ওপর সহিংসতার নারকীয়তায়। এতসব বিভিন্ন অযৌক্তিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বিশ্ব নারী সমাজ স্বোদ্দিপনায় যুগে যুগে লড়াই করে মুক্তির দ্বার প্রান্তে এসে পৌছেছে। তা অবশ্যই তুলনাহীন প্রশংসার দাবি রাখে।
কবির ভাষায় নির্জলা সত্যটি হলো :
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর;
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
কাজেই নারী জাতি সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে বিবেচ্য। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং অধিকার হরণ নিশ্চয়ই অমানবিক। পুরুষ শাসিত সমাজের আওতা থেকে যৌক্তিক মুক্ত হওয়া এবং নারী-পুরুষ সমঅধিকার প্রাপ্তির আন্দোলনে নারী সমাজ আজ সফলতার দ্বারপ্রান্তে।
এক্ষণে মনে পড়ে, স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্যের অন্তরালে সর্বক্ষেত্রে পজিটিভ আর নেগেটিভের সমন্বয় অপরিহার্য। ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আয়নের সমন্বয় ঘটিয়ে আজকের এই ডিজিটাল সভ্যতা। যুগ যুগান্তরে এর ক্রমবর্ধিষ্ণুতা বজায় রাখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সকলের। অন্যথায় শীর্ষে অবস্থানরত মানবসভ্যতা লজ্জায় ম্রিয়মান থাকবে।
উপসংহারে বলা যায়, নারী ও পুরুষ নিয়েই মানবকূল সৃষ্টি হয়েছে। বিদায় হজ্বের ঐশী বার্তায় বলা আছে, নারী ও পুরুষ পরস্পরের উপর সম অধিকারী। কারণ সকল সৃষ্টির রহস্যেই ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আয়নের সুনির্দিষ্ট সংমিশ্রণ বিরাজমান। এতদ্ব্যতীত সৃষ্টি স্থবির।
লেখক : কবি; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।