বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

জীবনের গল্প
অনলাইন ডেস্ক

আমি মূলত একজন কলাম লেখক। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করি। বরাবরই বাস্তবতার সাথে চলতে ভালো লাগে আমার। দেশে সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই সামনে নিয়ে আসি আমার কলাম কিংবা কবিতায়। অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভালো লাগে। কিছু একটা বলতে ভালো লাগে। তাই লিখে প্রকাশ করি। এটা প্রতিবাদ কিনা জানি না। তবে চেষ্টা করি সাধারণ মানুষের মনের কথা লেখার। আমার হিতাকাক্সক্ষীরা বলেন, আমি নাকি গল্প লিখলে অনেক ভালো করতাম। গিন্নিও মাঝেমধ্যে গল্প লিখার তাগিদ দেন। অবশ্য ছাত্রজীবনে দু'চারটা গল্প যে লিখিনি তা নয়। স্কুল জীবনে আমার লেখা গল্প পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে। বাস্তববাদী মানুষ আমি, তাই গল্প আমার কাছে গল্পই মনে হয় কেন জানি। তাই গল্প লেখা হয় না। একেবারে জীবনমুখী এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়েই কাজ করি। আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আজকে লিখতেই পছন্দ বেশি আমার। মানুষের জীবনের দুঃখণ্ডকষ্ট আর সুখগুলো সামনে আনার চেষ্টা করেছি আমার লেখায়। সেই আমিই আজ গল্প লিখব, তবে জীবনের গল্প। আমার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তা নিয়েই আজকের এই খণ্ড গল্প।

ঈদের হাসি!

পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনায় চোখে জল আসে। বুক ধড়ফড় করে। না সইবার কষ্টে এমনটা অনেকেরই হয়। ঈদে নিজের জন্যে কেনা হয় না কিছুই। স্বজনদের জন্যে সেদিন রাজধানীর একটি মার্কেটে গিয়ে কেনার বদলে কষ্ট নিয়েই বাড়ি ফিরলাম। মার্কেটে শিশুর চিৎকারের শব্দ কানে এলো। এক মেয়ে শিশু, ৫ বছর হবে বয়স। কাঁদছে, জামাটা সে নেবেই নেবে। বাবার সাধ্য নেই, কী করে কিনবে ঐ জামা। চেহারা দেখেই বেশ বুঝতে পারলাম না। ইচ্ছে জাগলো শিশুটিকে ঐটা নয় সাথে আরও ক’টি জামা কিনে তার হাতে তুলে দিই। আমার পূর্ব পরিচিত হলে সেটাই করতাম হয়তো। এ প্রস্তাব দিলে কী ভাবে সেটা ভেবে চুপসে গেলাম। মানুষেরতো আবার আত্মসম্মানও আছে। চাপা কষ্টে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ভাবলাম, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অল্প আয়ের মানুষের ঈদ আনন্দটা যেন নিরানন্দ হয়েই আসে। প্রতিটি বাবা-মা'ই সন্তানদের হাতে ইচ্ছামত জামাকাপড় তুলে দিয়ে হাসি মুখটা দেখতে চায়। ক'জনের ভাগ্যেই বা সেই হাসি জোটে।

সুখটা খুঁজতে হয়

এক সময় জনকণ্ঠে আমরা একসাথে কাজ করতাম। সারাদেশ নয়, তখন বিশ্বজুড়ে একটি আলোচিত ঘটনা ছিলো সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। প্রবীর দা অত্যন্ত দাপুটে এবং সাহসী লেখক। অপরাধীদের বিরুদ্ধে লাগাতার লিখতে গিয়ে আপস না করায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন তিনি। বোমায় তাঁর একটি পা উড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালে ছিলেন বেশ কয়েক মাস। প্রধানমন্ত্রীর উদারতায় দেশের বাইরে থেকেও চিকিৎসা করে আনা হয় প্রবীর দাকে। তিনি এখন একটি দৈনিকের প্রকাশক ও সম্পাদক। তাঁর সাথে সম্পর্কটা সেই আগের মতোই আছে। সামনাসামনি কম হলেও ফেসবুকে আমরা খুব মুখোমুখি প্রতিদিন।

সেদিন তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন- "২০০+২০০=প্রবির সিকদার"। তারপর তাঁর বক্তব্যটা এমন ছিলো, রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি। রাস্তায় চৌকিতে ফেলে রাখা দুটি জামা হাতে তুলে নেন। জামার দাম জানতে চাইলেই বিক্রেতা ৮শ’ টাকা দাম হাঁকেন। তিনি অনেকটা না নেবার উদ্দেশ্যে দুটি জামার দাম ৪ শ’ টাকা দেবেন বলে জানান। বিক্রেতা প্রথমে রাজি না হলেও প্রবীর দা যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন তার হাতে জামা ধরিয়ে দিয়ে বিক্রেতা টাকা চাইলো। ভাগ্যিস তার হাতে ৪শ’ টাকা ছিলো, তাণ্ডই দিয়ে জামা দুটো নিয়ে বাসায় ফিরলেন। একে একে দুটি জামা পরে ছবি তুলে ফেসবুকে দুই দফায় আপলোডও করেন। দুটি জামাতেই বেশ চমৎকার লাগছিলো প্রবীর দাকে। জামা দুটি অত্যন্ত কালারফুল এবং কম্বিনেশনটাও বেশ। আসলে আত্মতৃপ্তির জন্যে অনেক দামের কিছু হতে হয় না সব সময়। বাজারের কোনো কোনো জামা হয়তো ১০০ কিংবা ২০০ ডলার বা তার অধিক দামেরও রয়েছে। সত্যিই প্রবীর দা যদি তা প্রকাশ না করতেন তাহলে ভাবতাম জামাগুলোর দাম না জানি কত! দুশো টাকার জামাতে প্রবীর দার চোখে মুখে যে তৃপ্তি দেখেছি, সেটা অনেক বড় কিছু। তৃপ্তিটা এমনই। সুখটা আসলে নিজের কাছে। নিজে নিজেই খুঁজে নিতে হয়। যা খুব সহজে প্রবীর দা খুঁজে নিয়েছেন। আমরা যখন যেভাবে যা-ই পাই, যা-ই খাই তাতে তৃপ্তি যেন খুঁজে নেই। মূল্য দিয়ে তৃপ্ত হওয়া যায় না। কম মূল্যের জিনিসেও তৃপ্তি খুঁজে নিতে হয়। প্রবীর দার রাস্তা থেকে কেনা দুটি জামা পরে ফেসবুকে তাঁর স্ট্যাটাস আর তার সে সময়কার আলো ঝলমলে চেহারাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

অন্যরকম সুখ

সেদিন ছেলেটা আখের রস খাবে বলতেই বাসা থেকে নিচে নেমে গেলাম আখের রস কিনবো বলে। জুসবারে রস কিনছি, এমন সময় এক শিশু এসে হাজির। ২০ টাকা হাতে দিলাম, তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। আখের রসের দিকে কী তৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। কেনা রসের বোতলটা ওর হাতে তুলে দিতেই সে কী হাসি। লাখ টাকায়ও কি তা কেনা যায়? রস তার হাতে পেয়েই আনন্দ দৌড়ে কোথায় পালিয়ে গেল। পিছু নিলাম। পাশেই রাস্তায় হুইল চেয়ারে বসা পঙ্গু বাবার সাথে তার ছোট ভাই। আখের রসের বোতলটা দেখে শিশু বাচ্চাটা ফোকলা দাঁতে সে কী তৃপ্তির হাসি দিলো তা আর লিখে প্রকাশ করা যাবে না। পঙ্গু বাবা আর ছোট ভাইটার সাথে সুখটা শেয়ার করতেই সে দৌড়ে যে এসেছে তা বুঝলাম। ছোট ছোট সুখের সংবাদগুলো আসলে এমনই হয়। জানেন মাত্র ৬০ টাকার বিনিময়ে এমন সুখটা সেদিন দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। যাদের সামর্থ্য আছে তারা এমন সুখ কিনতে পারেন অনায়াসেই।

ভারতের আগরতলা বই মেলায় নিজের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের একটি অনুষ্ঠানে যোগদানের পর হোটেল থেকে আগরতলা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে উবার চেপেছি কলকাতা যাবো বলে। ট্রাফিক সিগনালে পা নেই লাঠি ভর করেই গাড়ির সামনে হাজির ২২/২৩ বছরের এক যুবক। কিছু হাতে দিতে চেহারাটা যেন জ্বলজ্বল করছে তার। প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তিটা হয়তো বেশি ছিল তার, নয়তো তৃপ্তিটা বেশি! ভাবলাম মানুষকে খুশি করতে অনেক বেশি কিছু লাগে না, শুধু একটা মন লাগে। মাঝে মাঝেই যদি এমনটা করি আমরা অন্তত জ্বলজ্বলে হাসিমুখগুলোতো দেখতে পাবো।

স্রষ্টার মহান খেলা...

খুব নিকটাত্মীয়ের গল্পটা বলছি আমি। সেটি ছিলো বছর পনের আগের কথা। তখন রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে থাকি আমরা। আমার ঐ আত্মীয় বিদেশ থেকে তার সন্তানদের জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় কিনে আনেন। কোরবানি ঈদের ঠিক দু দিন আগের কথা। সন্তানদের মাঝে কাপড় বন্টন করতে গিয়ে দেখলেন, বাসার কাজের বুয়াটা সেদিন তার সন্তানকে সাথে নিয়ে কাজে এসেছেন। শিশুটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল সেই কাপড়ের দিকে। আত্মীয়ের দিলে ভীষণ চোট লাগে। সাথে সাথেই গায়ে কাপড় চেপে নিচে নেমে গেলেন তিনি। ফুটপাত থেকে একটি লাল গেঞ্জি আর কালো রংয়ের প্যান্ট নিয়ে এলেন। তার হাতে কাপড়গুলো দিতেই সে কী আনন্দ! আমিও উপভোগ করি তার সেদিনের জ্বলজ্বলে সেই মুখখানি। অল্পতে খুশি হওয়া সেই চেহারাটা এখনো আমার চোখে ভাসে। বিদেশ থেকে দামি ব্রান্ডের কাপড় সবটা যে তার সন্তানদের পছন্দ হয়নি এটা আমি সেদিন বুঝতে পেরেছি। সৃষ্টিকর্তা আসলে সত্যিই পারেন। সুখটা কাকে কখন কীভাবে দিবেন, তৃপ্তি কোথায় নিহিত সেটা অত্যন্ত রহস্যময়। কাউকে তিনি অল্পতে অনেক তৃপ্তি আর সুখ দেন, আবার অনেক কিছু থেকেও অনেকের সুখ নেই শান্তি নেই। এটাই হয়তো ভালোলাগার দুনিয়ায় স্রষ্টার মহান খেলা...

ঘুমের গল্প..

ঘুমটা আসলে আল্লাহর বিশাল একটা নেয়ামত। লাখ টাকার পালঙ্কে শুয়ে কারো হয়তো ঘুম হয় না; ছটফট করে রাতটা কষ্টে কাটে। স্বামী হয়তো কোনো ডিস্কো পার্টিতে কিংবা মদের বারে ফুর্তি করছে। রাস্তা কিংবা ফুটপাতে টাঙ্গানো পলিথিনের ভেতরে অনেক দম্পতির কতই না সুখের সংসার। এই আমরাই দেখি ফুটপাতে শব্দ আর ধুলাবালির মধ্যে কেউ কেউ নাক ডেকে ঘুমায়। আবার দেখি রাস্তার পাশে কোনো খালি জায়গায় ভর রোদে তৃপ্তির ঘুম দিচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। অনেকে এসিতে ঘুমের ঔষধ খেয়েও ঘুমাতে পারে না। দামি গাড়ি, বাড়ি, খাট-পালং আর অর্থ বৈভব দিয়ে সুখ আর তৃপ্তি পাওয়া যায় না। সুখটা অন্য এক রকম। অনেক অর্থের মধ্যে থেকেও মানুষ সুখী নয়; আবার অল্প অর্থে খুব সুন্দর সুখী জীবনযাপন করছেন অনেকে। অনেকে ফুটপাত থেকে জামা কিনে তৃপ্ত। গায়ে জড়িয়ে ভাবেন কতই না সুন্দর লাগছে তাকে। আবার একই জামা গায়ে চেপে চুলকানি বেড়ে যায়! ফুটপাত থেকে কেনা জামা ভেবে কুটকুট করছে গায়। চিত্তে শান্তি নেই। ভাবে এত কম দামি জামা, কী ভাবছেই না জানি লোকে। ঐ যে বলছিলাম, নিজ ভাবনাটার মধ্যেই সুখ অন্তর্নিহিত। সুখী হতে নিজেকে সুখী ভাবতে হয়। সুখ পেতে হয় নিজের কাছেই।

সুস্থ থাকার গল্প

অঢেল অর্থের মালিক এক পুলিশ কর্মকর্তা তার মাকে অসুস্থ হলে প্রথমে চেন্নাই পরে সিঙ্গাপুর পাঠান চিকিৎসার জন্যে। মাস দুয়েক পরে খালাম্মাকে লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে দেশে। কোনো চিকিৎসক কোনো চিকিৎসায় তাকে সারিয়ে তুলতে পারেন নি। একই সময় আমাদের কাজের ছেলেটা তার মায়ের অসুস্থতার কথা জানায় আমাদের। বলছিলো মস্ত বড় রোগ হয়েছে তার। আর নাকি বাঁচানো যাবে না। আমার ডাক্তার ছেলেটা তার হাসপাতালে ক’দিন চিকিৎসা দিতেই তিনি ভালো হয়ে উঠলেন। মাত্র অল্প ক’টাকা খরচেই সুস্থ ঐ মা।

সুস্থতা আল্লার বড় নেয়ামত। কেউ অল্পতেই সেরে উঠে, আবার সুস্থ মানুষ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যান, শত চেষ্টায়ও তাকে আর এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। এমনটাই তো হচ্ছে সব সময়।

কই, আমি আমার বাবাকেতো শত চেষ্ট করেও বাঁচাতে পারলাম না। ক’ মাস অগে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। দেশের অসংখ্য নামিদামি ডাক্তার বোর্ড মিটিং করে দিনের পর দিন চেষ্টা করেও সব ব্যর্থ। মন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিবসহ অনেকের তদারকির পরও কি আমি আমার বাবাকে আর বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি?

জীবনের গল্পতো অনেকই হলো। আমার বাবার জীবনের গল্প না বললে গল্পের সমাপ্তি হবে না হয়তো।

বাবার গল্প..

আমার বাবা আলহাজ্ব মীর তাজউদ্দিন আহম্মেদ। দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন; দেশকে প্রচণ্ড রকমে ভালোবাসেন। তিনি ২০২১-এর ২৩ অক্টোবর আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। সেই থেকে আমি বটবৃক্ষের ছায়া বঞ্চিত একজন মানুষ। তাঁর অভাবটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমার দৃষ্টিতে আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ ও আদর্শ ব্যক্তি ছিলেন। শুধু তাঁর সন্তানদের জন্যে নয়, সকলের জন্যে। একটা মানুষ কত বেশি নীতিবান, নিঃস্বার্থ, ধৈর্যশীল এবং উদার হতে পারেন তা আমার বাবাকে দেখলেই বুঝা যেত। সেই ছোটকাল থেকেই বাবাকে যেভাবে দেখেছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৯৬ বছরে তিনি ঠিক তেমনই ছিলেন। নীতি ও কর্তব্যে অটল একটা পরোপকারী মানুষ।

যেখানে আমরা কামনা করি আমার সন্তান থাকুক দুধে-ভাতে, সেখানে আমার বাবা কামনা করেন তার সন্তান থাকেন যেন ন্যায়-নীতিতে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর কাছে কর্মই ছিলো জীবন। তাই ৯৬ বছর বয়সেও তাঁর বসে থাকার ফুরসত ছিলো না। এ বয়সেও কেন এত কাজ করেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলতেন, 'কাজ না করে খেলে খাবার হালাল হয় না’। বাবা তাঁর ছাদ বাগানটা আর সমাজ এবং পারিবারিক জীবনের দ্বন্দ্ব মিটাতে দিনের অনেকটা সময় পার করতেন। বাবাকে কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করতে দেখিনি। পারিবারিক বা সামাজিক যে কোনো আদালতে তাঁর বিচার ছিল নিরপেক্ষ। সত্যের ব্যাপারে কাউকেই পরোয়া করতেন না।

কখনো স্নেহের প্রচণ্ড শীতল হাওয়া তার ন্যায় বিচারের শিক্ষাকে নেভানো বা অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারেনি। তার দৃষ্টি সবার ওপর মানুষ সত্য। তাঁকে দেখেছি তাঁর অফিসের অধীনস্থ্ কেরানি-পিয়নকেও সম্মান দেখাতে। তিনি নিজের এবং তাঁর সন্তানের স্বার্থ অপেক্ষা অন্যের স্বার্থকে বড় করে দেখতেন। নিজের ক্ষতি ও ত্যাগ স্বীকার করেও অন্যের মঙ্গলের জন্যে কাজ করেছেন। বাবাকে কখনও অন্যায় করতে দেখিনি। মিথ্যা বলতে শুনিনি। আমাদেরকে তিনি সে শিক্ষাই দিয়েছেন। এমন একজন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ এবং ন্যায়বিচারক বাবার সন্তান হয়ে আমরা গর্ববোধ করি এখনো। আমার বাবার স্নেহের ছায়ায় আমরা ৫ ভাই-বোন সিক্ত ছিলাম। তিনি ছাড়া আমাদের জীবন যেন ছিলো অন্ধকার। আমরা এ আলো হারাতে চাইনি। কিন্তু বিধির বিধান! তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন। সময়টা খুব বেশি নয়, তবুও মনে হয় কত শত বছর যেন বাবাকে দেখি না। আমাদের সব যেন শূন্যতায় ভরা।

নোংরা গল্প

সেদিন ভোরে হাঁটতে গিয়ে ডাস্টবিনের পাশে মানুষের জটলা দেখে চোখ গেল সে দিকে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সদ্য ভূমিষ্ঠ একটি নিষ্পাপ শিশুর লাশ পড়ে আাছে ডাস্টবিনে। হয়তো কারো পাপের ফসল এভাবেই ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেছে কোনো কুলাঙ্গার। ভাবলাম, আমার এক আত্মীয় অনেক পদস্থ কর্মকর্তা। নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। সৎ উপার্জনে বিশ্বাসী। মধ্য বয়স পাড়ি দিয়েও শত চেষ্টায় পিতা হতে পারেননি। তার স্ত্রীর কী যে কষ্ট সেটা কি আমরা বুঝতে পারি? এই দম্পতি একটি সন্তানের জন্যে কত কি না করেছেন! আর আরেকটি শ্রেণি তারা পাপের ফসল এভাবেই ডাস্টবিনে ফেলে তাদের নষ্ট গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছে। কেউ চেয়েও পায় না, আবার কেউ পেয়ে হারায়।

পান্তা ভাতের গল্প..

দেশের বাইরে থেকে এসেই শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছিল না। সেহেরীতে কোনো কিছুই খেতে ভালো লাগে না। দ্বিতীয় রোজার দিন যখন সেহেরী খাচ্ছিলাম, মাছ যেন কেমন বিস্বাদ লাগছিলো। নদীর টাটকা মাছ এমন লাগছে কেন? পরক্ষণই ভাবলাম, কত রোজাদার সামান্য একটু মাছও পাতে জুটাতে পারছে না। আর আমরা পেয়েও স্বাদ পাচ্ছি না। আসলে কেউ মাছ মাংস কোরমা পোলাও সামনে রেখেও খেতে পারে না, থাকলেও তৃপ্তি হয় না। আবার অনেকে পান্তা ভাতে কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ ডলে গোগ্রাসে খেয়ে সে কী তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। তৃপ্তিটা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে একেকভাবেই দিয়ে থাকেন হয়তো।

‘ফুটানির গল্প’

পৃথিবীতে কেউ আপনার সুখের দায়িত্ব নিয়ে বসে নেই, আপনার সুখের জন্যে আপনাকেই পরিশ্রম করতে হবে, আয় করতে হবে। যেমন আয় করবেন তেমন ব্যয় করতে হবে; অপচয় করা যাবে না। মিতব্যয়ী হতে হবে। তাহলে জীবনটা সুন্দর হবে। এ প্রসঙ্গে একটি পারিবারিক বিষয় আলোচনায় আনলাম।

হানিফ চাচাকে স্যান্ডেল কিংবা জুতা পরতে দেখিনি কখনো। প্যান্ট আর পায়জামাতো নয়ই। তিনি আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন। তবে তাকে আমরা কাজের লোক ভাবিনি কখনো। বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় বাড়ির সবাই তাকে অত্যন্ত সম্মান দিয়ে চলতেন। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে আপন চাচার মতোই। গরুর দুধ দোয়ানো আর লালন পালন ছিলো তার প্রধান কাজ। সে সুবাদে আমাদের ছাই রঙ্গের একটি গরুর সাথে তখন দিনরাত তার এতো সখ্য ছিলো যে, গরুটা যেন একসময় চাচার বন্ধু বনে গিয়েছিলো। হানিফ চাচা খুব আদর-যত্ন করে গরুটাকে পালতেন। দাদা সুবেদ আলী মীরের আবার দু’বেলা গরুর দুধ না হলে চলতোই না। তাও আবার তার খাঁটি দুধ চাই। সাথে লাগতো আড়াইহাজারের বড় বিনার চরের খাঁটি দানাদার আখের গুড়। দাদা ঐ গরুটা পালতেন খাঁটি দুধের আশায়। তিনি নিজে খাঁটি দুধ খেয়ে যেমন শান্তি পেতেন, আমাদের খাইয়েও তার যেন সুখের সীমা ছিলো না। সেই ৩৩/৩৪ বছর আগের কথা। হানিফ চাচা তখনই অশীতিপর বৃদ্ধ। গরু পালা ছাড়া তার আর কোনো কাজ করার ক্ষমতা ছিলো না।

চাচার একদিন সখ হলো বিমানে চড়ে যশোর যাবেন। তাও আবার নিজের টাকায়। বেতনের জমানো টাকা থেকেই চাচার সখ হলো মৃত্যুর আগে তিনি একবার বিমানে চড়বেন। সখের তোলা ৮০ টাকা বলে কথা। চাচার ইচ্ছায় বাধ সাধলো না কেউ। পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত হলো, চাচা বিমানে যাবেন, সাথে আমার বাবাও যাবেন তার সাথে। চাচা আর বাবা যথা সময়ে বিমানে উঠে বসলেন। বাগড়া দিলেন চাচা। ‘এত্তবড় বাড়িডা আকাশে উঠবো কেমনে? পইরা যাইবনাতো?’ দুরুদুরু চাচার বুক। ভয়ের মাঝেই বিমান আকাশে উড়লো। বিমানবালা সবাইকে যথাসময় নাস্তা দিলেন। ধবধবে টিস্যুটাই চাচার বেশি পছন্দের মনে হলো। টিস্যু হাতে নিয়ে চাচা আমার চুষতে লাগলেন। মজা পেলেন না। বাবা বুঝালেন, এটা খাবার জিনিস নয়। লজ্জা পেলেন চাচা। কাচুমুচু করে মুখ ঘুরালেন। মিনিট ৩০ পরে তাদের নামতে হলো বিমান থেকে। সেখান থেকে সোজা গেলেন আমার পিতার কর্মস্থলে। সাথেই তার কোয়ার্টার। তিনি তখন পাট গবেষণা ইনস্টিটউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। সেখানে দু-চার দিন থাকার পর বাসে চড়ে হানিফ চাচা আবার নারায়ণগঞ্জের বাড়ি ফিরলেন। গরু নিয়ে ফের মেতে উঠলেন। বছর খানেক বিমানের এই গল্প করতে করতেই চাচার সময় কেটে যেতো। এরপরও যেন গল্পের শেষ নেই। এ স্মৃতি নিয়েই বছর না গড়াতেই চাচা আমার একদিন দুনিয়া ছাড়লেন। মরহুম চাচার সখটাকে আমি অসম্মান জানাতে চাই না। কারণ বিমানে চড়ার সখ ছাড়া তাকে আর কখনো কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি করতে দেখিনি। তবে এ সমাজের অনেকেই আছেন, যারা সঙ্গতির সাথে চলতে চান না। আয় বুঝে ব্যয় করেন না। অন্যের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে নিজেকে নিঃশষ করে দেন। হাতে কিছু টাকা থাকলে খরচের বিষয়ে লাগামহীন হয়ে পড়েন। এটা ঠিক নয়। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে খরচের বিষয়ে লাগাম থাকা উচিত। তাই আমার দাদার মতো করে বলবো, ‘আয় বুঝে খরচ কর এবং সঞ্চয়ী হও’। ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হবে আপনাকেই। সময়ের সঠিক মূল্যায়ন করুন। আয় বুঝে ব্যয় কথাটা অনেক পুরানো হলেও ফেলনা নয়। তাই করুন, ভবিষ্যৎ ভালো হবে বলতে পারি।

এ লিখাটা লিখতে গিয়ে দাদার কথা খুব মনে পড়ছে। দাদা ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ছোট বেলায় দাদার সাথে এক বিছনায় দিনের পর দিন ঘুমিয়েছি। মৃত্যুর দিনেও ১২৩ বছর বয়সে তাঁর হাতে লাঠি থাকলেও তাতে ভর করতে দেখিনি; বিনে চশমায় পত্রিকা আর কোরান-হাদিসের বই অনর্গল পড়তে পারতেন। একটু কিপটে স্বভাবের ছিলেন। মিতব্যয়ী আর কি। আগের দিনের মানুষ যেমন ছিলো ঠিক তেমন। দাদা পাটের ব্যবসা করতেন। জমিজিরাত ভালোই ছিলো; গিরস্থি ছিলো ভরপুর। তখনকার সময়ে বেশ টাকাণ্ডকড়ি কামাই করলেও খরচ করতেন খুব হিসেব করে। বিনা কারণে কাউকে একটা টাকা বেশি দিতেন না। সব জায়গায় দরদাম করতেন। ঘুরে ঘুরে সদাইপাতি কিনতেন। মাঝে মঝে আমি তাঁর সাথে নিকটস্থ্ রূপগঞ্জের রূপসী বাজারে বাজার করতে যেতাম। আসার সময় অনেক অনুরোধ করতাম রিক্সা নেয়ার জন্য। দাদা নিতে চাইতেন না। বলতেন ‘জোরে জোরে হাঁট নাতি; ব্যায়াম হইবো।’ বলতেন- ‘ঠিক আছে, বাজারের ব্যাগটা না হয় আমারে দে’। আমি দিতে চাইতাম না। বড় ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে হেঁটে হেঁটেই বাড়ি আসতাম। মিতব্যয়ী হলেও দাদা আমাদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রচুর উপহার দিতেন। ভালো খাবার কিনতে এসব ব্যাপারে তাকে কিপটেমি করতে দেখিনি কখনো। খাবার দাবারের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। অতিথি আপ্যায়নে ছিলেন বেশ সচেতন। মানুষকে খাইয়ে মজা পেতেন। দাদার কাছে শিখেছি, স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ভালো ভালো খাবার খেতে হবে। দাদাও খাদ্য-খাবারের ব্যাপারে ছিলেন বেশ উদারহস্ত।

দাদা আমার কাছে ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ। খুব ধার্মিক ও সৎ লোক। পুরো এলাকার বিচার-আচার করতেন। চেয়ারম্যান মেম্বার না হলেও এলাকাবাসী তাকে বেশ সমীহ করতো। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘অপচয় করবি না কখনো’। তিনি খুব বেশি শিক্ষিত না হলেও মাঝে সাজে দু-একটা ইংরেজি বেশ শুদ্ধ ভাবেই বলতেন। দাদা প্রায়ই ইংরেজিতে বলতেন, ‘কাট ইউর কোট একোর্ডিং টু ইউর ক্লথ’। তার কণ্ঠে ইরেজি শব্দ শুনতে বেশ ভালোই লাগতো। তখন এই ইংরেজির বাংলা বুঝলেও ভাবার্থ আমার মাথায় ঢুকতো না। খুব ছোট ছিলামতো, তাই ভাবতাম, দর্জিদের কাজ আমরা করতে যাবো কেন? তাছাড়া শরীর মেপেইতো কোট বানাতে হবে, কাপড় অনুযায়ী কোট বানালে কি শরীরে আসবে? এখন বড় হয়েছি, দাদা কী বলতে চেয়েছেন তা বেশ বুঝি। ভাবি, দাদার মতো কি চলতে পারি?

“তুমি টাকা দিবা কই থাইক্কা”

আমার গ্রামের ছোট বেলার পল্লী চিকিৎসক। নাম 'টুকুন ডাক্তার'। তিনি এখন আর বেঁচে নেই। বছর ৪০ আগে মারা গেছেন। রাজধানী ঢাকার পাশে তখনকার সময়ের নিভৃত পল্লীতে বসেই চিকিৎসা সেবা দিতেন গ্রাম্য চিকিৎসক টুকুন ডাক্তার। তিনি সে সময়কার আমার গ্রামের একমাত্র ডাক্তার। চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা। অসম্ভব মেধাবী এই চিকিৎসকের চিকিৎসাপদ্ধতি ছিলো একটু ভিন্ন ধরনের। একেবারে সাদাসিধে জীবনযাপন ছিল তাঁর। শোয়ার ঘরটিও টিনের বাংলো ঘরের মতো ছিল। সামান্য সময় পেলেই বসে যেতেন পড়ার টেবিলে। বই সেই চিকিৎসা শাস্ত্রীয়। ডাক্তারির ওপর সংসার চলতো তার। গোটা গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করলেও তার অভাবের সংসারই ছিল। টুকুন ডাক্তার তার আসল নাম নয়। তবে এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলন। এ নামের ভিড়ে আসল নামটি যেন হারিয়ে গেছে কখন। যখন লিখছি, তখন আমার পিতার কাছে ছুটে যাই টুকুন ডাক্তারের আসল নাম জানতে। তিনিও বলতে পারলেন না। সরলভাবে বললেন, “নাম তো টুকুন ডাক্তারই।” পরে তার ছোট ছেলের কাছ থেকে জানা গেলো তার প্রকৃত নাম আবদুল আজিজ। চিকিৎসা করে সকলের কাছ থেকেই টাকা পয়সা নিতেন না তিনি। অভাবী মানুষদের বলতেন, “তুমি টাকা দিবা কই থাইক্কা।” তার সংসারের অভাবটাও বুঝতে দিতেন না রোগীদের। এই ছিলো আগেকার চিকিৎসকের মনোভাব। এখন বদলে গেছে সব। কোনো কোনো ডাক্তারকে তো এখন কসাই বলা হয়। এখনও টুকুন ডাত্তারের মতো মানবিক চিকৎসক অনেক আছেন, তবে সংখ্যায় তা খুব কম।

এখন চিকিৎসা সেবায় কী চলছে? টুকুন ডাক্তারদের মতো মানবিক চিকিৎসক কমে গেছে। সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন কোনো শেষ নেই। অনেক ক্লিনিকে তো রীতিমত অচিকিৎসকরাই রোগীদের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। অথচ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বড় বড় কর্মকর্তা যেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। দেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবস্থাতো আরও ভয়াবহ। রোগ পরীক্ষার নামে এদের বেশির ভাগই মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, রোগীদের প্রকারান্তরে হত্যা করছে। এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা অহরহ ঘটছে। কারণ বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রশিক্ষিত লোকজন বা টেকনিশিয়ান নেই বললেই চলে। পরীক্ষায় যেসব উপাদান ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা করা হয় না। আবার অনেকে খরচ কমাতে মেয়াদোত্তীর্ণ উপাদান ব্যবহার করে। দুটি হাসপাতালের মালিক হিসেবে দীর্ঘ ১৬ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেকেই হাসপাতালের বিধি নিষেধ মানেন না। এসব সেন্টারে আগে থেকে প্যাথলজির একজন অধ্যাপকের সই করা রেজাল্ট শীট থাকে, যা খুশি লিখে রোগীর স্বজনদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। আমরা জানি না, আর কতো নিচে নামবো আমরা? নীতি-নৈতিকতাহীন ব্যবসার কাছে মানুষ আর কতকাল অসহায় হয়ে থাকবে? আর কত নিষ্ঠুরতা আমাদের দেখতে হবে? রাষ্ট্রের কাছে আমরা এর প্রতিকার চাই। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে যেন ব্যবসার নামে লাগামহীন কর্মকাণ্ড না চলে, তার নিশ্চয়তা চাই।

যা বলছিলাম, ঢাকার পাশের রূপগঞ্জের রূপসী গ্রামের এই টুকুন ডাক্তারের উপরেই আমাদের গোটা গ্রামের চিকিৎসা সেবা নির্ভর ছিল। আমার ভাগ্নে এ হাই মিলন। বর্তমানে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। আমার বছর খানেকের ছোট হবেন তিনি। সেই ছোট বেলায় কাঁচা বাঁশ দিয়ে ভোঁ ভোঁ করে গাড়ি চালাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আমার থুতনিতেই বাঁশ লাগিয়ে দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে কেটে ঝুলে গেলো থুতনির মাংস। সবাই ধরাধরি করে ৬ বছর বয়সী আমাকে নিয়ে গেলেন টুকুন ডাক্তারের কাছে। একটু ডেটল, একটু ব্যান্ডেজ আর কয়েকটি ওষুধ নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বললেন- 'বাড়িত যাইয়া সাগু খাওগা, দুই চারদিন পরে সাইরা যাইবো।' তাণ্ডই হয়েছে। সেই আমারই বড় ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় সামান্য ব্যথা পেয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের কেবিনে ২২ দিন এবং পরে তিনি যে মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন সে মেডিকেল কলেজে ৩ মাস ভর্তি ছিলেন। সামান্য পায়ের আঘাতেই তার ৬ মাস লেগে গেছে সুস্থ হতে।

আসলে আমরা নিজেরাই যেন কেন দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়েছে। অবনতি হয়েছে আমাদের। আমাদের চিকিৎসকরা অনেকে দিনকে দিন জটিল হচ্ছেন, বাণিজ্যিক হচ্ছেন (তবে সবাই না)। ছোট বেলায় জ্বর হলে মা জোর করে সাগু খাইয়ে দিতেন। সাগু খাওয়ার ভয়েই দৌড়ে পালাত জ্বর। তা না হলে বড় জোর ডাকা হতো টুকুন ডাক্তারকে। তিনি যে দোকানে বসে চিকিৎসা দিতেন, তার আশপাশের পথঘাটগুলো মান্ধাতার আমলের ছিল। সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু কাদা। তখন ছিল না ওই গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। ভাঙ্গাচুরা রাস্তায় রাত বিরাতে অন্ধকারেই ছুটতেন টুকুন ডাক্তার। তিনি মিক্শ্চার কিংবা দু/একটা বড়ি খাইয়ে দিলেই জ্বর-জারি হাওয়ায় মিলাতো। আর হাঁচি কাশি তো তিনি তুড়ি দিয়েই সারিয়ে দিতেন। এখন আছেন কি সেই ভদ্র, সজ্জন, বিনয়ী, ত্যাগী ও মানব দরদী কোনো টুকুন ডাক্তার? এখনকার ডাক্তারগণ সেবা দেন না তা বলছি না। বললে যে আমার ঘাড়েই পড়বে বেশি। কারণ আমার পরিবারেই ডজন খানেক ডাক্তার আছেন। ডাক্তারগণ এখন বড্ড বেশি প্রফেশনাল, এটা আমাকে বলতেই হবে। হাসপাতালগুলো তো বটেই!

লেখক : মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়