বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

আমার মতো আর কতোজনের প্রিয় বাবাকে হারালে সড়ক নিরাপদ হবে?
অনলাইন ডেস্ক

আজ শনিবার (১৬ এপ্রিল) আমার বাবার ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে খতমে কুরআন, কবর জিয়ারত ও বাবা-মায়ের নামে নিজ বাড়িতে আনোয়ারা-মতিউর মহিলা মাদ্রাসায় সকাল ৮টায় কোরআন খতম ও মহিলা সাহাবাদের জীবনীর উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া চাঁদপুর পৌরসভার ১৫নং ওয়ার্ডের জিটি রোডস্থ আল-আমিন জামে মসজিদে তারাবিহ নামাজের পর বাবা-মায়ের মাগফেরাত কামনায় মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

বাবার মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর আমার ‘মা’ আনোয়ারা বেগম ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টায় রফিকে আলার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। তাঁদের মাগফেরাত কামনায় সকলের দোয়া চাই, আল্লাহ যেনো জান্নাত নসিব করেন।

১৯৯৫ সালের ১৬ এপ্রিল রোববার ৫০ বছর বয়সে মহান রাব্বুল আল-আমিনের ইচ্ছায় আমার শ্রদ্ধেয় বাবা মতিউর রহমান গাজী মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন মৎস্য বিভাগের জীপ চালক। ঘটনার দিন গাড়ি (ঢাকা মেট্রো চ-৮৬৫১) চালিয়ে তৎকালীন মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমানের কক্সবাজারে একটি অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহের জন্যে সাংবাদিকদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে চট্টগ্রামণ্ডকক্সবাজার মহাসড়কের কমল মুন্সিরহাটের নিকটবর্তী জলদিঘিতে একটি ট্রাককে পাশ কাটাতে গিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখী অপর একটি যাত্রীবাহী এস আলম (মিনি বাস)-এর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুর্ঘটনায় পতিত হন।

দুর্ঘটনায় জীপটির সম্মুখ অংশ বাসটির নিচে চাপা পড়ে এবং এতে ঘটনাস্থলেই জীপে আসীন মৎস্য বিভাগের গাড়ি চালক আমার বাবা মতিউর রহমান গাজী, বিটিভির উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ হুজ্জাতুল ইসলাম, সিনিয়র উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের ও চট্টগ্রাম তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি)-এর চিত্রসাংবাদিক চৌধুরী মনির হোসেন মকবুলসহ চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এছাড়া উক্ত দুর্ঘটনায় তৎকালীন মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমানের পিআরও মোস্তফা কামাল, বিটিভির ক্যামেরাম্যান মোহাম্মদ হোসেন, বিটিভির স্টাফ আব্দুর রহিম ও আবু তালেবসহ অন্যরা চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান। অর্থাৎ ওই গাড়িতে থাকা ৮ জনই শেষ পর্যন্ত মারা যান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা খুবই কম, যেখানে মন্ত্রীদের গাড়ি বহর দুর্ঘটনা কবলিত হয়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। ভাবতে বড় দুঃখ লাগে, প্রতিদিনই সড়কে তরতাজা প্রাণ ঝরছে। কিন্তু এতে দেশকর্তাদের কারোই টনক নড়ছে না। যে পরিবারের যিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে, সে পরিবারের কান্না আজও থামেনি। সড়ক নিরাপদের দাবিতে ১৯৯৩ সালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনকে হারিয়ে গঠন করেছিলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’। আমিও সেই দলের কর্মী হয়ে কাজ করছি। সে দাবির প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার ২০১৭ সালে ঘোষণা করেছেন ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। ‘নিরাপদ সড়ক’ নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এভাবে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার খবর টিভি ও পত্রিকাসহ সকল গণমাধ্যমে দেখা যায়। এহেন অবস্থায় আমার প্রশ্ন জাগে সংশ্লিষ্টদের কাছে, ‘আমার মতো আর কতজনের প্রিয়জন বাবাকে হারালে সড়ক নিরাপদ হবে?’

বাবার মৃত্যুর ২৭ বছর পার হয়ে গেলো। আমার ছোট বোন নাজলী আক্তার মুক্তা (৩২)। সে আমাদের বলে, ভাইয়া! বাবার চেহারা ভুলে গেছি। বাবার কোনো স্মৃতি আমার মনে পড়ে না। অপরদিকে আমার সন্তানরা আমাকে প্রশ্ন করে, বাবা ! আমাদের দাদা কই ? এ রকম প্রশ্নে মনে ভীষণ যন্ত্রণা বাড়ে, যন্ত্রণার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে আর নিরবে চোখের পানি পড়ে। এভাবে পঁচিশটি বছর বিধবা থেকে মা-ও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

ওই বছর ২০ এপ্রিল ছিলো এসএসসি পরীক্ষা। আমাদের তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে বড় বোন ও বড় ভাই ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। তাদের দুজনের মধ্যে বড় আপু চাঁদপুর মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আর বড় ভাই চাঁদপুর হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। আর বাবা ২২ মার্চ বাড়ি থেকে তাঁর কর্মস্থল চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় মাকে বলে গেলেন, আমি ওদের পরীক্ষার আগের দিন বাড়ি আসবো। আপু ও ভাইয়ার পরীক্ষার চার দিন পূর্বে বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। ‘কিন্তু বাবা তুমি বাড়ি আসবে বলে ফিরলে লাশ হয়ে’। তারা দুজনেই এ গভীর শোক নিয়ে ২০ এপ্রিলের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরিশেষে তারা দুজনেই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল তথা প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

যেভাবে মৃত্যুর খবরটি পরিবারে পৌঁছে : আমার বড় জেঠা চাকরি করেন চাঁদপুর নতুনবাজার যমুনা অয়েল কোম্পানিতে। বাবার মৃত্যুর দিন বড় জেঠা (আমার বাবার বড় ভাই) আবদুর রশিদ গাজীর অফিস ছুটি ছিলো। তিনি যে কোনো কারণে ওইদিন বিকেলে অফিসে পৌঁছলে তাঁর বস বলেন, আবদুর রশিদ, তোমার ছোট ভাই মতিউর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। তাকে চাঁদপুরে নিয়ে আসা হচ্ছে। জেঠা খবরটা শুনে আমার নানার বাড়িতে এসে আমাকে বলতেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। জেঠা এবং আমি দুজনেই নিজেদেরকে অনেক কষ্টে সামলিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসি। বাড়িতে আসতেই ‘মা’ আমাকে বললেন, তোর বাবা নাকি সড়ক দুর্ঘটনায় এক্সিডেন্ট করেছেন। মা এবং আমাদের ভাই-বোনদের কান্নায় বাড়ির পরিবেশটা স্তব্ধ হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পরেই আসলেন আমাদের বাড়ির আরেক জেঠা (আমার বাবার জেঠাতো ভাই) মোঃ শামসুল হক সামু গাজী। তখন সময় ছিলো বিকেল ৫টা ১০ মিনিট। তিনি এসে বললেন, বিটিভির সংবাদে বলা হয়েছে চট্টগ্রামণ্ডকক্সবাজার মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছে। ওই সময় আমাদেরকে অনেকেই বলতে থাকেন, বাবা মারা যাননি, তিনি আহত হয়েছেন। তারপর আমরা রাত দশটায় বিটিভির ইংরেজি সংবাদে নিশ্চিত হই বাবা আর বেঁচে নেই।

ঘটনার দিন ঘটনাস্থল থেকে নিহতের লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে আমার বাবা ও অন্যান্য লাশের অবস্থা এমন ছিলো যে, তাদের চেহারা চেনার উপায় ছিলো না। কেননা মর্গের পুরোটা ফ্লোর রক্তে সিক্ত ছিলো। সারিবদ্ধ লাশগুলো থেকে প্রত্যেকের আত্মীয়স্বজন লাশগুলো শনাক্ত করার জন্যে শরীরের বিভিন্ন চিহ্ন খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে আমার ভগ্নিপতি সুলতান আহমেদ ও ফুফাতো ভাই মোঃ শাহজাহান মিজি বাবার বুকের পশম ও হাতের আংটি দেখে লাশ শনাক্ত করেন। বাবার মৃতদেহ চাঁদপুরে নিয়ে আসতে চট্টগ্রাম মৎস্য অধিদপ্তরের সকল কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করলেন এবং তার মৃতদেহ রাত সাড়ে এগারোটায় চাঁদপুরে তথা আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেন। ওইদিন রাত সাড়ে বারোটায় নিজ বাড়ির উঠোনে জানাজার নামাজ শেষে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে বাবার লাশ দাফন করা হয়।

বাবার ইন্তেকালের কিছুদিন পর তৎকালীন মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান চাঁদপুরে আসলে আমাদের পরিবারের খোঁজখবর নেন এবং ওই সময় পরিবারের হাল ধরার জন্যে আমার বড় ভগ্নিপতিকে চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে চাকরি দেন।

আজ ভাবতে বড় কষ্ট হয়, বাবা! এই জগতে তুমি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু স্মৃতির মণিকোঠায় তোমার প্রাণচঞ্চল দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আজও তোমার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। তাই মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে তোমার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং সকল আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীর নিকট দোয়া কামনা করছি। আল্লাহ তোমাকে শহিদি মর্যাদা দান করেন এবং জান্নাতবাসী করেন। আমিন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়