বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

বৈশাখ আমাদের চেতনা নবায়নের উৎসব
অনলাইন ডেস্ক

উৎসবে প্রাণবন্ত বাঙালি। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি সেই কথা বলে। যে কোনো ক্ষুদ্র আয়োজন বা উপলক্ষকে উৎসবে রূপদান করতে বাঙালির জুড়ি নেই। উৎসব-অন্তপ্রাণ বাঙালির আর্থিক সামর্থ্যরে চেয়ে মানসিক সামর্থ্য অধিক। তাই সে নিমিষেই উৎসব আয়োজন করে ফেলতে পারে অন্তহীন উদ্যমে। গ্রামে গ্রামে বটতলায় বা বাজারের মোড়ে কিংবা ফসল ঘরে তোলার পর নাড়াঅলা ক্ষেতে, বাড়ির বড় আঙিনাতে রাত জেগে হ্যাজাক লাইটের আলোয় বাঙালি অতীতে মেতে উঠতো কবিগানের যাদুতে। আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ এসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতো কবিয়ালদের চাপান-উতোর। খুশি হয়ে পরিয়ে দিতো টাকার পুরস্কারের মালা। এভাবেই সামান্য বিষয়ও হয়ে উঠতো এলাহী কারবারের মতো। শ্রমজীবী মানুষের আত্মার বিনোদনই হয়ে উঠতো উৎসব। এ উৎসবের তালিকায় যেমন ছিলো যাত্রাপালার আয়োজন, তেমনি ছিলো হলকর্ষণ, বসুমতীর লোট কিংবা ধর্মীয় মেলা। আজও ধর্মীয় মেলার উৎসব পল্লি বাংলার সোঁদা মাটির বুকে মানুষকে একত্রিত করে মিলনমেলার বাণী নিয়ে। ওরশ কিংবা রথের মেলা, কীর্তন কিংবা রাস উৎসবের মেলা উৎসব-উন্মুখ বাঙালির মনে ধর্মের চেয়ে আনন্দের খোরাক নিয়ে আসে অধিক। সন্তান জন্মের পরে দোলনায় চড়ানোকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো উৎসব হয়ে যায় সামর্থ্যবান বাঙালির ঘরে ঘরে। নবজাতকের দোলনার নিচে মুড়ি-বাতাসা ছিটিয়ে দেয়া ও তা কুড়িয়ে খাওয়ায় কেবল অনুষ্ঠানের আচার পালিত হয় না, উৎসবের সুরও বেজে ওঠে। বিয়ে এ যুগে আর্থিক সামর্থ্যরে প্রদর্শনী হয়ে গেলেও আগে পল্লি বাংলায় বিয়ে ছিলো সত্যিকারের সামাজিক উৎসব। কোনো ঘরে বিয়ে নামা মানেই গ্রামের মানুষের সেই অনুষ্ঠান আয়োজনে কোমড় বেঁধে লাগা। সপ্তাহকাল আগে থেকে দূর-দূরান্তের গাঁয়ের নায়রী এসে জমিয়ে তুলতো বিয়ের আনন্দযজ্ঞকে। দুদিন আগে থেকেই মেয়েদের কণ্ঠে বিয়ের গীত বা হঁলা দারুণ জনপ্রিয় ছিলো গ্রামীণ বাংলায়। উৎসবের সেই আয়োজন এবং সেই উদ্‌যাপন আজ বিরল। কর্পোরেট জীবনের চাকচিক্য, বিপুল অর্থের ছড়াছড়ি উৎসবকে প্রাণের আঙিনা থেকে নিয়ে গেছে শোভা-প্রদর্শনের বাড়াবাড়িতে। উৎসবে আজকাল জাঁকজমক থাকলেও প্রাণ থাকে না, শেকড়ের গন্ধ থাকে না।

উৎসবে মাতোয়ারা বাঙালির সার্বজনীন উৎসবের মধ্যে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। এ উৎসব বনেদী মানুষের নয়, মূলত এ উৎসব মাটির মানুষের। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে এ উৎসবের আমেজ ও বর্ণিলতা ছড়িয়ে পড়ে। আবহমান কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ বাঙালিকে রঙে-রসে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। চৈত্র মাসের শেষের আগের দিন সন্ধ্যায় উঠোনে ‘জাগ’ নামের স্তূপীকৃত জঞ্জাল ও কাটা ঝোপে আগ বা আগুন দিয়ে পোড়ানো হতেই শুরু হয়ে যায় বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণের আনন্দণ্ডআয়োজন। তারও আগে বছরের শেষ ধূল-ঝুল ঝেড়ে বাড়িঘর পরিষ্কারের অভিযান চলে। চৈত্রের শেষদিনে গ্রামের ঘরে ঘরে মুড়ি-মুড়কি-খৈ-লাবনের উৎসব শুরু হয়। বানরের গিলা মেখে ¯œান অতীতের চৈত্র-সংক্রান্তিকে এখনও মনে করিয়ে দেয়। বিভিন্ন পদের উপকরণ মিলিয়ে তিতা খাওয়া বা পাঁচনের (পাজন) রান্না চৈত্রকে বিরস বদনে বিদায় দেয়ার এক নান্দনিক চর্চা। চৈত্রের শেষ সূর্যাস্তের সাথে সাথেই একটি বছরের ইতি হয়, ইতি হয় জীর্ণ পুরাতনের। নতুন আশা নিয়ে নতুন আলোয় নববর্ষের প্রথম ভোরে ঊষার অভিষেক হয়। সে অরুণে থাকে নতুন সম্ভাবনার দীপালি। বৈশাখের খরতাপে দগ্ধ হয়ে যেনো নতুন জীবনের পুণ্য¯œান হয়। আবার নতুন তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের পাঁচালির জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায় জীবনের রঙ্গমঞ্চ। দিনের ভোর হয় স্নানে পবিত্র হয়ে, নূতন পোশাকের সম্ভাবনায়। তারপর থাকে ঘোরাঘুরি আর দিনশেষে নিজের বাড়িতে বিশেষ আহার।

পহেলা বৈশাখের যাত্রাপথ কিন্তু কুসুমাস্তীর্ণ নয়। শুরু থেকেই একে হিন্দুয়ানী উৎসব বলে অবজ্ঞা করা হতো। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। তবু এর মাঝেই আমাদের শেকড়ের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জানা-অজানা ভুল ব্যাখ্যায় পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলেও কোনো অবস্থাতেই এর মান ও চেতনার ব্যত্যয় ঘটবে না। পহেলা বৈশাখ মিশে আছে আমাদের শোণিতে, স্বেদবিন্দুতে এবং জীবন-যাপনে। মানুষ অজ্ঞতাহেতু ধর্মকে সংস্কৃতির এবং বিজ্ঞানকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরে নিয়েছে। এর পরিণামে মারামারি-হানাহানিতে ব্যস্ত হয়ে মানবিকতাবোধ বিলীন হয়ে গেছে একদা সম্প্রীতির তীর্থভূমিখ্যাত বাংলাদেশে।

সাতাশটা নক্ষত্রের প্রভাবকে মাথায় রেখে তাদের বারটির নামে নামকরণ করা হয় বাংলা বারোমাসের। প্রথমটির নাম ছিল মার্গশীর্ষ বা মৃগশিরা। তারই নামে নাম হলো অগ্রহায়ণের আর এটাই ছিল আগেকার বাংলা বর্ষের প্রথম মাস। এরূপ নামকরণে আর্যভট্ট, বরাহমিহির প্রমুখ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ভূমিকা ছিল যা জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্তে লিপিবদ্ধ আছে। গ্রন্থটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে রচিত হয়। কিন্তু তার অনেক বছর পরে স¤্রাট আকবরের আমলে ষোলশ খ্রিস্টাব্দে প্রজাদের খাজনা আদায়ে অসুবিধা হলে তিনি তাঁর সভাসদ আবুল ফজল ও টোডর মলের বুদ্ধিতে আমির ফতেহ্উল্লাহ্ সিরাজীকে দায়িত্ব দেন, যাতে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে খাজনা আদায়ের মতো করে সংস্কার করা হয়। সেই মোতাবেক আমরা বৈশাখকে পাই নববর্ষের প্রথম মাস হিসেবে। অগ্রহায়ণকে সরিয়ে বৈশাখে এসে নববর্ষ নতুন ঠিকানা পায়। বাংলা বর্ষপঞ্জি সম্রাট আকবরের হাতে সৃজিত নয়, তিনি এর সংস্কার করেন মাত্র।

যদিও পহেলা বৈশাখ নতুন কোনো সূর্যের দিন নয়, তবুও নববর্ষ এক আবেগের নাম, চেতনার নাম। নববর্ষ কেবল পান্তা-ভর্তা খাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, নববর্ষ তার চেয়েও বেশি কিছু। নববর্ষ আমাদের শেকড়, নববর্ষ আমাদের ঐতিহ্য। নববর্ষ কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়, নয় কোনো সাম্প্রদায়িক চর্চা। নববর্ষ মানেই শাশ্বত বাঙালিয়ানার মহামিলন। বিশ্বমানব হওয়ার তত্ত্ব আমাদের নববর্ষই দিয়ে যায় উৎসবের সার্বজনীনতায়। আজকাল বাঙালির নববর্ষের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ শোভাযাত্রার মাধ্যমেই শেকড়ের সংস্কৃতিকে আধুনিক মানুষের মনের সরোবরে পৌঁছে দেয়া যায়। শোভাযাত্রার বর্ণিলতায় ধনী-গরিব সবাই সমান হয়ে যায়। বাংলার প্রকৃতি যেনো শোভাযাত্রায় শামিল হয়। বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে দোলা দিয়ে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় আমাদের চিরায়ত সৌন্দর্যকে ধারণ করে। নববর্ষের উদ্‌যাপনের সাথে ধর্মের যেমন বিরোধ নেই তেমনি যারা সংস্কৃতির চর্চায় ধর্মীয় বিধিনিষেধকে টেনে আনেন তারাও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা হতে তা করে থাকেন। আমণ্ডবাঙালির আবেগে নববর্ষকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গত দু বছর বিশ্বমারি বা অতিমারির কারণে আমাদের উল্লাসে বাধা এলেও এবার আমরা করোনাকে মোটামুটি বাগে আনতে পেরেছি। আমরা এ বছর পবিত্র রমজানে নববর্ষকে পেয়েছি। রোজার পবিত্রতা আর নববর্ষের উৎসব আমাদের আনন্দকে দ্বিগুণ করে তুলেছে। ধর্ম যার যার উৎসব যেমন সবার তেমনি আমরা সবাই হিন্দু-মুসলিমণ্ডবৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাঙালি। কাজেই এবারের বৈশাখ আমাদের ঐক্যের বৈশাখ, এবারের বৈশাখ আমাদের চেতনার নবায়নের বৈশাখ। বৈশাখ আমাদের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা মুক্তির শক্তি দিক, সাহস দিক। বৈশাখ আমাদের সহাবস্থান ও সম্প্রীতির দীক্ষা দিক। এবারের বৈশাখ হোক প্রাণে প্রাণে মিল করে দেয়ার বৈশাখ। এবারের বৈশাখ জরামুক্তির বৈশাখ, এবারের বৈশাখ হোক মুক্তবুদ্ধির বিজয়ের বৈশাখ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়