প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২২, ০০:০০
স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচতে চায়। তবে স্বাধীনতা লাভ করা কোনো সহজ বিষয় নয়। বিশ্বের আদিকাল থেকে দুর্বলদের পরাধীন করে নিজের সুনাম, প্রতিপত্তি ও সম্পদ বৃদ্ধির নগ্ন ইতিহাস ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। জেনেভায় জন্ম নেয়া অষ্টাদশ শতকের রাজনৈতিক দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো তাঁর জগতখ্যাত সামাজিক চুক্তি দর্শনে বলেছেন, ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত।’ আর এই শৃঙ্খলিত জীবনের যাতনার কথা ফুটে উঠেছে কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা হীনতায়’ কবিতায়। কবির মতে, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কেও বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃংখলা কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়? কোটি কল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে, নরকের প্রায়, দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ সুখ তায় হে স্বর্গ সুখ তায়।’ একসময় ব্যক্তির স্বাধীনতাও হরণ করে দাসপ্রথা চালু হয়। এরপর সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা হরণ করে চলে উপনিবেশিকতার শৃঙ্খল। তবে সেই উপনিবেশিকতার খোলস ভেঙ্গে স্বাধীনতা লাভের জন্যে বহু জাতিকে বেছে নিতে হয়েছে সংগ্রামের পথ। যদিও আলোচনা ও পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কিংবা নিজ দেশে গণআন্দোলনের মুখে কিছু দেশ স্বাধীন হয়েছে কিংবা রাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে বা স্বাধীনতায় ফিরেছে, তবে সেই তুলনায় যুদ্ধ করে তথা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের সংখ্যা একেবারেই কম নয়। যার অন্যতম স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার জন্যে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস বেশ পুরানো। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭, এই ১৯০ বছর বাংলাদেশের ভূখ- বৃটিশদের অধীনে ছিল। ধাপে ধাপে পরিচালিত বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে এ দেশের মানুষও অংশ নেয় এবং আত্মাহুতি দেয়। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে ও ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি দেশ জন্ম নেয়। প্রায় ১২০০ মাইল ভৌগলিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে তৎকালীন ইস্ট-পাকিস্তান নাম ধারণ করে পশ্চিম-পাকিস্তানের অংশ হতে হয়। শুরু থেকে পশ্চিম-পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তানের উপর প্রভুসুলভ আচরণ করে। যা চলে প্রায় ২৪ বছর (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১)। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম-পাকিস্তানের কুচক্রি রাজনীতিবিদ ও সামরিক জান্তারা সমগ্র পাকিস্তান দূরে থাক; শুধু পূর্ব-পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) শাসন বাঙালিদের হাতে ছাড়তে রাজি ছিল না। এমনকি বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগে পাশে দাঁড়ানোর মতো নজরও ছিল না পশ্চিমাদের। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বলতে গেলে মূলত এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে প্রকাশ্যে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় শক্তিশালী বাহিনী নামধারী পাকিস্তানিরা। তত দিনে প্রাণ হারায় প্রায় ৩০ লক্ষ বাঙালি, সম্ভ্রম হারায় প্রায় ২ লক্ষ নারী, হারিয়ে যায় বহু বুদ্ধিজীবী এবং ধ্বংস হয় দেশের অনেক অবকাঠামো। সেই শূন্য থেকে যাত্রা করা বাংলাদেশ ৫১ বছরের মাথায় আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল এবং মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে।
আর সেই ৫১ বছর আগের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিকে যদি তাকাই তবে দেখি পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতায় বাঙালি নামধারী যেসব পদলেহী এগিয়ে গিয়েছিল, পুরো ৯ মাস তারাও এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান শুধু নেয়নি, হত্যা, খুন-ধর্ষণ-লুট, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের কাজও করেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন বাহিনী ও সশস্ত্র সংগঠন। শান্তি কমিটি, আল-বদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী এবং রাজাকারের নামে জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পিডিপি, কেএমপি, মুসলিম লীগের দুটি গ্রুপসহ ইসলামপন্থি নামধারী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সহায়ক শক্তি হিসেবে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়। মানুষ হত্যা, লুটপাট, তা-ব, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ সবই চালিয়েছে তারা হানাদারদের সহযোগী হিসেবে। মুক্তিবাহিনীর সদস্য যত না সম্মুখসমরে শহীদ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় রাজাকাররা নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা মানেই দুষ্কৃতকারী, ভারতীয় চর প্রভৃতি। হিটলারের ইহুদি জাতি নিধনের মতো এরা বাঙালি হত্যার নারকীয় তা-বে মেতেছিল এই বলে যে, তারা এ দেশের মানুষ চায় না চায় মাটি। তাই গ্রহণ করেছিল ‘পোড়া মাটি’ নীতি। এই রাজাকার, আলবদররা সহযোগিতা না করলে পাকিস্তানি হানাদাররা আরও আগেই দেশ ছেড়ে যেত বা আত্মসমর্পণ করত এবং এত প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হতো না। এ বিশ্বাসঘাতক নরাধমরা বাঙালি নামের কলঙ্ক। ধর্মের নামে অধর্ম তাদের তখন একমাত্র বাঙালি নিধন।
আজকের প্রজন্মও এ বর্বরদের ক্ষমা করেনি, করতে পারেও না। তারা মনে করে ৩০ লাখ বাঙালির আত্মদান আর দু লাখের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত দেশে পরাজিত শক্তির অপতৎপরতা বন্ধ করা যায়নি। ১৯৭১-এ সালে বাঙালি জাতি চিহ্নিত করতে পেরেছিল কে তার শত্রু, কে তার মিত্র। কিন্তু সেই শত্রুকে অনেকটা নিশ্চিহ্ন করতে পারলেও কিছুটা নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। আর তা হয়নি বলেই আজ এত বছর পরও সেই শত্রু নিধন প্রসঙ্গটি বাস্তব ও আবশ্যকতা বহন করে। আজকের প্রজন্মের পূর্বসূরিরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে যে দেশ হানাদার ও দখলদারমুক্ত করেছে, যে পতাকা এনেছে, সেসব ক্রমশ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্য কিংবা ব্যর্থতা আমাদেরই যে, নরঘাতকরা বেশ কিছুদিন বসেছিল ক্ষমতার সিংহাসনে, এই বাংলাদেশে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের ১৯৫ জন কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা ও সরকারি কর্মকর্তা রেসকোর্স ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল। অপরদিকে পাকিস্তানে আটকে পড়া চার লাখ বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে আনার কাজটিও গুরুত্ববহ হয়ে উঠে। তাদের পরিবারের সদস্যরা বঙ্গবন্ধু সরকারের উপর চাপ প্রয়োগে অনশন কর্মসূচিও নেয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী এদেশীয় দোসরদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত আটটি আদেশের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। বিচার কার্যক্রমও চলছিল। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল বিশেষ ট্রাইব্যুনালস আদেশে তিনটি সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে এ আইনের অধীনে ৩৭ হাজার ৪৯১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। দ্রুত বিচারের প্রয়াসে বঙ্গবন্ধু সরকার ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার মধ্যে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দু হাজার ৮৪৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত হয়েছিল। দু হাজার ৯৬ জন ছাড়া পায়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ মেলেনি তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে সাধারণ ক্ষমার প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, ‘র্ধষণ, খুন কিংবা খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজে অগ্নিসংযোগের দায়ে দ-িত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।’ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি এসব অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। এরূপ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শে লালিত উচ্চাক্সিক্ষত বিপথগামী বাঙালি সেনাদের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে পাকিস্তানি ভাবধারার প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দৃশ্যপটে আবর্ভিূত হয়, তাদের হাতেই উত্থান ঘটে একাত্তরের পরাজিত শক্তির এবং সাম্প্রদায়িকতার। ক্রমশ তা সমাজের নান ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে।
যুদ্ধোত্তর (১৯৭৪ সাল) বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ চলছে। দেশে খাদ্য সংকট। আবার রপ্তানি বাড়ানো জরুরি। এ রকম উভয় সকংটের মধ্যেই পিএল-৪৮০ এর চুক্তির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গম সহায়তা বন্ধ করে দেয়। এবং খাদ্যাভাব সৃষ্টি হলো। পিল-৪৮০ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্য সহায়তা চুক্তি। কিন্তু খাদ্য সহায়তার মতো মানবিক কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্র এভাবে হুট করে বন্ধ করে দেবে তা সদ্যস্বাধীন একটি দেশ স্বপ্নেও ভাবেনি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কাজটি করেছিল সে সময়। যুক্তরাষ্ট্রের ঐ ভূমিকার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারকে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। ১৯৭৪-এ খাদ্য ঘাটটিকে দুর্ভিক্ষের মোড়ক দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৪-এর কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিল মার্কিন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির নানা ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সোজাসাপ্টা ও স্পষ্ট যা বঙ্গবন্ধু নির্ধারণ করে দিয়েছেন-সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়। কিন্তু কারো সাথে বৈরিতা না করলে কী হবে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় বৈরিতার শিকার হয়েছে। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন বাংলাদেশবিরোধিতা করেছে তা সবারই জানা। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারী দেশগুলো ১৯৭৫ পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অসহযোগিতা করেছে। ১৯৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি অনেক রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ মানবাধিকারের কথা বলে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তখন কেন যুক্তরাষ্ট্র নীরব ছিল? গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ। তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করল সেনাবাহিনীর কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল বিপথগামী সদস্য। তাদের উপর কি কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল? হয়নি। এসব খুনের বিচার হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দ-িত ঘোষিত ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে বলে খবর পাওয়া যায়। কোথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার, কোথায় নিষেধাজ্ঞা?
মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের পাশাপাশি যেসব দেশ বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রেখেছিল তার বেশির ভাগই সমাজতান্ত্রিক দেশ। আর সমাজতান্ত্রিক দেশের আদলে সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- যে শুধু দেশি ষড়যন্ত্র তা নয়, এর সাথে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও বৈশ্বিক রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা সকলেরই ধারণা।
১৯৭১-এর পরাজিত পাকিস্তান আদর্শের অপশক্তির যে উত্থান ঘটেছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং ৭ নভেম্বর মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান হাতছাড়া হওয়ার মাধ্যমে। সে অপশক্তি কিছুটা কোণঠাঁসা হয়েছে ২০০৫ সালে গঠিত ১৪-দলের ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গি অপশক্তি তাদের গণতন্ত্রবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা থেকে থেমে থাকেনি; এরা একের পর এক নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে ১৪ দলের সরকার তথা মহাজোটের সরকার উৎখাতের অপপ্রয়াস চালাতে থাকে। এই অপশক্তি তথা স্বাধীনতাবিরোধীরা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বিচার-বিরোধিতার নাম করে ২০০৯ সালের পর থেকে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করা এবং এ অপশক্তির জোট পরে দেশজ মৌলবাদী ও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে তাদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে, পরে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অপরোধকে কেন্দ্র করে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনাও করে। এ অপশক্তির আরও সংযোজন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপপ্রয়াস। অপ্রিয় সত্য এরা প্রকৃত আলেম-ওলামা-পীর বা ধর্মপ্রচারকারী কিংবা ধর্মীয় চিন্তাবিদ নয়, বরং এরা প্রায় প্রত্যেকে কোনো না কোন রাজনৈতিক দলের নেতা। এরা নির্বাচন করে, ভোটে দাঁড়ায়, এদের নির্বাচনী মার্কা-প্রতীক আছে। এরা ধর্ম ও রাজনীতিকে মিশিয়ে ধর্মকে নিজের মত করে ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের রাজনীতি করে, এরা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের রাজনীতি করে দেশে অশান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে ফয়দা নিতে চেষ্টা করে।
স্বাধীন দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ওরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এদের ভাস্কর্য-বিরোধীতা হলো বঙ্গবন্ধুর বিরোধীতা, বাংলাদেশের বিরোধীতা, বাঙালিয়ানার বিরোধীতা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা এবং সংবিধানের বিরোধীতা। ১৯৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এরা যেমন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তেমনি ৭ নভেম্বর মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয় ছিনিয়ে নেয়। ফলে বাংলাদেশে প্রগতির চাকা পিছন দিকে ঘুরতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ বন্ধ হয়ে পরে।
কাজেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে তথা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে শপথ নিতে হবে ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে সতর্ক থাকতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই অব্যাহত রেখে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধি-সুশাসন-সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার : সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।