প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
প্রাণী মাত্রই সন্তান লালন পালন করে প্রকৃতির কাছে সমর্পণ করে। শুধু মানুষই সন্তান লালন পালন শেষে সন্তানের কাছে প্রত্যাশা করে। সেই প্রত্যাশা হলো সন্তান পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে কল্যাণকর ভূমিকা পালন করবে। সন্তানের সাফল্য ব্যক্তিকে সম্মান মর্যাদায় আসীন করে।
বেশিরভাগ প্রবীণ প্রত্যাশা করে শেষ বয়সে সন্তানের সান্নিধ্যে সেবা-যতেœ জীবন কাটাতে। নানা কারণে অনেকেরই সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না। তৈরি হয় হতাশা, বিষণ্ণতা, নিঃসঙ্গতা আর অভিযোগ, নালিশ করার প্রবণতা।
ব্যক্তি সন্তানের সাফল্য কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের ভূমিকা কে প্রধান করে দেখতে চায়। সন্তান যত বেশি অর্থ বিত্তে, ক্ষমতায়, শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে যায় ততবেশি ব্যক্তি আত্মতুষ্টিতে ভোগে। ভুলতে বসে বড় হবার ক্ষেত্রে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা। সমাজের সম্পদ, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার প্রেরণা লাভ করে। সমাজের অবদান কে উপেক্ষা করে সহায় সম্পদ ব্যক্তির তীব্র আকাক্সক্ষা সমাজে ক্ষতের সৃষ্টি করে। কোন মানুষের পক্ষেই সমাজের ভূমিকা উপেক্ষা করে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অথচ ব্যক্তি সমাজের ঋণ পরিশোধ করে সমাজ কে আরো বেশি সমৃদ্ধ করার প্রেরণা লাভ করতে আগ্রহী হতে চান না। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার প্রেরণা মানুষকে সমাজ বিচ্ছিন্ন হতে সহায়তা করে। কাউকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এটা কম-বেশি সবাই বুঝতে পারে। তবুও পেছনে ফেলার প্রবণতা কমছে না।
ব্যক্তির সম্পদ অর্জনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি নিজে, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা বংশানুক্রমিকভাবে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
ব্যক্তি নিজে প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। প্রবীণ শারীরিক, সামাজিক, আবেগিক, বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা পূরণ করতে সচেষ্ট হন। শারীরিক চাহিদাগুলো হলো ভাত, কাপড়, আশ্রয়, চিকিৎসা। এগুলো পূরণে ব্যক্তি নিজে বা সন্তানরা ভূমিকা পালন করে। বাকি চাহিদা পূরণ করতে খুব কম মানুষই পারে।
দীর্ঘ সময় ধরে আমরা মনে করেছি প্রবীণের দেখভাল সেবা যত্ন সন্তান করবে। একসময় গড় আয়ু কম থাকায় প্রবীণের সংখ্যা কম ছিল। যৌথ পরিবারের সম্মিলিত সহযোগিতায় প্রবীণ জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল।
বর্তমানে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। গার্মেন্টস্সহ বিভিন্ন কল-কারখানায় কোটিখানেক শ্রমিক কাজ করে, যাদের পরিবার পরিজন গ্রামে থাকে। সামর্থ্যবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যায়। বেশিরভাগই আর দেশে ফিরে আসে না। যেসব ছেলেমেয়ে পরিবারের সাথে থাকে তারাও চাকরি বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য, ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। কৃষি কাজে নিয়োজিত বিপুল সংখ্যক মানুষ উদয় অস্ত পরিশ্রমে কর্ম ক্লান্ত।
ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতে প্রবীণের সেবা যত্ন দেখভালের দায়িত্ব সন্তানের ওপর দেয়া কতখানি যৌক্তিক এবং ন্যায় সঙ্গত তা ভাবনার সময় এসেছে।
যে মানুষটি আজ প্রবীণ হয়েছেন তিনি একদা নবীন ছিলেন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে যথাসাধ্য ভূমিকা রেখেছেন। আজ প্রবীণ জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে শুধু সন্তানের সহায়তা যথেষ্ট নয়। সন্তানকে শাস্তির ভয় দেখিয়ে সংকট মোকাবিলা করা অনেক কঠিন।
ফলে আজকে যারা তরুণ, কর্মক্ষেত্রে আছেন তাদেরকে স্বস্তিদায়ক কর্মক্ষম প্রবীণ জীবনের জন্য কাজ করতে হবে। গ্রামে গঞ্জে, শহর বন্দরে প্রবীণ সেবার সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রবীণ জীবনকে সহজতর করতে হবে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবীণের তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবার ব্যবস্থা করবে। সক্ষম প্রবীণরা সামাজিক সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকলে সবচেয়ে বেশি ভালো হতো, কিন্তু প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর। তাদের জন্য অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ সফলতা অর্জন করতে পারে না।
অনেকেই মনে করেন বৃদ্ধাশ্রম, প্রবীণ নিবাস, প্রবীণ হোস্টেল নির্মাণ করে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলে প্রবীণরা সুখি হবেন, শান্তিতে থাকবেন। কথাটা আংশিক সত্যি।
প্রবীণদের শারীরিক চাহিদা পূরণ করাই যথেষ্ট নয়। তার আবেগিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, স্রষ্টাকেন্দ্রিক চাহিদা রয়েছে।
এসব চাহিদা পূরণ না হলে প্রবীণ সংকটে পড়বে। একজন প্রবীণ ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবের সাহচর্য আশা করে। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চায়। কথা বলতে চায়। অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনার সাথে পরিচিত হতে চায়। সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করে।
মনে রাখতে হবে মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক সকল কর্মকা-ে যুক্ত থেকে প্রবীণ জীবন কাটাতে চায়। জীবনকে রাঙাতে চায়। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে চায়। এগুলো সুযোগ নয় অধিকার।
অনেক যোগ্যতা, দক্ষতা সম্পন্ন প্রবীণ রয়েছেন যারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ স্বাভাবিক। তাদের উপযুক্ত কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। ধর্মীয় কাজ কর্মে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রবীণ পারলৌকিক শান্তির আশা করে। উপরোক্ত চাহিদাগুলো পূরণে সন্তানের ওপর ভরসা রাখলে চলবে না। গড়ে তুলতে হবে অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যেখান থেকে প্রবীণরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবা কর্মীর সেবা পাবে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়ার এবং সার্বক্ষণিক সেবার জন্য লোক পাবে। নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তির জন্য কথা বলার লোক পাবে। গান বাজনা, সিনেমা হলে, নাটকে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাবার সঙ্গী পাবে। পছন্দের জায়গায় বেড়ানোর সুযোগ পাবে। হাট-বাজারে কেনাকাটায় দক্ষ সঙ্গী পাবে।
এসব সেবা পেতে অবশ্যই টাকা খরচ করতে হবে। যারা সামর্থ্যবান তারা সেবা কিনে নিবেন। যাদের সেবা মূল্য পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই তাদের সেবা মূল্য স্থানীয় সরকার অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিশোধ করবে।
আমাদের সন্তান নির্ভর প্রবীণ জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সময় এসে গেছে। প্রবীণ জীবন হবে সমাজ নির্ভর। প্রবীণের সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে, শক্তিশালী করে প্রবীণ জীবনকে অর্থবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ করা সম্ভব।
লেখক : প্রবীণ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।