প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
নির্বাচন ছিল প্রাচীন গ্রিসীয় শাসন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এবং সেখানে সাধারণত লটারির মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন হতো। আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে গঠিত রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের ফলে ঐতিহ্যগত নির্বাচন পদ্ধতির রূপান্তর ঘটেছে। নির্বাচন এখন গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সবচেয়ে প্রাচীন ও শক্তিশালী একটি ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদ। জনপ্রতিনিধিত্ব শব্দটির বাস্তব প্রয়োগের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ প্রকৃত অর্থে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খুব কাছের একটি প্রতিষ্ঠান। ১৮৮৫ সালের আইনবলে জেলা বোর্ড, লোকাল বোর্ড, ইউনিয়ন বোর্ড ইত্যাদি গঠন করা শুরু। তারপর আইনটি অনেকবার সংশোধিত হয়ে স্থানীয় সরকার কাঠামোর বর্তমান রূপ নিয়েছে। আজকের দিনে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বারদের যতই আমরা গালমন্দ করি না কেন, তারপরও সরকারের কোনো দপ্তরে দরকারি যোগাযোগের জন্য প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ প্রথম তাদের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বারদের শরণাপন্ন হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা বিবেচনা করে ইউনিয়ন পরিষদকে জনসম্পৃক্ত একটি প্রতিষ্ঠান বলতে হয় অবশ্যই। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচন থেকেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকে একটু বেশি।
বিগত দিনে আলোচনার কেন্দ্রে থাকত জাতীয় নির্বাচন। তা হোক সামরিক শাসকদের অনাসৃষ্টি ‘হ্যাঁ-না ভোট’, জাতীয় সংসদ কিংবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। কেবল সামরিক শাসকদের আমল নয়, ১৯৭৩ থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো জাতীয় নির্বাচন হয়েছে তার কদাচিৎ দু-একটি ছাড়া সবক’টির রয়েছে কলঙ্কের ছাপ। কলঙ্কের মাত্রাভেদ রয়েছে মাত্র। আর এ কলঙ্কের গ্রাস জাতীয় থেকে স্থানীয় নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে উদ্বেগজনক মাত্রায়। যা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন দলের নেতা, মন্ত্রী মহোদয়ের উচ্চারণ ও অবাঞ্ছিত নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কলঙ্কের ছোঁয়া কোন্ মাত্রায় পৌঁছেছে তার কিছুটা চিত্র মেলে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ মুরাদ হাসানের বক্তৃতার বাক্যচয়নে। তাঁর বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তিনি বলেছেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে যা হচ্ছে তা কাম্য নয়। আমাদের আরও সহনশীল হওয়া উচিত।’ ১১ নভেম্বর সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ মন্তব্য করেছেন তাঁর অফিসকক্ষে।
স্থানীয় নির্বাচনে সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য কেউ কেউ চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। অবশ্য এ নিয়ে জোরালো মত-দ্বিমত উভয়ই আছে। সঙ্গে এও স্পষ্ট যে, প্রতীকবরাদ্দ সংঘাতের মূল কারণ না হলেও মাত্রাতিরিক্ত সন্ত্রাস তো হয়েছে এবং এর কারণও আছে। স্বতঃসিদ্ধ কথা, কারণ ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটে না। এদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী মহোদয় বিষয়টি একটু পরিষ্কার করেছেন ১২ নভেম্বরের বক্তব্যে। মন্ত্রী বলেছেন, ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে স্বতঃস্ফূর্ত ও উৎসবমুখর পরিবেশে দ্বিতীয় দফায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হতাহতের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। (বাংলাদেশ প্রতিদিন ১ ডিসেম্বর ’২১)।
ইউপি নির্বাচনের যতগুলো ধাপ অতিবাহিত হলো তার প্রত্যেক ধাপেই সন্ত্রাসী, মাদক-কারবারি, মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে রাজাকার পরিবারের সদস্য, হত্যা-ধর্ষণ মামলার আসামীসহ চিহ্নিত-বিতর্কিতদের দাপট। আওয়ামী লীগের দপ্তরে এ বিষয়ক অভিযোগের স্তূপের কথা জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদকও। কেন্দ্র থেকে দায়ী করা হচ্ছে, এমপি, জেলা-উপজেলা নেতাদের। তারা দূষছেন কেন্দ্রকে। এমনিতর অবস্থায় এ নির্বাচনে দলের কথিত বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বেকায়দায় পড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রথমতঃ এসব কথিত বিদ্রোহীকে কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নি, যাচ্ছে না। দ্বিতীয়তঃ এসব বিদ্রোহীর কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে গেছেন দল থেকে মনোনীত অনেক প্রার্থী। নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রাণ গেছে অনেকের। তৃণমূলে বিরোধ ধূমায়িত হচ্ছে। এদিকে দল থেকে বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের সুপারিশের স্তুপ জমেছে কেন্দ্রে। আবার এ তালিকায় নাম আছে অনেক ত্যাগী নেতারও। ফলে এখন কুল-রাখি না শ্যাম-রাখি অবস্থায় আছে টানা এক যুগের বেশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে আওয়ামী লীগ ঘরানার প্রার্থীর সংখ্যা বেশি এবং ক্রমবর্ধমান। যা থামানো যাচ্ছে না বহিষ্কারেও।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বহিষ্কার হুঁশিয়ারিকে তেমন আমলে নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। মনে রাখা দরকার, ইউনিয়ন পর্যায়ে বহিষ্কৃত দলীয় ব্যক্তিটির ক্ষতির তেমন কিছুই নেই। বরং আওয়ামী লীগের ক্ষতি হওয়ার অনেক সম্ভাবনার কিছু আছে। বিশেষ করে আগামী সংসদ নির্বাচনের বাস্তবতায় বহিষ্কার করার ক্ষমতার দম্ভে না থাকলে কেন্দ্রীয় নেতারা হয়তো উপলব্ধি করতে পারতেন দলীয় মনোনয়নের বাইরে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত বা পরাজিত যা-ই হোক, তারা নিজ নিজ এলাকায় ফ্যাক্টর। তাদের জনভিত্তি আছে। আর তৃণমূলের এই নেতাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে উপজেলা-জেলা ও কেন্দ্র। কাজেই আওয়ামী লীগের ভাবনার মূল ফোকাস হওয়া দরকার মনোনয়ন প্রক্রিয়া কতটা সঠিক ও স্বচ্ছ। যেখানে সংসদ নির্বাচনেই বিভিন্ন দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে, সেখানে স্থানীয় নির্বাচনে এ অনৈতিক আশঙ্কা কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? মনে রাখা প্রয়োজন, রাজনীতি আগের মতো আর কেবল জনসেবা ও দেশপ্রেম ব্রাকেটে নেই অনেকের ক্ষেত্রেই। রাজনীতিও এখন এক ধরনের অঘোষিত বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে ছোট নেতা অনেক সময় বড় নেতার চোখে ‘আয়ের পুত্র-ধন’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আর নির্বাচনের সময় তো অনেক ক্ষেত্রে কর্তা-নেতার ‘মুরগি’ হিসেবে বিবেচিত হন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
উল্লেখ্য এবং বলা বাহুল্য, তৃণমূলের নিবেদিত অনেক নেতা মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে এবার তকমা পেয়েছেন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর। আসলে এরা মোটেই বিদ্রোহী নন, এরা বিক্ষুব্ধ প্রার্থী। সংশ্লিষ্টদের মতে, মনোনয়ন প্রক্রিয়া বর্তমান ধারায় চলতে থাকলে তৃণমূল আওয়ামী লীগের অসন্তুষ্ট প্রার্থী এবং নেতা-কর্মীর সংখ্যা বাড়বে জ্যামিতিক হারে। যেহেতু এ নির্বাচনে বিরোধীপক্ষ তথা বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নেই। তাই বাস্তবে দেখা যায় এবং না বললেই নয়, ক্ষমতাসীন দলের নমিনিশন পাওয়াই নির্বাচন। ভোটের দরকার নেই। জনগণের কাছে যাওয়ার পর্বই ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে। সেহেতু যৌক্তিক ও তৃণমূল নেতৃত্বের কাক্সিক্ষত প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন দেওয়া কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচিত ছিল এবং উচিত। উল্লেখ্য, ক্ষমতার মসনদ নির্ধারণী জাতীয় সংসদ নির্বাচন খুব বেশি দূরে নয়, এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আরও বলতে হয়, ১৯৭০- এ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তদানীস্তন আওয়ামীলীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে যে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেছিল, তখন থেকেই এদেশের মানুষের কাছে আওয়ামীলীগ আর নৌকা প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। সেই নৌকার আজকের এ গুরুচরণ অবস্থা কেবলই সরকারি দলের জেলা-উপজেলায় নেতা-এমপি এমনকি মন্ত্রীর অভ্যন্তরীণ কোন্দল-বিদ্রোহের ফল নাকি আগে-পিছে আরো কিছু আছে? সময়ের সঙ্গে নৌকার উজানে ভাটার টান ফেলার কোনো কারসাজি নেই তো?
শেষতক ভাবতে হবে, দুনিয়ার অগ্রসর গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় অনেক ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের সুযোগ থাকলেও গণতন্ত্রচর্চার বিচারে আমরা অগ্রসর দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। এ সত্য মনে রেখে স্থানীয় নির্বাচনে সমাজের সুশিক্ষিত চরিত্রবান ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাক্সিক্ষত গ্রহণযোগ্য নমিনিশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা সমীচীন।
অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা ও রাজনীতিবিশ্লেষক।