সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২১, ০০:০০

বিম্বিত বীক্ষণ
অনলাইন ডেস্ক

পর্ব-১৮

সরকারি কলেজগুলোতে বিসিএস দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু বেসরকারি-স্কুল কলেজগুলোতে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া তাতে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দুরূহ হয়ে উঠে। ঐ সময়টাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার প্রয়োজনের চেয়ে চাকুরির প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যত্রতত্র। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব ছিল প্রকট। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে লাগামছাড়াভাবে। যে কারণে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় স্থান পায়নি। যারা অর্থ দিতে পেরেছে তারাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায়ও নিয়োগ হয়েছে যত্রতত্র। নব্বই-এর দশকে যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে তার অধিকাংশগুলোর প্রয়োজন ছিলো না। দেখা গেছে দুটি কলেজের মাঝে দূরত্ব ১ কিলোমিটার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনেরও কোনো নীতিমালা ছিল না। রাতারাতি কলেজ করে এমপিও করেছে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। নাই কোনো ভবন, নাই ভূমি, নাই ছাত্র। কিন্তু কলেজ স্থাপন হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের চেয়ে ছাত্র সংখ্যা কম।

যোগ্য এবং মেধাবীরা এ পেশায় না আসাতে যা হবার তা-ই হয়েছে। এই সমস্ত শিক্ষক শিক্ষাদানের চেয়ে শিক্ষা ব্যবসায় ঝুঁকেছে বেশি। অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। অযোগ্য যারা নিয়োগ পেয়েছে তাদের মাঝে শিক্ষকের কোনো বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া দুরূহ ছিল। এমন লোকও শিক্ষকতা পেশায় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেছেন যারা পরীক্ষায় বহিষ্কার হয়েছেন, পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছেন, প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তপনা করেছেন। এদের মত কিছু শিক্ষকের কারণে সমগ্র শিক্ষক সমাজ কালিমালিপ্ত হয়েছে। আমি বরাবরই এই জিনিসগুলোর বিরোধিতা করতাম বলে কারো কারো কটু মন্তব্য শুনতে হয়েছেন। তবে আমি স্রোতের দিকে গা ভাসাতে অভ্যস্ত নই। যা সত্য যা বিশ্বাস করতাম তা-ই বলতাম। যদি পাশে কেউ না থাকে একলা চলো নীতিতে বিশ্বাস করতাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উক্তিকে পাথেয় করেছি। ‘রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ, চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়; সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ আজও সে পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। সত্যকে আলিঙ্গন করে যদি মরতেও হয় সেটাই জীবনের তৃপ্তি।

চাকুরি করি পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজে, কিন্তু অপর দুটি সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সাথে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দুটি কলেজের অধ্যক্ষদের দেখেছি খুব কাছ থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান যেমন একজন প্রশাসক তেমনি তিনি একজন অভিভাবকও বটে। চাঁদপুর সরকারি কলেজের একজন অধ্যক্ষকে দেখেছি, যিনি তাঁর কক্ষে জুনিয়র সহকর্মীরা যাক সেটা পছন্দ করতেন না। সহকর্মীদের সাথে তেমন ভালো আচরণও করতেন না। তিনি ছিলেন প্রশাসক, অভিভাবক নয়। ছাত্র নেতাদের তিনি খুব আদর-যত্ন করতেন। ছাত্র নেতাদের তিনি এতোটাই আদর-যত্ন করে সামনের চেয়ারে বসতে দিতেন, অনেক সময় অধ্যাপকরা উনার রুমে গেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। যাদের সম্মান বোধ ছিল তারা তাঁর রুমে যেতেনই না। কোন্ অদৃশ্য কারণে তিনি ছাত্র নেতাদের প্রাধান্য দিতেন সেটা তিনিই বলতে পারবেন। হয়তো তিনি এমনটা ভাবতেন, ছাত্র নেতাদের হাতে রাখতে পারলে চেয়ারটা কন্টকমুক্ত থাকবে। আর শিক্ষকরাতো অধীনস্থ।

ডিগ্রি পরীক্ষা, চাঁদপুর সরকারি কলেজে পরীক্ষার ডিউটি। পরীক্ষা শেষে খাতা জমা দিতে গিয়ে দেখি অধ্যক্ষের রুমে হৈ চৈ। ভেতরে ঢুকে দেখি একজন ছাত্রনেতা উত্তেজিত হয়ে অধ্যক্ষকে গালাগালি করছেন। তার অভিযোগ পরীক্ষার হলে তাকে ডিস্টার্ব (?) করা হয়েছে। সবাই মিলে তাকে নিবৃত্ত করছে। পরে জানলাম তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় আবার অতিরিক্ত সময় পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়েছে। প্রশ্রয় দিলে একসময় যে নিজেই অপমানিত হতে হয় সেটা টের পেলেন অধ্যক্ষ সাহেব। কিন্তু সেই অধ্যক্ষই নিজের সহকর্মীদের সাথে এমন আচরণ করতেন যেন সহকর্মীরা ভৃত্য। জুনিয়র শিক্ষকরা তা মুখ বুঁজে সহ্য করতেন। কারণ তিনি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। একটা জিনিস আমার মাথায় আসতো না, কেন অধ্যক্ষরা ভাবেননা এ ক্ষমতা স্থায়ী নয়। আপনি যখন বিদায় নেবেন তখন আপনার পাশে কেউ থাকবেন না।

চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজেও এমন একজন অধ্যক্ষ ছিলেন যিনি ঢাকা থাকতেন, সপ্তাহে একদিন কলেজে আসতেন। তিনিও ছিলেন খুব প্রভাবশালী। কলেজ থেকে পিয়ন গিয়ে তাকে ঢাকা থেকে আনতে হতো। থাকতেন সার্কিট হাউজে আবার পিয়ন ঢাকা দিয়ে আসতে হতো। ক্ষমতার অপব্যবহার যে কী পরিমাণ হতো কল্পনা করা যায় না। এতে করে যা হতো তা হলো প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হতো বেশি। শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করতো। শিক্ষকরা অধ্যক্ষের সমালোচনায় মুখর থাকতো। ডিসিপ্লিন ভেঙ্গে পড়তো।

এদিকে বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রচ- আন্দোলন গড়ে উঠে। জেলায় জেলায় বাকশিস কর্মসূচি দিতে থাকে। শিক্ষকরা সংগঠিত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন চলতে থাকে। সরকার নতুন বেতন স্কেল দিয়েছে, কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তীব্র আন্দোলনে বিএনপি সরকার বাধ্য হয়েছে বেরসরকারি শিক্ষকদের নতুন বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করতে। এটি ছিল খুব আমানবিক। বেসরকারি শিক্ষকদের নানাভাবে বঞ্চিত করা শুরু করলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের সে বঞ্চনা থেকে অনেকটাই মুক্তি দিল। যতবার নতুন বেতন স্কেল দিয়েছে ততবারই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষকদের ১০০% বেতন নিশ্চিত করেছে। এরপরও কিছু কিছু বঞ্চনা রয়ে গেছে।

চাঁদপুর কলেজ এবং চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের কয়েকজন ইংরেজির অধ্যাপক প্রধান পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন, যাঁরা আমাকে তাঁদের সাথে নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। উত্তরপত্র মূল্যায়নে এসেছে নতুন পদ্ধতি। ওএমআর সিস্টেম হওয়ার কারণে উত্তরপত্র কোন্ কেন্দ্রের সেটা জানার কোনো উপায় নেই। নিরীক্ষা করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতাটি হলো তা খুবই ভয়াবহ। একজন ইংরেজির শিক্ষককে উত্তরপত্র দেয়া হতো এক হাজারেরও বেশি। পরীক্ষকদের সময় দেয়া হতো তিন সপ্তাহ। যা ছিল অবাস্তব। এর মধ্যে উত্তরপত্র দেখে প্রধান পরীক্ষককে পাঠাতে হতো। কিছু কিছু শিক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়নে চরম অবহেলার পরিচয় দিতেন, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য ছিল না। এটি একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এ দায়িত্বটি যদি যথাযথভাবে পালন করতে না পারে তবে দায়িত্ব নেয়া উচিত নয়। কোনো কোনো পরীক্ষক দেখা যায় চরম আন্ডার মার্কিং করেছে, আবার কেউ কেউ ওভার মার্কিং করেছে। অনেকের ক্ষেত্রেই যত্ন সহকারে উত্তরপত্র মূল্যায়নে ঘাটতি ছিল। বিভিন্ন প্রধান পরীক্ষকের সাথে নিরীক্ষকের কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা সুখকর নয়। বরঞ্চ কোনো কোনো পরীক্ষক পরীক্ষার্থীর সাথে চরম অপরাধ করেছেন। দেখা যায় একই মানের লেখায় কোনো পরীক্ষক দশ নাম্বারে ৮ দিয়েছেন, আবার একই লেখায় আরেক পরীক্ষক ৪ দিয়েছেন। এমন ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো এখনো রয়ে গেছে। উত্তরপত্র মূল্যায়নে একটা স্ট্যান্ডার্ড না থাকলে, সিমিলারিটি না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরীক্ষার্থীরা। যা এখনো হচ্ছে।

একটা সময় ছিল পরীক্ষক হতে হলে তাকে কম করে ৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হতো। কিন্তু দেখা যায় চাকুরিতে জয়েন করার দুই মাসের মাথায় পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। যথাযথভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন না হওয়ার এটাও একটি কারণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, শিক্ষক তার ছাত্রকে দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছে। যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ওএমআর সিস্টেম হওয়ার পরও পরীক্ষকরা ট্রেস করে ফেলতো উত্তরপত্রগুলো কোন্ কেন্দ্রের। উত্তরপত্র মূল্যায়ন একজন ছাত্রের জীবন-মরণের বিষয়। সে জায়গাটায় শিক্ষকদের অতি সাবধান এবং যত্নবান হওয়া উচিত। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে সেটার ঘাটতি ছিলো।

আরেকটা বিষয় হলো, পরীক্ষা বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়। কেউ পরীক্ষক বা প্রধান পরীক্ষক হলে তা গোপন রাখা ছিল প্রথম শর্ত। কিন্তু অনেকেই সেটা গোপন রাখতেন না। এটিও পাবলিক পরীক্ষা আইনে অপরাধ। চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক জনাব রণজিৎ কুমার বণিকের সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, এক পরীক্ষকের খাতার মধ্যে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। পুরো এক বান্ডেল খাতা দেখার পর বুঝলাম, পরীক্ষক কেন্দ্র ট্রেস করে ছাত্র খবর দিয়ে উত্তরপত্রে পুনরায় লিখিয়েছে। সাথে সাথে বিষয়টি প্রধান পরীক্ষকের নজরে আনলাম। তিনিও আমার সাথে একমত হলেন। পরীক্ষককে চিঠি দিয়ে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হলো। প্রথমে তিনি অস্বীকার করলেন। পরে যখন প্রমাণসহ তাকে বলা হলো তখন তিনি স্বীকার করেন যে অপকর্মটি তিনি করেছেন। ছাত্র খবর দিয়ে এনে অর্থের বিনিময়ে উত্তরপত্র টেম্পারিং করেছেন। বোর্ডকে জানানো হলো। তার দুই বছরের জন্যে পরীক্ষক পদটি স্থগিত করা হলো। যেখানে তিনি দ-নীয় অপরাধ করেছেন, সেখানে তাকে লঘুদ- দিয়ে ছেড়ে দিলো বোর্ড। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়