প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৩, ০০:০০

রায়হান (১৫) নামের এক কিশোরের ধর্ষণে ৮ম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরী (১৪) দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। এ ঘটনায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় দফারফার পরেই পুলিশ ঘটনাটি জানতে পেরে অভিযুক্ত কিশোর, কিশোরের দুই বোন, চাচাত ভাইসহ এক সালিসকে গ্রেফতার করেছে। একই ঘটনায় আরো কয়েক সালিসকে গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ঘটনাটি হাজীগঞ্জের হাটিলা পূর্ব ইউনিয়নের লাওকোরা গ্রামের। কিশোরী একই বাড়ির ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। বাড়ির সম্পর্কে উভয়ে চাচা-ভাতিজি। আসামীরা হলো : একই গ্রামের সর্দার বাড়ির সেরাজল হকের ছেলে রায়হান (১৫), রাযহানের দুই বোন মোসাঃ হাজেরা বেগম (২৫), মোসাঃ খালেদা আক্তার (২২), হাছান সর্দারের ছেলে হাবিবুর রহমান (৩০) ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মৃত অলি উল্লাহর ছেলে রহমত উল্লাহ্ (৪০)। এদের মধ্য প্রধান আসামী রায়হান ছাড়া বাকিদেরকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। মামলা করার দিনেই পুলিশ প্রধান আসামীসহ সবাইকে গ্রেফতার করে।
এই ধর্ষণের বিষয়টি ধামাচাপা দেবার জন্যে স্থানীয় ইউপি সদস্য রহমত উল্যাহ ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাইয়ুম বেপারীর নেতৃত্বে শুক্রবার ১২ মে বিকেলে একটি সালিসি বৈঠক হয়। কিশোর রায়হান স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে চলতি শিক্ষাবর্ষে আর মাদ্রাসায় যায়নি। কিশোরী স্থানীয় অপর একটি মাদ্রাসার ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত শুক্রবার বিকেলে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও দুই পরিবারের লোকজনকে নিয়ে সালিসি বৈঠকে বসেন ইউপি সদস্য রহমত উল্লাহসহ স্থানীয় একটি চক্র। ওই বৈঠকে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পরিবারকে চাপ সৃষ্টি করে টাকার বিনিময়ে রফাদফা এবং দুই পক্ষের কাছ থেকে একটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়া হয়। এছাড়া অন্তঃসত্ত্বা কিশোরীর চিকিৎসার জন্যে অভিযুক্ত রায়হানের পরিবারকে নগদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ওই বৈঠকে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাইয়ুম বেপারী ও কুদ্দুস সর্দারসহ অন্যান্য সালিস ও দুই পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। কিশোরীর স্বজনরা জানান, মেম্বার (ইউপি সদস্য)সহ সবাই চেয়েছে বিষয়টির সমাধান হোক। তাই তাদের কথায় আমরা রাজি হয়েছি।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাইয়ুম বেপারী সালিসি বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, গত শুক্রবার মেম্বার (ইউপি সদস্য) রহমত উল্যাহ তাকে নিয়ে ওই বাড়িতে যায়। এরপর মেম্বারের উপস্থিতিতে দুই পক্ষের চারজন সালিস ও দুই পরিবারের লোকজন বসে বিষয়টির সমাধান করেন। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ছেলে-মেয়ে উভয় অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজি হয়। তাই আমি তাদের থানা বা কোর্টে (আদালত) যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু মেম্বার দুই পক্ষের লোকজন ও পরিবারের সদস্যরা বিষয়টির সমাধান করে নেয়। পরে শুনেছি মেয়ের চিকিৎসার জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। ওই সময়ে আমি ছিলাম না। ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত নই। যদি এমনটি হয়ে থাকে, তাহলে ইউপি সদস্য রহমত উল্লাহ এমন ঘটনার সমাধান না করে ধর্ষিতার পরিবারকে আইনি সহায়তা দিতে পারতেন।
হাজীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) নজরুল ইসলাম জানান, কিশোরীকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্যে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। অপর এক প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, অন্য সালিসদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে, প্রয়োজনে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দ জানান, এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হয়েছে। মামলায় সকল আসামীকে আটক করা হয়েছে।
মামলার আসামীর মধ্যে কেবল অন্যতম সালিস ইউপি মেম্বার অন্তর্ভুক্ত হলেন, অন্য সালিসরা অন্তর্ভুক্ত হলেন না ক্ষমতাসীন দল কিংবা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে না অন্য কারণে-এটা নিয়ে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কৌতূহল রয়েই গেলো। গ্রামীণ পরিবেশে সংঘটিত নারী সংক্রান্ত কেলেঙ্কারী, ধর্ষণ, উত্ত্যক্তকরণ, যৌন নিপীড়নের ঘটনাসমূহ তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি হিসেবে ইউপি মেম্বারসহ গ্রাম্য মোড়লদের ধামাচাপা দেয়া, সালিসের নামে রফাদফা করার প্রয়াস চালানো রীতিমত স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই ধামাচাপা, রফাদফা যে আগের মতো সহজ কাজ নয়, গোপন থাকার কথা নয়, জাতীয় জরুরি নম্বর (৯৯৯)-এর যুগে খুব সহজেই পুলিশকে কেউ জানিয়ে দিতে পারে সেটা বোধকরি হাজীগঞ্জের সেকেলে প্রকৃতির ইউপি মেম্বারসহ কিশোরী ধর্ষণের সালিসে সংশ্লিষ্টরা জানলেও অবজ্ঞা করেছেন। সেজন্যে ফেঁসে গেলেন। অতীতে এমন ধর্ষণের ঘটনায় সালিসের প্রেক্ষিতে পুলিশকে আমরা খুব সক্রিয় দেখেছি-এটা জোর গলায় বলার পুঁজি আপাতত আমাদের হাতে নেই। হাজীগঞ্জ থানার পুলিশ হাটিলা পূর্ব ইউনিয়নের লাওকোরা গ্রামে সংঘটিত কিশোরী ধর্ষণে সালিসের ঘটনায় যে অ্যাকশন দেখালো, সেটা প্রশংসনীয়ই বটে। এমনটি দেশের সকল থানার পুলিশ দেখাক-সে প্রত্যাশা জোরালোভাবেই করছি।