প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
পদ্মা সেতুর কারণে চাঁদপুরের গুরুত্ব কি ক্রমশ ব্যাহত হচ্ছে?
ভারতের আসাম রাজ্য, আমাদের দেশের সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও সন্নিহিত এলাকার সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটা বড়ো অংশের মধ্যে সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ স্থাপনে ব্রিটিশ আমল থেকে চাঁদপুর পেয়েছে ট্রানজিটের অনিবার্য গুরুত্ব। এ গুরুত্বের পেছনে রকেট স্টিমারের ভূমিকাই ছিলো প্রধান। রেলওয়ের আসাম মেইল ট্রেন সিলেট, আখাউড়া, কুমিল্লা ও লাকসাম হয়ে চাঁদপুর আসতো। আর এই ট্রেনের যাত্রীরা চাঁদপুর স্টেশনে নেমে স্টেশন সংলগ্ন ঘাট থেকে রকেট স্টিমারে চড়ে ফরিদপুরের রাজবাড়িস্থ গোয়ালন্দ ঘাটে যেতো এবং ট্রেনযোগে আমাদের দেশের বৃহত্তর ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা ও যশোর অঞ্চল পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা গিয়ে পৌঁছতো। আবার কলকাতা থেকে চাঁদপুর হয়ে যাত্রীরা আসাম যেতো। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ লাগার আগ পর্যন্ত ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে চাঁদপুরের সর্বাত্মক গুরুত্ব অক্ষত ছিলো। চাঁদপুরকে ওই সময় পর্যন্ত বলা হতো আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের প্রবেশদ্বার। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মেইল ট্রেন চলাচল বন্ধ হবার পর চাঁদপুরের গুরুত্ব মারাত্মক ব্যাহত হয়। প্রায় ১২০০ রেল কর্মচারীর চাঁদপুর নেমে যায় ২০০ কর্মচারীতে। স্বাধীনতোত্তর দেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম সহ পূর্বাঞ্চলের সাথে নদীবিধৌত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সংক্ষিপ্ত যোগাযোগের ক্ষেত্রে চাঁদপুরের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। বাস ও ট্রেনযোগে বিপুল সংখ্যক যাত্রী চাঁদপুর এসে রকেট স্টিমার ও লঞ্চযোগে সুলভে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতে চাঁদপুরকে উত্তম পছন্দ হিসেবে বেছে নেয়। আর ২০০০ সালের ২৫ এপ্রিল চাঁদপুর ও শরীয়তপুরের মধ্যে চালুকৃত ফেরি চাঁদপুরকে বাড়তি গুরুত্বে বলীয়ান করে। ৯ মাস পূর্বে পদ্মা সেতু চালু হবার পর উপরোল্লিখিত চাঁদপুরের গুরুত্ব একের পর এক হ্রাস বা ব্যাহত হতে থাকে। ফেরির যানবাহন সংখ্যা অর্ধেকের চেয়ে নিচে নেমে আসে। ঢাকা থেকে ভায়া চাঁদপুর হয়ে শরিয়তপুর, মাদারীপুর, বৃহত্তর বরিশাল ও খুলনার বিভিন্ন রূটে চলাচলকারী লঞ্চ ও স্টীমারে যাত্রীসংখ্যা কমতে থাকে। এক পর্যায়ে কিছু লঞ্চ ১/২ দিন বিরতি দিয়ে চলাচল করতে করতে সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়, আর তিন মাস পর স্টিমার চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
|আরো খবর
শতাধিক বছরের পুরানো এই স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হওয়া নিয়ে গতকাল সোমবার চাঁদপুর কণ্ঠে চাঁদপুরের সিনিয়র সাংবাদিক অধ্যাপক দেলোয়ার আহমেদ একটি প্রতিবেদন লিখেছেন, যার শিরোনাম হয়েছে ‘স্টীমার চলাচল ৬ মাস বন্ধ ॥ শত শত যাত্রীর ভোগান্তি ॥ পদ্মা সেতুকে দুষছেন অনেকেই’। এ প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, বিআইডব্লিউটিসি পরিচালিত রকেট স্টীমার সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত ছয় মাসের অবস্থা জানালেন সংশ্লিষ্ট স্টাফরা। সপ্তাহে ২-৩ দিন পিএস টার্ন, লেপচা, মাহসুদ, শেলা নামের রকেট স্টীমারগুলো চলতো। বন্ধ থাকায় শত শত যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েছে। চাঁদপুর থেকে বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট ও ঢাকাতে ঝড়-তুফান, বৃষ্টি বাদলের দিনে ও ঈদ উৎসবে নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারছেন না শত শত যাত্রী সাধারণ। ক্ষতি হচ্ছে সরকারের কোষাগারও। এজন্যে পদ্মা সেতুকে দায়ী করেন অনেকেই।
চাঁদপুরের বিআইডব্লিউটিসির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, রকেট স্টিমার চাঁদপুরে চলাচল কেনো বন্ধ, সেটার সঠিক তথ্য আমি জানি না। তবে এ তথ্য হেড অফিস বলতে পারবে। তিনি আরো বলেন, এখন মানুষের রকেট স্টীমারে ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ কম। অথচ চাঁদপুর প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ঘাট থেকে নিয়মিত প্রতিদিন প্রতি আধা/এক ঘন্টা পর পর দিনে রাতে অনেক যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করছে দেশের এসব নৌরুটসহ বিভিন্ন রুটে। পদ্মা সেতুর কারণে যাত্রী কম-বেশি নিয়েইতো এসব লঞ্চ চলছে। কোনোটাইতো বন্ধ হয়নি-এমন বক্তব্য সাধারণ ও সচেতন জনগণের। তারা বলেন, রকেট স্টীমার সার্ভিসের সেবা দান -এটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কোনো লাভ-লোকসানের ব্যাপার না বলে মতামত দেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্টীমার না থাকায় সপ্তাহান্তে বা কখনো ৩ দিন সরকারি ছুটির দিনে লোকজন বাড়ি ও অফিসে যাতায়াত করতে পারছেন না। এ ঘাট দিয়ে চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলার লোকজন চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলের কর্মরত শত-সহস্র লোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকগণ নিয়মিত বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাটে ও ঢাকায়ও যাতায়াত করতেন। আবার খুলনা ও বরিশাল মেডিকেল, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ফিরতি পথে এ ঘাট দিয়ে যাতায়াত করতো।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির কিছু স্টাফ নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, পদ্মা সেতু চালুর পরে যাত্রী সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় স্টীমার সার্ভিস বন্ধ রয়েছে। অভিজ্ঞজন বলেন, চট্টগ্রাম ও সিলেটের ট্রেনের সময়ের সাথে সমন্বয় করে আসন্ন ঈদে বন্ধ রকেট স্টীমার সার্ভিস আবার চালু করলে শত সহস্র যাত্রীর ঈদ যাত্রায় কষ্ট লাঘব হতো ও সুবিধাও হতো।
উল্লেখ্য, এ ঘাটের সাথেই রয়েছে চাঁদপুর (বড়) স্টেশন। মাত্র দুই মিনিটের হাঁটাপথ। চাঁদপুর হতে বরিশাল রকেট স্টীমার ভাড়া মাত্র ১২০ টাকা। আর লঞ্চ ভাড়া ৩৬০ টাকা, যা ঈদে আবার দ্বিগুণ হয়ে যায়।
প্রতিটি দেশেই কিছু পাবলিক ইউটিলিটি ডিপার্টমেন্ট আছে। যেমন-রেল, ডাক, স্টিমার সার্ভিস ইত্যাদি। এই ডিপার্টমেন্টগুলো সরকারের লাভ-লসের প্রশ্নে পরিচালিত হয় না। যেমন-কুরিয়ার সার্ভিসের দাপটে সরকার ডাক বিভাগ বন্ধ করে দেয়নি। সর্বনিম্ন পাঁচ টাকা খরচে দেশের যে কোনো প্রান্তে ডাক বিভাগ পৌঁছে দেয় চিঠি। পরীক্ষার খাতার পার্সেল পরিবহনে ডাক বিভাগের জুড়ি এখনও নেই। বাস সহ অন্যান্য যানবাহনের কারণে রেলের ট্রেন বন্ধ হয়নি। সুলভে স্বাচ্ছন্দ্যে দুর্যোগে দুর্বিপাকে দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রেন ছাড়া অন্য যানবাহনের আর কোন্টি আছে। একইভাবে নৌপথে সুলভে, বিশেষ করে ঝড়-তুফানে নিরাপদে চলাচলের ক্ষেত্রে স্টিমার ছাড়া লঞ্চের কথা তো ভাবাই যায় না। সেহেতু পাবলিক ইউটিলিটির প্রশ্নে স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করাটা অযৌক্তিক। ঢাকা থেকে এ সার্ভিস না চালিয়ে চাঁদপুর থেকে হলেও বরিশাল পর্যন্ত অন্তত চালানো উচিত বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবারে। এতে একদিকে ঐতিহ্যবাহী ও শত বছরের পুরানো স্টিমার সার্ভিস চালু থাকবে, অন্যদিকে চাঁদপুরের গুরুত্ব অনেকটুকু রক্ষা পাবে এবং স্টিমার সার্ভিসের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মহীন হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে। আমরা চাঁদপুরকেন্দ্রিক স্টিমার সার্ভিসের বিষয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে বিবেচনার জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।