প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

গেলো নব্বইর দশকের শুরু থেকে আর্সেনিক নিয়ে অনেক মাতামাতি শুরু হয়। এটি চলতে থাকে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক তথা ওই নব্বইর দশক এবং চলতি নূতন শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ পর্যন্ত। অগভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি নির্ণীত হবার পর ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায় এবং সেজন্যেই মাতামাতি হয়। কারণ নদী, পুকুর-দিঘিসহ উন্মুক্ত জলাশয় তথা ভূ-উপরিভাগস্থ পানি পানে কলেরা, ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব হয় বিধায় নিরাপদ পানি পেতে আমাদের দেশের মানুষ যখন অগভীর নলকূপ বসিয়ে স্বস্তিতে ভুগছিলো, তখন এর পানিতে মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর আর্সেনিকের উপস্থিতি জানতে পারার বিষয়টি ছিলো অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। তখন অগভীর নলকূপের পানি নির্দিষ্ট সময় ধরে থিতিয়ে রেখে পান করা, ব্যয়বহুল গভীর নলকূপ বসিয়ে সেটির পানি পান করা, পুকুরের পানিকে প্রক্রিয়া করে পন্ড সেন্ড ফিল্টারের মাধ্যমে পান করা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পান করার কথা নানা মাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে। এ নিয়ে কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, সচেতনতামূলক কার্যক্রমের হিড়িক পড়ে যায়। এতে ইউনিসেফসহ অন্যান্য সংস্থার অর্থায়নে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিও নানা প্রকল্প গ্রহণ করে। এতে সাধারণ মানুষ কম-বেশি সচেতনও হয়।
সরকার আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় ভূ-উপরিভাগস্থ নদী/বড় খাল/দিঘির পানি পরিশোধন করে সরবরাহের জন্যে কোটি কোটি টাকার সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ এবং গভীর নলকূপ স্থাপনের উল্লেখযোগ্য বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগের আওতায় চাঁদপুর পৌরসভার ৩টি এবং হাজীগঞ্জ পৌরসভায় একটি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ করে চালু করা হয়। অন্যান্য স্থানে এমন প্লান্ট নির্মাণ সমাপ্ত করা হয় ও চলমান অবস্থায় রাখা হয়। সাথে সাথে চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন স্থানে আর্সেনিক মুক্ত পানির নিশ্চয়তায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ চলমান রাখা হয়। কিন্তু জনসচেতনতা সৃষ্টিতে আর্সেনিক বিষয়ক কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, লিফলেট বিতরণ, বিলবোর্ড স্থাপন ও বিজ্ঞাপন প্রচারের বিষয়টি ক্রমশ স্তিমিত, এমনকি শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা হয়। ফলে সাধারণ্যে সৃষ্টি হয় প্রায় পূর্বের ন্যায় উদাসীনতা। অনেকে ধরে নিয়েছেন, পূর্বের ন্যায় আর্সেনিকের প্রকোপ নেই। অতএব, অগভীর নলকূপের পানি পানে সমস্যা হচ্ছে না এবং হবে না।
এমন বাস্তবতাতেই আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর, বি) অতি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে উদ্বেগজনক এক গবেষণা রিপোর্ট। এ রিপোর্টের আলোকে গত শুক্রবার (২৩/১২/২০২২) চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে শীর্ষ সংবাদ। এ সংবাদের শিরোনাম হয়েছে ‘হাজীগঞ্জ ও মতলবের ১০০টি পরিবারের মা ও শিশুদের মল এবং খাবার পানির নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা : আর্সেনিক-দূষিত পানি শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক রোধের কারণ’। এই গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি আছে এমন এলাকায় শিশুদের মল এবং পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ই.কোলাই (একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের অন্ত্রের নিচের অংশে পাওয়া যায় এবং এটি ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ)-এর উচ্চ প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা গেছে। যদিও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের প্রধান কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার এবং অপব্যবহার, কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতুগুলোও অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার এবং অপব্যবহার, কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতুগুলোও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণ হতে পারে। হাজীগঞ্জের ৫০টি পানির নমুনায় মেডিয়ান আর্সেনিকের ঘনত্বের পরিমাণ প্রতি লিটারে ছিলো ৪৮১, যেখানে খাবার পানিতে আর্সেনিকের সর্বোচ্চ সীমা প্রতি লিটারে ১০ হওয়া উচিত। গবেষকরা বলেছেন, দেশে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাবযুক্ত এলাকার (যেমন হাজীগঞ্জ) শিশুদের দেহে আর্সেনিকের উপস্থিতি ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের মধ্যকার সম্পর্ক জনস্বাস্থ্যের জন্যে উদ্বেগের বিষয়। ফলে আর্সেনিকের প্রভাব ও বিস্তার কমানোর প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা প্রয়োজন।
আমরা মনে করি, আর্সেনিক প্রতিরোধে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি পূর্বের ন্যায় আর্সেনিক সংক্রান্ত সচেতনতা সৃষ্টিতে সভা, সেমিনার, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, নলকূপের পানি পরীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক কর্মসূচি গ্রহণে সরকারের সক্রিয় হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত নিষ্ক্রিয়তায় আমরা যে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় নির্মম পরিণতির দিকে ধাবিত হবো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।