প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের একটি সাধারণ খবর হচ্ছে এমন-বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় খাল-বিল-পুকুর-ডোবায় পানির অপর্যাপ্ততাহেতু কৃষকরা পাট নিয়ে পড়েছে মহাবিপাকে। জমি থেকে পাট কাটার পর জাগ দিতে পারছে না অর্থাৎ আঁশ পচাতে পারছে না। এতে অনেক জমির পাট জমিতেই রেখে দিতে হয়েছে। এমন খারাপ খবরের মধ্যেই গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠে দেখা গেলো একটি ভালো খবর। সেটি হচ্ছে ‘হাইমচরে কেনাফ চাষে ব্যাপক সফলতা ॥ সোনালী আঁশ সংগ্রহে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণী’।
আমাদের দেশে যারা কৃষি বিষয়ে লেখাপড়া করেন, কৃষি বিভাগে চাকুরি করেন তাদের কাছে পাট জাতীয় ফসল ‘কেনাফ’ পরিচিত থাকতে পারে, তবে অন্যদের কাছে বিশেষ করে সাধারণ মানুষের কাছে নয়। অথচ এই কেনাফ আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত চার হাজার বছরের পুরানো ফসল। যদ্দুর জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং পরে যখন পাটের জোগান কমে আসে, তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা, মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশে কেনাফ চাষ শুরু হয়। প্রধানত এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত ও চীন। অন্য দেশগুলো হচ্ছে : বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা ও দক্ষিণ ইউরোপের কিছু দেশ। বাংলাদেশে কেনাফের উৎপত্তিস্থল হলো : কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ।
পাটকে বলা হয় বাংলাদেশের সোনালী আঁশ (গোল্ডেন ফাইবার)। পরাধীন আমলেই পাটের এই খ্যাতি আসে। পাট ও পাটজাত দ্রব্য বিভিন্ন দেশে রাপ্তানি করে ব্রিটিশ আমল থেকেই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কথা আমরা জানতে পারি ইতিহাস থেকে। পাটের আর্থিক সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করেই নারায়ণগঞ্জে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম পাটকল ‘আদমজী জুট মিলস্’ গড়ে উঠে। চাঁদপুরে গড়ে উঠে ডব্লিউ রহমান জুট মিলস্ ও স্টার আলকায়েদ জুট মিলস্ এবং হাজীগঞ্জে হামিদিয়া জুট মিলস্। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের আরো অনেক স্থানে ছোট-বড় পাটকল গড়ে উঠে। দেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও নানা কারণে পাটকলগুলো ক্রমশ ধকল খাওয়া শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় আদমজী জুট মিলস্। সোনালী আঁশের সোনালী দিনগুলো হারিয়ে যেতে থাকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে। এমতাবস্থায় কৃষকরা ক্রমশ পাট চাষে অনাগ্রহী হয়ে উঠে এবং সঠিকমূল্যে পাট বিক্রি করতে না পেরে পাটে আগুন লাগিয়ে দেয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পাট চাষেও পড়ে। যেমনটি এ বছর বেশি দেখা যাচ্ছে; পর্যাপ্ত পানির অভাবে কৃষকরা পাটের আশানুরূপ ফলন পায়নি এবং পাট কেটে জাগও দিতে পারছে না। আবার বন্যায় বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে চরাঞ্চলে পাট চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ লবাণাক্ততা, খরা এবং কম-বেশি বৃষ্টিপাত মোকাবেলা করে কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে। এমতাবস্থায় কেনাফ থেকে কৃষকরা আহরণ করে নূতন আশা। যেমনটি করেছে চাঁদপুর জেলার বন্যাপ্রবণ বহু চর সম্বলিত হাইমচর উপজেলার কৃষকরা। তারা উৎপাদন ও বিক্রিতে পেয়েছে আশাব্যঞ্জক সফলতা।
‘কেনাফ’কে শুধু আমাদের দেশের নয় বরং বিশ্বের টেক্সটাইল সেক্টরের জন্যে সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে বিবেচনা শুরু করেছে কৃষিবিদ, কৃষকসহ পর্যবেক্ষকরা। কেননা কেনাফ দিয়ে উৎপাদন করা যায় স্টোরেজ ব্যাগ, শিকা, জায়নামাজ, টুপি, মাদুর, স্যান্ডেল, সোফা ও কুশনের কভার, পর্দার কাপড়, বেডশীট, পাঞ্জাবি, সোয়েটার, এমনকি প্লেন, মোটর, কম্পিউটার ইত্যাদির পার্টস্ও। কেনাফজাত পণ্য রিসাইকেলও করা যায়। এটি পরিবেশবান্ধবও। আমরা আশা ও বিশ্বাস করি যে, কৃষি বিভাগের সময়োপযোগী ভূমিকায় চাঁদপুর জেলার হাইমচরের পাশাপাশি মতলব উত্তর, চাঁদপুর সদর ও মতলব দক্ষিণসহ দেশের সকল চরাঞ্চলেও কেনাফ চাষ ছড়িয়ে পড়বে এবং কৃষকরা লাভবান হবে।