প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের প্রচলিত ধারণা কী?---আছে এক বা একাধিক বিদ্যালয় ভবন, ছোট-বড় মাঠ এবং শিক্ষকমণ্ডলী; বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন আসে, কিছুক্ষণ হৈচৈ-দৌড়াদৌড়ি করে, এসেম্বলী হয়, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যায়, শিক্ষকরা পড়ায় ও পড়া দেয়, পড়া না পারলে বকে বা অন্য কোনো শাস্তি দেয়, বিরতিতে শিক্ষার্থীরা মাঠে খেলে, হৈচৈ করে নয়তো দোকানে গিয়ে কিছু কিনে খায়, ছুটির ঘণ্টা বাজলে বাড়ি চলে যায়---এইতো। এ ধারণার বাইরেও যে একটি বিদ্যালয়, বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় এবং ম্যানেজিং কমিটির সর্বাত্মক সহযোগিতায় বাহ্যিক সৌন্দর্য, পরিবেশগত ও অবকাঠামোগত নান্দকিতায় ব্যতিক্রম হতে পারে, সেটা ভ্রমণপিপাসু, অনুসন্ধিৎসু ও কৌতূহলী মানুষ ছাড়া অন্য সাধারণ মানুষদের ধারণার আওতায় ধরা দেয় না। তেমন একটি ব্যতিক্রম বিদ্যালয় চাঁদপুর কণ্ঠের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার মোঃ আবদুর রহমান গাজীর কৌতূহলী দৃষ্টি ও নিবিড় পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে খোদ চাঁদপুর পৌর এলাকায়। 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া' এমন অবস্থানেই ব্যতিক্রম সুন্দর এই বিদ্যালয়টির অবস্থান।
বিদ্যালয়টির নাম বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। চাঁদপুর পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডে বিষ্ণুদী মূল সড়কের পাশে ছায়া সুনিবিড় নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশে বিদ্যালয়টির অবস্থান। বিদ্যালয়টি ৮২ বছরের পুরানো। ১৯৪০ সালে এটি তরপুরচণ্ডী ইউনিয়ন এলাকায় ৩৬ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিদ্যালয়টি আলো ছড়ায় চাঁদপুর শহরের অনেক বড় গ্রাম বিষ্ণুদীতে। গ্রামটির যে এলাকায় বিদ্যালয়টির অবস্থান, সে এলাকাটি দীর্ঘ সময় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ও চাঁদপুর শহরতলীতে থাকায় সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন বঞ্চিত ছিলো। চাঁদপুর পৌরসভার এলাকা সম্প্রসারিত হলে উক্ত বিদ্যালয় এলাকাটি ৯নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং খুব ধীর গতিতে উন্নয়নের দেখা পায়। একসময় বিদ্যালয় ভবনটি ছিলো একতলাবিশিষ্ট, যেটি শ্রীহীনতা ও জরাজীর্ণতায় আকর্ষণবর্জিত ছিলো। সক্রিয় ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক নেতা মোঃ আবুল বাসার এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর এ বিদ্যালয়টিকে পরিচিত করার জন্যে নানা পদক্ষেপ নেন। তিনি লক্ষ্য করেন, এ বিদ্যালয়ে যারা লেখাপড়া করে তাদের অধিকাংশের পিতামাতা নিরক্ষর হওয়ায় শ্রমজীবী, নিম্নবেতনভুক, দরিদ্র ও অতি দরিদ্র, নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। শিক্ষার্থীদের অনেকে জীর্ণ, ছেঁড়া পরিধেয় বস্ত্র পরে কোনোমতে স্কুলে আসে ঠিকই, বই ছাড়া না থাকে তাদের খাতা, কলম, পেন্সিল সহ অত্যাবশ্যকীয় শিক্ষা উপকরণ। আর বাড়িতে পড়ানোর মতো নেই কোনো উপযুক্ত শিক্ষিত লোক কিংবা কাউকে দিয়ে প্রাইভেট পড়ানোর মতো সামর্থ্য। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অশোকা ফেলোশীপপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ইব্রাহীম সোবহানের উদ্ভাবিত বিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ শুরু করেন এবং সুফল লাভ করেন। এতে বিদ্যালয়টি শুধু পরিচিতি লাভ করেনি, সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে ও সচেতন বোদ্ধা মহলে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। এজন্যে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাসহ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন। চাঁদপুর সদর উপজেলার অন্য কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিংবা সুবিধাজনক স্থানে যখন উপজেলা রিসোর্স সেন্টার নির্মাণের জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আঙ্গিনায় সুবিজ্ঞ প্রধান শিক্ষক আবুল বাসার স্কুল ম্যানেজিং কমিটিকে ম্যানেজ করে রিসোর্স সেন্টারটি নির্মাণের সুযোগ করে দেন। সাথে সাথে গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে পত্রপত্রিকায় তুলে ধরেন নিজ বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত দুরবস্থা। এর ফলে কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়টির পুরানো ভবনের স্থলে দ্বিতল নূতন ভবন করে দেয়। এ বিদ্যালয়ের জন্যে এতোটুকুন কাজ সহ অন্যান্য কাজ করে ২৭ বছর পর তিনি বদলি হয়ে চলে যান পরীক্ষার ফলাফলে জেলার শ্রেষ্ঠ স্কুল হাসান আলী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মেধাবী শিক্ষক হিসেবে চাঁদপুর শহরে সুপরিচিত জুলফুর রহমান।
বস্তুত নূতন এই প্রধান শিক্ষক তাঁর একদল সুযোগ্য সহকর্মীকে সাথে নিয়ে তাঁদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় নিজের পরম মমতায় বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে ব্যতিক্রমভাবে সাজানো শুরু করেন। এরই মধ্যে নবনির্মিত সুদৃশ্য ভবন, সীমানা বেষ্টনী ও শিক্ষার্থীবান্ধব নানা উপকরণ পেয়ে তিনি হয়ে যান উজ্জীবিত। তিনি বিদ্যালয়টিকে যেভাবে সাজিয়েছেন, এজন্যে সহকর্মীগণসহ যে মেধা-শ্রমণ্ডসময়-অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, সেটি গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠার ৬ কলাম জুড়ে বিশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। এটি পড়ে আপাতত বলতে হয় : প্রধান শিক্ষক জুলফুর রহমান ইচ্ছাশক্তি, সদিচ্ছা ও রুচির সমন্বয় করে যা করেছেন, তাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণা ক্রমশ পাল্টে যেতে থাকবে এবং আগ্রহী বিদ্যালয়সমূহ অনুকরণের উপায় খুঁজে পাবে।